Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2020

এমন বিসর্জন কি নিয়ম হবে

শুধু পুলিশ, প্রশাসন বা আদালত দিয়ে বিসর্জনের মতো বিষয়কে সামলানো যাবে না। চাই এমন এক ব্যবস্থা, যা অন্তত সমাজের বৃহত্তর অংশের স্বীকৃতি পাবে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

জয়ন্ত বসু
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২০ ০২:২৭
Share: Save:

মণ্ডপ প্রাঙ্গণে জল দিয়ে গলিয়ে প্রতিমা ভাসানের এক নয়া পদ্ধতি এ বছর দেখা গেল কলকাতায়, যাকে নদীতে বা জলাশয়ে দূষণ কমানোর ক্ষেত্রে মডেল মানছেন পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই ধরনের প্রচেষ্টা আদৌ কি কোনও দিন নিয়ম হয়ে উঠবে, না কি ব্যতিক্রমই থেকে যাবে?

দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম পুজো ত্রিধারা এই বছর বিসর্জন দিল মণ্ডপের পাশেই তৈরি করা একটি কৃত্রিম জলাধারের মধ্যে পাইপের জেট-জলের স্রোতে মূর্তিগুলিকে গলিয়ে দিয়ে। এমন বিসর্জন আগে নৈহাটি অঞ্চলের কয়েকটি কালীপুজোয় দেখা গেলেও বাকি রাজ্যে ও দেশে বিরল। এর ফলে মূর্তি বিসর্জনের জন্য যে দূষণগুলি সাধারণ ভাবে নদীতে হয়, সেগুলিকে আটকে রাখা গেল। মনে রাখতে হবে, কলকাতা ও শহরতলির মানুষের একটা বড় অংশ পানীয় জলের জন্য গঙ্গার ওপর নির্ভরশীল। ফলত, বিসর্জনের সময় হওয়া দূষণের অনেকটাই যাবতীয় পরিশোধন সত্ত্বেও আমাদের কাছেই ফেরত আসে, বহু রোগভোগ নিয়ে।

জাতীয় পরিবেশ আদালতের পরিবেশসম্মত বিসর্জন নিয়ে একাধিক নির্দেশের প্রেক্ষিতে আরও কয়েক রকম বিসর্জনের দেখা মিলেছে এ বার রাজ্যে। কলকাতার লাগোয়া লেকটাউন ও দমদম অঞ্চলে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের উদ্যোগে বড় জলাশয়ের অংশবিশেষকে ঘিরে বিসর্জনের বন্দোবস্ত হয়েছিল; আবার হুগলিতে রেললাইন পেতে মূর্তিকে গঙ্গায় ফেলার বন্দোবস্তের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভাইরাল’ হয়েছিল।

দেশের অন্যান্য প্রান্তেও পরিবেশ বাঁচিয়ে এমন নানা বিসর্জন মডেলের চেষ্টা শুরু হয়েছে গত বছর দুয়েক ধরে। মুম্বইয়ে আরব সাগর ও দিল্লিতে যমুনা বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট জলাশয়ে বিসর্জন শুরু হয়েছে। এমনকি প্রয়াগরাজেও গঙ্গায় বিসর্জন সরকারি ভাবে ব্রাত্য হয়েছে। মনে পড়ে যাচ্ছিল মহারাষ্ট্রের লাতুরের কথা, যেখানে গত বছর গোটা বিসর্জনটাই বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। কারণ, শহরের যে ছ’টি জায়গায় বিসর্জন হয়, সেখানে কোথাও এক ফোঁটা জল ছিল না! ফলে, সারা শহরের মানুষের সম্মতিতে বিসর্জনের বদলে মূর্তিগুলিকে পুনরায় ব্যবহারের জন্য রাখা ছাড়া উপায় ছিল না।

কিন্তু এগুলি ব্যতিক্রমই। গঙ্গাদূষণ নিয়ে আশির দশক থেকে এখনও অবধি অনেক জল বয়ে গেলেও, গঙ্গায় বা অন্য নদীতে বিসর্জন হওয়াটাই নিয়ম। বিশেষ করে, এ রাজ্যে। রাজ্যে সব পুজো মিলিয়ে কয়েক লক্ষ মূর্তি তৈরি হয়। তার প্রায় পুরোটাই পড়ে গঙ্গা ও অন্যান্য নদীতে। চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো হাতেগোনা ব্যতিক্রম, যেখানে নব্বইয়ের দশক থেকেই স্থানীয় মানুষের চেষ্টায় বিসর্জনের পর দ্রুত গঙ্গা থেকে মূর্তি সরানো হয়। কলকাতার কয়েকটি ঘাট বাদ দিলে বিশেষ কোথাও চটজলদি মূর্তি তোলার যান্ত্রিক পরিকাঠামো নেই। এই ছবি অন্যান্য শহরেও কম-বেশি একই রকম। মুম্বইতে এত বিধিনিষেধ সত্ত্বেও এ বছর তিরিশ হাজারের উপর গণেশ মূর্তির অর্ধেকের কাছাকাছি সমুদ্রেই পড়েছে। প্রশাসন অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনে করে যে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘাট পরিষ্কার করে দিলেই বোধ হয় যাবতীয় দূষণ সামলে ফেলা যায়। এমনকি দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ জলের গুণাগুণ পরীক্ষা করে নিদান দেয় যে, বিশেষ দূষণ হয়নি। কিন্তু এত বছর ধরে নিরন্তর জমে-চলা রাসায়নিক ও অন্যান্য দূষকের প্রভাবে নদীর শরীরে কী গভীর অসুখ হচ্ছে, তার হদিশ কি আমরা রাখি?

রাখি না, কারণ রাজনৈতিক দল ও তার নেতা-নেত্রীরা, এবং সরকারি আধিকারিকরা মনে করেন, এ দেশে বিসর্জনের মতো ধর্মীয় বিষয় নিয়ে বিশেষ নাড়াচাড়া না করাই ভাল। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রী জয়রাম রমেশের কথায়, পরিবেশ তো ভোট পাওয়ায় না! আমায় এক রাজনৈতিক নেতা এক সময় বলেছিলেন, এ সব প্যানডোরা’স বক্স কেউ খোলে? আসলে কোনটা প্যানডোরা’স বক্স, আর কোনটা বেঁচে থাকার চাবিকাঠি, সেটা অধিকাংশ রাজনীতিবিদই বোঝেন না। বুঝলে দেখতে পেতেন, কী ভাবে একের পর এক নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত দূষিত নদীতে মাছেদের দফারফা হয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মৎস্যজীবীর ভবিষ্যৎ।

শুধু পুলিশ, প্রশাসন বা আদালত দিয়ে বিসর্জনের মতো বিষয়কে সামলানো যাবে না। চাই এমন এক ব্যবস্থা, যা অন্তত সমাজের বৃহত্তর অংশের স্বীকৃতি পাবে। যে হেতু গঙ্গার জলে বিসর্জন নিয়ে অনেক মানুষের মনেই আবেগ কাজ করে, তাই ত্রিধারা অনুসৃত ‘ধোয়া ও গলিয়ে দেওয়া’ মডেলে গঙ্গার জল ব্যবহার করে গঙ্গার ঘাটগুলিতে বিশেষ ‘বিসর্জন কক্ষ’ তৈরি করে চেষ্টা করাই যেতে পারে। বিসর্জনের পর দূষিত পদার্থ মেশা জলকে পরিশোধন করে গঙ্গায় ফিরিয়ে দিলে দু’কূলই বজায় থাকে; আবেগও, পরিবেশও। বস্তুত, এখন বিসর্জনের পর যে ভাবে ক্রেনের সাহায্যে বা মানুষ দিয়ে টেনেহিঁচড়ে মূর্তিগুলিকে আবর্জনা বানানো হয়, তাতে পরিবেশ দূষণ কতটা কমে তা জানা নেই, কিন্তু দৃশ্যদূষণ বেশ প্রকট হয়। বরং ধোয়া ও গলিয়ে দেওয়া মডেল ব্যবহার হলে মৃন্ময়ী মা মাটিতেই শেষে মিশে যাবেন, যার থেকে ভাল বোধ হয় কিছুই হয় না।

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2020 Editorial Puja Biasarjan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy