Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
দর্শন প্রদর্শনের গপ্পো
Durga Puja 2020

ঘরে ফেরার পুজোর জায়গা নিয়েছে ‘প্যান্ডেল হপিং’-এর পুজো

সবাই সাবধান করছে বার বার। বাস্তবের শরীর জুড়ে যন্ত্রণার দাগ। রাস্তায় নেমে আসা মানুষের ঢলে অলক্ষ্য ভাইরাসের অন্ধকার মুছে দিতে মরিয়া সাফাই কর্মীরা।

ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

সোনালী দত্ত শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২০ ০১:০৪
Share: Save:

আশ্বিনের মাঝামাঝি মনের মধ্যে পুজোর বাজনা বাজবে। অল্পে সন্তুষ্ট বিধু আর আড়ম্বরপ্রেমী মধু ছুটে যাবে মায়ের কাছে, বাবা নতুন পোশাক আনল কি না, তার খোঁজে। সেই চিরন্তন আনন্দের সঙ্গে দরিদ্র ছিটকাপড়ের জামা আর ধনী সাটিনের শার্টের একটা অন্তহীন দ্বন্দ্বের ট্র্যাজেডি থেকেই যাবে। তবু শেষকালে জয়ী হবে উৎসবের আলো, যেখানে ছিট, সাটিন সব একাকার। পুজো মানে তো আসল ওই আলোটাই।

নকল নিয়নের ঝলকানি নয়, আসল আনন্দের দ্যুতি। এখন বাংলার পুজোর মণ্ডপে আশ্বিনের আশ্বাসের বদলে কার্তিকের চোরা হিম। দামি সাউন্ডবক্সের আওয়াজ গিলে ফেলেছে মধু-বিধুর খুশির প্লাবন। দর্শনার্থীর ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষ নিজেকে খুঁজে পেতে চাইছে ভার্চুয়াল মানচিত্রে। অসংখ্য বিজ্ঞাপনের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে মোবাইল ক্যামেরায় ধরা নিজের সাজানো উপস্থিতি। সেই এলইডি-শোভিত আড়ম্বরের এক কোণে ঢাক কাঁধে দাঁড়িয়ে মেদিনীপুর বা বাঁকুড়া। নেহাতই পাতে দিতে হয় বলে দেওয়া সেই ঢাকের শব্দে তবু মণ্ডপ প্রাণ খুঁজে ফেরে।

বাবার বোনাস হওয়ার অপেক্ষার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আমাদের অনেকেরই শৈশবের শারদোৎসব। পিসিরা কবে আসবে? মেজকাকা? পিসি, কাকা মানে যে কেবল আর দু’একটা জামার সম্ভাবনা, তা-ই নয়, অনেকগুলো ভাইবোন, চার দিনের তুমুল হইচই। সামনে পরীক্ষার চোখরাঙানি উপেক্ষা করে পড়া ফাঁকির উদ্ভাবনী আনন্দ। বাড়ির নিউক্লিয়াস ঠাকুমার চোখে তখন এক অন্য খুশি। মণ্ডপে উমা এলেই প্রবাস থেকে তাঁর কোলে ফিরে আসবে ছেলেমেয়েরা।

এ অপেক্ষা কেবল পূজাবেদির প্রদীপের নয়, বাড়ির উঠোনের তুলসীতলায় বেজে ওঠা প্রতি দিনের শঙ্খধ্বনিরও। আমাদের দুর্গা তো কোনও স্বর্গের দেবী নন— প্রবাসে থাকা আমাদের বাড়ির মেয়ে। ওইখানেই তো বাঙালির উপাসনার জিত। তার প্রিয় আর দেবতাকে সে মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলেছে পরিবার থেকে পার্বণে। অষ্টমীর অঞ্জলি কার পায়ে পড়ল, তা নিয়ে ভাবনা নেই। ফুল হাতে করে যে ছোটমাসি, খুড়তুতো ভাই, পাড়ার জ্যাঠামশাই, পাশের বাড়ির কাকিমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি, সেই তো আমাদের স্বর্গ লাভ!

এক দিন আমাদের পুজো ছিল ঘরে ফেরার গল্প। সে ঘর কোনও নির্দিষ্ট ‘পোস্টাল অ্যাড্রেস’ নয়। প্রিয়জনের হাসিমুখ, প্রতিবেশীর আন্তরিক সম্ভাষণ, ফেলে যাওয়া অলিগলিতে সবান্ধব উল্লাস ভ্রমণ, এক দুপুর গল্প, চিলেকোঠার ঘরে টুকটাক প্রেম, মাঝরাত্তির পর্যন্ত পাড়ার মণ্ডপ বা বাড়ির পুজোর উঠোনে চেয়ার পেতে বসে আড্ডা, এই ছিল আমাদের ঈশ্বরীর প্রত্যাবর্তন-বিন্দু। এমনকি রোদ-ভেজা বিছানায় বসে সপ্তমীর লুচি-আলুর দম, পাড়ার প্রত্যেক বাড়িতে ঝোলানো বাল্ব-এর হলুদ মায়াবী সিলুয়েটে শেষকালের শুকনো ফুচকা, প্রসাদের থালায় গাঁদা ফুলের পাপড়ি আটকানো পাকা পেয়ারার কুচি, বেলা গড়িয়ে যাওয়া সস্তা সসে সিক্ত এগরোল, সর্বত্র ছড়িয়ে থাকত উৎসবের সুর। মালার ভারে মা দুগ্গার হেলে যাওয়া মুকুট, বেদির দু’পাশে আধজ্বলা মাটির প্রদীপ, পাড়ার গলিপথ জুড়ে ছড়ানো-ছেটানো কাঠের চেয়ার, চোঙা মাইক, ভেলপুরি আর আলুকাবলির ঠেলাগাড়ি সেই অনবদ্য সঙ্গীতে অসাধারণ সঙ্গত করত। শৈশবের পুজোর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আজ যেন আমরা কি ওই গানটাই শুনতে পাচ্ছি না?

অসুখ-সময়ের আকালবোধন উপভোগ করতে আজও কিন্তু মধু, বিধু পথে নামে। ছিটের জামায় এখন তাদের কারও তৃপ্তি নেই। অনলাইন হোক বা স্যানিটাইজ়ার-চোবানো শপিং মলে এখন পুজো কাটে। সেই সাটিন আর তার খরিদ্দারের মাঝখানে এখন তো কেবল মা দুর্গাই নেই, দামি ব্র্যান্ডের সুবিপুল আত্মপরিচয় ঘোষিত হচ্ছে সারা দিন, সর্বত্র। মধু, বিধুর সাধ্য কী তাকে এড়িয়ে যায়? ফসল ভাল হোক না হোক, তালাবন্ধ সময়ে অভিভাবকের চাকরি থাক না থাক, বন্ধু মহলে ‘প্রেস্টিজ’ বলে একটা ব্যাপার তো আছে? তারা এখন আর ঠাকুর দেখতে যায় না, ‘প্যান্ডেল হপিং’ করে।

সময় খারাপ। পুজো মণ্ডপ এখন প্রায় দুর্গ। ব্যারিকেড উড়িয়ে দেওয়া ‘ফেস্টিভ্যাল’ পথের দু’পাশে আইসক্রিম, ঠান্ডা পানীয় আর বার্গারে মিটিয়ে নেয় সেই দুর্গ জয়ের ক্লান্তি। কতটা দেখা হল, তার চেয়ে অনেক দরকারি প্রশ্ন, কতটা দেখানো গেল? ‘শৈল্পিক’ মণ্ডপ, ‘সমাজসচেতন’ মণ্ডপ এ সবের সামনে দাঁড়িয়ে অথবা দেবীকে ব্যাকগ্রাউন্ড বানিয়ে যদি একের পর এক নিজস্বী তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেকে অপরের ‘লাইক’-প্রত্যাশীই না করে তোলা গেল, উৎসবের সার্থকতা কোথায়? আত্মপ্রকাশ এবং প্রচারের এই সুবিপুল বাণিজ্যিক আয়োজন মুখোশের আড়ালে নয়, মানুষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় সাধু নরোত্তমের। মধু, বিধুর রঙিন চশমায় তো আর পথের পাশের নিঃস্ব মানুষজনকে দেখা যায় না? চশমাটা যে খুব কায়দা করে বানিয়ে দিয়েছে আমাদের ‘সিস্টেম’। তাই আজ দর্শন গৌণ হয়ে গিয়ে জ্বলজ্বল করে ‘প্রদর্শন’। দর্শক চাই। দর্শকের ঢল না নামলে প্রদর্শনের সার্থকতা কোথায়? আনন্দের বিপণন হবে কেমন করে? হাটতলা সর্বজনীনের সঙ্গে অমুক স্কোয়ারের তফাতটা বুঝতে হবে না? কাজেই সে মণ্ডপে দেবী থাকুন না থাকুন, থিমের সামনে থমকে দাঁড়ানোই এখন ঠাকুর দেখার সার্থকতা।

প্যান্ডেল হপিং-এ বেরোবার আগে এক বার আয়নার সামনে দাঁড়ালে মধু, বিধু দেখতে পেত, তাদের মুখ ঢেকে দিয়েছে অসংখ্য ক্যাশমেমো। সেই ক্যাশমেমোর স্তূপ সরিয়ে কিছুতেই মাতৃমূর্তির মুখ স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছে না। মা যতই চিকিৎসকের অ্যাপ্রন পরে দাঁড়ান অথবা শ্রমিক রমণী হয়ে, সাবেক ডাকের সাজ বা লালপেড়ে শাড়িতে যতই ফুটে উঠুক বাঙালি গৃহবধূর শান্ত রূপ, কোথাও যেন গলির মোড়ের কান্তবাবুর কর্নেটের বিষাদ সুর আমাদের বিপন্ন করে দেয়। সেই স্বপ্নের চেনা ফেরিওয়ালারা গেল কোথায়, যারা মেলাত এবং মিলত? সেই চেনা দুঃখ চেনা সুখের মানুষগুলো কোথায়, যাদের ছাড়া উৎসব অনর্থক? এই সব কিছুকে ফেলে, ঠেলে, সরিয়ে আমরা কিসের উদ্যাপনে মাততে চাই, কেন আনন্দকে ঠেলে পাঠাতে চাই ভেন্টিলেটরে?

সবাই সাবধান করছে বার বার। বাস্তবের শরীর জুড়ে যন্ত্রণার দাগ। রাস্তায় নেমে আসা মানুষের ঢলে অলক্ষ্য ভাইরাসের অন্ধকার মুছে দিতে মরিয়া সাফাই কর্মীরা। টাইমস স্কোয়ারে ঝুলে আছে মৃত্যুর ঘড়ি। তবু এত অশনিসঙ্কেত মধু, বিধুর চোখে পড়ে না, অথবা তাদের দৃষ্টিপথেই রয়েছে ব্যারিকেড? সেই স্রষ্টাকে প্রণাম, যিনি সমাজকে তুলে ধরেছেন শিল্পে। সেই যোদ্ধাকে স্যালুট, যিনি সস্তা জামাকাপড় অস্ত্র করে জীবন যুদ্ধ লড়ে যাচ্ছেন ফুটপাতের দোকানে। সেই বেলুনওয়ালাকে অভিনন্দন, কোভিডের কালো-সাদা দিনে যিনি মানুষের মনে উড়িয়ে দিয়েছেন রঙিন খোয়াব। কিন্তু মধু, বিধু তাদের আসল কথাটা শুনতে পাবে না, কেবল ঝাঁ-চকচক পুজো দেখার খোঁজে উদ্ভ্রান্ত বিপদের দিকে দৌড়তে থাকবে!

ক্যাশমেমো ঘাঁটতে ঘাঁটতে মধু, বিধু এখন ভুলেই গিয়েছে ঘরের ঠিকানা। অচেনা ভাইরাস এক দিন হয়তো ভ্যাকসিনে না হোক, এমনিই যাবে। কিন্তু চেনা ভাইরাসের হাত থেকে তারা কবে মুক্তি পাবে, কেউ জানে না। তাদের লক্ষ্যহীন দৃষ্টির ব্যাকগ্রাউন্ডে নিশ্চিন্দিপুর নেই, সর্বজয়ার ভাঙা দালান নেই, পুকুরধারে সঙ্গীরা নেই, হাওয়ায় দোলা কাশবন নেই, এমনকি মা দুর্গাও নেই! কেবল আছে আলোর ঝলকানি। আর সেই ঝলক-আলোর উপর আছে ভারী লোভনীয় অফার: দুটো কিনলে একটা ফ্রি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy