সবাই বলছে ‘সাবাস সাবাস’। কেউ বলে না ‘তফাত যাও’। এই তো সেদিন একটা গ্রুপে পোস্ট করা এক ভিডিয়োয় দেখি মাস্ক, গ্লাভস পরা এক সমাজকর্মী একটি ইটভাটায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা আট থেকে আশির হাতে সয়াবিনের প্যাকেট তুলে দিচ্ছেন। একটা বাড়িয়ে দেওয়া হাত সমান সমান এক প্যাকেট সয়াবিন। উপরি পাওনা একটু ভিডিয়ো।
প্রশ্ন রেখেছিলাম এদের কি মাস্ক দেওয়া যায় না? একটু বলা যায় না পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখতে? কী জানি, হয়তো দূরত্ব রাখলে কত বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে উনি পৌঁছলেন সেটা বোঝাতে অসুবিধা হত হয়তো!
পরের দিন আবারও একই রকম ভিডিয়ো। জায়গা আর মানুষগুলো শুধু আলাদা। হাততালি একই। লকডাউনের মরসুমে ত্রাণ বিলির এটা একটা ছোট্ট উদাহরণ। স্বীকার করি, সবাই এমন নন। অনেকেই যথেষ্ট সচেতন হয়ে দায়িত্ব নিয়ে কাজটা করছেন। করছেন সদিচ্ছা থেকেই। উনিও কাজটা করছেন ভালবেসেই। মানুষের পাশে থাকার ইচ্ছেয়— সেটাও হয়তো ঠিক। কিন্তু বুঝতে হবে এই করোনা পরিস্থিতিতে পাশে থাকা মানে কিন্তু গায়ে ঘেঁষাকে উৎসাহ দেওয়া নয়। তাঁর উচিত ছিল, এই সময়ে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার শিক্ষা দেওয়া ত্রাণ গ্রহীতাদের। এই শিক্ষা দেওয়াটাও কিন্তু সমাজকর্মীদের সামাজিক কাজের অঙ্গ হওয়া উচিত।
অথচ, কিছু ক্ষেত্রে ত্রাণ দেওয়ার মানে শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে চাল, ডাল, আলু বা রান্না করা খাবার বিলি। ব্যস। সকালবেলা রান্না, দুপুরবেলা গাড়িতে চাপিয়ে বা কোনও জায়গায় রেখে ভাত, ডাল বা খিচুড়ি বিলি। গামলা খালি। ব্যস, সে দিনের মতো কাজ শেষ। সারা বছর ধরে মানুষের সঙ্গে, মানুষের পাশে থেকে সেবার কাজ করছে এমন অনেক দল, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা আছে যাঁরা এই ব্যাপারে ভীষণ পেশাদার। তাদের কাছে আবেগের চেয়ে অনেক বড় সুস্থ ও সুষ্ঠু ভাবে কাজটা সম্পন্ন করা। তাদের হিসাব আছে সত্যি কে খেতে পাচ্ছে, আর কে পাচ্ছে না।
তবুও দিনের শেষে এমন অনেক মানুষ লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, হাত পাতছেন যাঁদের অবস্থা মোটেই না খেতে পাওয়া মানুষের মতো নয়। যাঁদের ঘরে চাল, চুলো সবই আছে। ধুবুলিয়ার এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী বলেন, কোনও এলাকায় খিচুড়ি বা ভাত দিতে গেলে তাঁরা দেখেছেন খিচুরি নেওয়ার লাইনে না খেতে পাওয়া মানুষ যেমন আছেন, বিঘা বিঘা জমির মালিক, বেশ স্বচ্ছল পরিবারের মানুষও তেমন আছেন। আসলে অনেকের কাছেই এ ভাবে খাওয়াটা অভাবের নয়, স্বভাবের হয়ে গিয়েছে। কোথাও ত্রাণ দেওয়ার খবর কানে এলেই ছুটে এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা। ত্রাণের প্রয়োজন না থাকলেও। সব জেনে-বুঝেও তাঁদের হাতে সাহায্য তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন পোড়-খাওয়া সমাজকর্মীরাও। আর যাঁরা নবীন কর্মী, করোনা পরিস্থিতিতে যাঁরা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ভাবনায় সেবার কাজ শুরু করেছেন সদ্য, তাঁদের অনেকের মতেই, ‘‘হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে কোনও এলাকায় গিয়ে ত্রাণ দেওয়ার সময়ে।’’ তাঁদের সীমিত ক্ষমতা অনুযায়ী এলাকা ঘুরে কাকে কাকে ত্রাণ দেওয়া যেতে পারে, এমন লোক খুঁজে বার করছেন। তার পর ত্রাণ বা রান্না করা খাবার নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, দলে দলে মানুষ হামলে পড়ছেন তাঁদের উপরে। সকলের দাবি— ত্রাণ দিতে হবে।
এ কথা সত্যি যে, হঠাৎ করে লকডাউন শুরু হওয়ায় পর অনেক মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন, ঘরের খাবার ফুরিয়ে গিয়েছিল, যেটুকু ছিল তা শেষ হওয়ার পর খাবার কেনার অর্থ ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় রেশন পাওয়ার পর চালের অভাব অনেকটাই মিটেছে। ডাল-ভাতের সমস্যা কিছুটা কমলেও নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত অনেক পরিবার যারা মুখ ফুটে বলতে পারে না খারাপ আছি, হাত পেতে চাইতে পারে না সাহায্য, তারা অনেকেই সমস্যায় আছেন। যিনি সেলের বাজারে বিক্রি করবেন বলে পোশাক কিনেছিলেন ধার-দেনা করে, তাঁর ঘরে সে সব জমে আছে এখনও। ঘরে টাকা নেই সংসার চালানোর। বাস কর্মী, ট্রাক চালক, ছোট ছোট কারখানার কর্মী যাঁদের গত মাসে বেতন হয়নি, কাজ হয়নি তাঁদের সাহায্য করার কথা কিন্তু প্রথমে মাথায় আসেনি অনেকেরই।
আশার কথা, রেশনের সমস্যা অনেকটা মেটার পর অনেক সমাজকর্মীই এখন চাল, ডাল বাদেও আর কী কী দিয়ে এই সব মানুষকে সংসারে সাহায্য করা যায়, ভাবতে শুরু করেছেন। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য মাস্কের পাশাপাশি স্যানিটারি ন্যাপকিনও অসহায় পরিবারগুলির কাছে পৌঁছে দিচ্ছে অনেক সংগঠনই। চেষ্টা চলছে। প্রথমে ছিল খাদ্যের প্রয়োজন। এখন খাদ্যের সমস্যা কিছুটা মেটার পর সংসারের টুকিটাকি জিনিসের প্রয়োজন বাড়ছে। সবাই পথ খুঁজছেন গৃহবন্দি মানুষকে এই কঠিন পরিস্থিতিতে কী করে ভাল রাখা যায়।
কিন্তু কিছু মানুষ তা বুঝছেন কোথায়? সরকার মানুষকে ঘরে রাখার জন্য রেশন দিচ্ছে। মানুষ দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ছে। তার মধ্যে নতুন সংযোজন মদের দোকান খোলা। সকাল থেকে মদের দোকানে লাইন পড়ছে রেশন দোকানের মতোই। সে লাইনে একই সঙ্গে দাঁড়িয়ে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত। এমনও শোনা যাচ্ছে, ত্রাণের চাল বিক্রি করে মদ কিনেছেন কেউ। কেউ বা আবার ত্রাণ দেওয়ার নাম করে চাঁদা তুলে সোজা মদের দোকানের লাইনে।
এ সব দেখে হতাশ এক সমাজ কর্মীর আক্ষেপ, ‘‘তা হলে কাদের ভাল রাখার জন্য এত দিন রাত এক করে খাটছি আমরা?’’
আরেক সমাজকর্মী তো মজা করেই বললেন, ‘‘ভাগ্যিস আমরা ওঁদের চাল দিয়েছি, তাই আজ ওঁরা মদ কিনতে পারলেন।’’
মজা করে বলছেন বটে, তবে কষ্টে বুক ফটছে অনেকেরই। যাঁরা মন থেকে আবেগ দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন এত দিন, মুখে বলতে না পারলেও এমন নানা ঘটনায় হতাশ হয়ে পড়ছেন। করোনা মোকাবিলায় প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন যাঁরা সেই সব চিকিৎসক, পুলিশকর্মীও মানসিক শক্তি হারাচ্ছেন এসব দেখেশুনে। ভাবছেন, এ ভাবে চললে শেষ পর্যন্ত কী হবে?
ত্রাণ নিয়ে রাজনীতি তো ছিলই। এখন ত্রাণ নিয়ে অসততাটুকু বন্ধ রাখা যায় না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy