দুর্গাপুজো উপলক্ষে আকাশবাণী থেকে বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান হবে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র চণ্ডীপাঠ করবেন। প্রশ্ন উঠল, কায়স্থকে দিয়ে চণ্ডীপাঠ করানো কি ঠিক হবে? শ্রোতারা আপত্তি তুলবেন না তো? নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার-বাণীকুমার-পঙ্কজ মল্লিকরা একযোগে নস্যাৎ করে দিলেন আশঙ্কা। নৃপেন বললেন, “প্রোগ্রাম করবে তার আবার বামুন কায়েত কী হে?... তা হলে এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে তারা তো অর্ধেক মুসলমান। খুশী মহম্মদ, আলি, মুন্সী সবাই তো বাজাবে।” তাঁরা বাজালেনও এবং শুধু তা-ই নয়, বন্দনালেখ্যর সুরজাল অনেকাংশে নির্ধারিতই হল উর্দুভাষী যন্ত্রশিল্পীদের হাতে।
স্বাভাবিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় এমনটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু যা কিছু ‘হওয়ার কথা’, সে সব এখন গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটাই বেশি হচ্ছে। আজকের চোখে তাই নিতান্ত স্বাভাবিক সামাজিক হৃদ্যতার কাহিনিও আলাদা করে উল্লেখযোগ্য, আলাদা করে সাহসী বলে মনে হচ্ছে। এ কম বেদনার কথা নয়। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র নেপথ্য কাহিনিও কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ধর্মের বেড়া সঙ্গীত বারবারই ভেঙেছে তার নিজের মতো করে। সেই সঙ্গে এই ক্ষেত্রে অন্তত দুর্গাপুজোর নিজস্ব উদাত্ত চরিত্রটিও তার সহায়ক হয়েছিল। দুর্গাপুজোর চেনা আমেজের মধ্যেই ‘সবারে করি আহ্বান’ মন্ত্রটি কোথাও নিহিত আছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান— ধর্মচেতনা, সম্প্রদায়চেতনা তার মধ্যে একেবারে থাকবে না, আশা করা যায় না। সর্বজনীন দুর্গোৎসবের ইতিহাস তা বলেও না। তবু এ কথা অস্বীকার করা চলে না যে, দুর্গাপুজো বহুলাংশেই ধর্মকে অতিক্রম করে সংস্কৃতি আর সামাজিকতায় পরিণত। সেটাই তার বিশেষত্ব, সেটাই তার জোর। সামাজিক মিলন যদি উৎসবের সবচেয়ে বড় চিহ্ন হয়, দুর্গাপুজোকে ঘিরে এক বৃহৎ মিলনমেলাই বহু বছর ধরে আয়োজিত হয়ে আসছে। মহেন্দ্রনাথ দত্ত সেই কবে ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’য় লিখে গিয়েছেন, “সর্ব বিষয়ে তখন দুর্গাপূজায় মহা আনন্দের ভাব ছিল। এমনকি গ্রাম্য মুসলমানরা আসিয়া প্রতিমাকে তিনবার সেলাম সেলাম বলিয়া চলিয়া যাইত।” দেশভাগের অব্যবহিত পরে ছিন্নমূল পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলে দক্ষিণারঞ্জন বসু যখন ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’ লিখছেন, সেখানেও— সেই হানাহানি, সেই দেশত্যাগের যন্ত্রণাময় স্মৃতিকথনেও— দুর্গাপুজোর আখ্যানে মিলনের সুরই বাজে। “ছোটবেলায় দেখেছি দুর্গাপুজোয় মুসলমানের আনন্দ কম নয়। হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের ঘরেও আসত নতুন কাপড়। মুসলমান মেয়েরা পাড়ায় পাড়ায় প্রতিমা দেখে বেড়াত। রং বেরঙের লুঙ্গি পরে গলায় গামছা ঝুলিয়ে এ গাঁয়ের সে গাঁয়ের মুসলমানেরা সকাল সকাল ঠাঁই করে নিত যাত্রার আসরে।” ময়মনসিংহের সাঁকরাইল গ্রামের অভিজ্ঞতা বলছে, “বিজয়া দশমীর কথা ভুলব কী করে? ফটিকজানির বুকে আশপাশের সমস্ত গ্রাম থেকে এসে জড়ো হত প্রতিমা... গাঙের বুক মথিত হয়ে উঠত বাইচ খেলার নৌকার তাণ্ডব নর্তনে। সে খেলায় বেশির ভাগ অংশই গ্রহণ করত মুসলমানেরা।” চট্টগ্রামের গোমদণ্ডী গ্রামে পুজোর থিয়েটার, যাত্রা, কবিগানের সঙ্গে গাজির গানও থাকত। “সকলে সমান অংশীদার হয়ে তদারক করত আসর— গানের অর্থবোধ করে কাঁদত সকলেই সমান ভাবে।”
এই-ই তো উৎসবের মর্মকথা। সামাজিক বিভিন্নতা, এমনকি বৈষম্যের উপরেও সাময়িক ভাবে সৌন্দর্য, সৌজন্য আর আত্মীয়তার চাদর খানিকটা হলেও বিছিয়ে দেওয়া। দুর্গাপুজোকে ঘিরে এই মিলনের অংশীদারি বাংলায় তৈরি হয়েছিল প্রাণের আনন্দে, সহজ সামাজিকতায়। যে কুম্ভকার প্রতিমা গড়ছেন, তিনিই কখনও গড়ে দিচ্ছেন দুলদুলের ঘোড়া। পুজোর ফুল, জরির সাজ জোগান দিচ্ছেন, মণ্ডপের বাঁশ বেঁধে দিয়ে যাচ্ছেন ভিন্ধর্মের কারিগর। কাউকে চোখ রাঙাতে হচ্ছে না, কাউকে মেরেধরে ‘দুর্গা মাইকি জয়’ বলাতে হচ্ছে না। ভারতমাতা বা শ্রীরামের নব্য উপাসকরা বঙ্গীয় অকালবোধনের এই স্বতঃস্ফূর্ততার আস্বাদ জানেন না। তাঁরা ধর্মকে উপলক্ষ করে বিদ্বেষ আর বিভাজনের বীজ পুঁততে জানেন কেবল। সেই কুশ্রীতা থেকে দুর্গোৎসবকে মুক্ত রাখতে পারাটা এই মুহূর্তের অন্যতম সামাজিক কর্তব্য, মানবধর্মের দায়।
উৎসব-ধর্মেরও দায়। পুজো মানে ধর্মীয় উৎসব ঠিকই। কিন্তু তার ঊর্ধ্বে উৎসবেরও একটি নিজস্ব ধর্ম আছে। সেটি ঔদার্যের, প্রশস্ততার। যে উৎসব যত বেশি বিভিন্নতাকে আলিঙ্গন করতে পারে, সে তত বেশি মহীয়ান। বাঙালির দুর্গোৎসব এই নিরিখে প্রথম সারিতে থেকেছে বরাবর। সে কি শুধু ভিন্ধর্ম বা ভিন্-ভাষীদেরই এক করেছে? বামপন্থীরা তো মতাদর্শগত ভাবেই পুজোয় বিশ্বাস করেন না। কিন্তু পুজোর চাতালে মার্ক্সবাদী সাহিত্যের পসরা তাঁরাও সাজান। ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে চে গেভারার ছবি একটুও বেমানান ঠেকে না। মনে হয়, এ-ও যেন উৎসবের একটা অঙ্গ।
দুর্গাপুজোকে শুধু পুজো হিসেবে ভাবার অভ্যাসই যে নেই আমাদের। প্রতিমার গড়নে, প্যান্ডেলের আকারে, থিমের প্রতিযোগিতায় দুর্গাপুজো মানে ভরপুর কলাশিল্পের চর্চা! কোনও ধর্মানুষ্ঠানকে ভিত্তি করে একটা রাজ্য পাঁচ দিন ধরে কার্যত ইনস্টলেশন আর্ট-এর মেলায় পরিণত হচ্ছে, পৃথিবীতে এমন ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। কোনও ধর্মোৎসবকে মরসুম ধরে নিয়ে বিশেষ সাহিত্যসম্ভার প্রকাশিত হয়ে চলেছে বছরের পর বছর, এমন দৃষ্টান্তই বা ক’টা? নাস্তিকের পুজো না থাকতে পারে, তার জন্যও পুজোসংখ্যা আছে। এই সব অত্যাশ্চর্য স্বাতন্ত্র্যই দুর্গোৎসবের অভিজ্ঞান। ‘বিদূষক’ দাদাঠাকুর অবলীলায় আগমনি গানের প্যারডি লেখেন, ‘‘কৈলাসেতে থাকো গায়ে ছাই মাখো/ লোকমুখে শুনি কাহিনী/ এলে মোদের আবাসে বাড়াও বিলাসে/ একি মা সিংহবাহিনী।’’ কেউ কিন্তু ফুট কাটেন না, ঠাকুরদেবতাকে নিয়ে মশকরা কেন! ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ‘দুর্গার দুর্গতি’ রেকর্ড করেন, কেউ মনে করেন না, এতে মা দুর্গাকে খাটো করা হচ্ছে! ঠাকুরের সঙ্গে আপনাত্তিই এমন যে তাকে নিয়ে মজা করাও চলে, এমনটাই ভাবতে অভ্যস্ত আমাদের সংস্কার। রাজনৈতিক প্রণোদনায় আজকাল এ রাজ্যে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নতুন করে আমদানি হচ্ছে। প্রচলিত অনুষ্ঠানের অবয়ব বদলাচ্ছে। দুর্গাপুজোর দিকেও নজর পড়েছে ভাল রকম। এখন মা যা ছিলেন, মা তা-ই থাকবেন কি না, সেটা মায়ের সন্তানদেরই ঠিক করতে হবে। বিদ্বেষ আর অসহিষ্ণুতার আসুরিক শক্তির বিনাশ কামনা এই অবসরে খুব অসঙ্গত হবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy