প্রতীকী ছবি।
শহরতলির লোকাল ট্রেন। থিকথিকে ভিড়। প্যাচপেচে গরম। এ দিকে গলা শুকিয়ে কাঠ। প্রাণ ওষ্ঠাগত। একটু জল চাই। এমন সময়ে কানে এল— ‘দশ টাকায় গলা ভেজান, ঠান্ডা-ঠান্ডা, কুল-কুল।’ একে তো জল, তার উপরে ঠান্ডা। এ তো সোনায় সোহাগা। ফিরিওয়ালার স্লোগানে কামরা মুখরিত হয়ে উঠল।
বাসে-ট্রেনে, চলার পথে এই দৃশ্য রোজকার। কয়েক দশক আগেও ছবিটা অন্যরকম ছিল। মাঠ থেকে ফিরে ঘেমেনেয়ে একসা। তার পরে উঠোনে বসে এক ঘটি ঠান্ডা জল। সঙ্গে বাতাসা। সে কী স্বস্তি! কিন্তু পুরনো সেই দিনের কথা এই বিশ্বায়নের যুগে আজ সাদা-কালো ছবির মতো। জল এখন শুধুই আর প্রাকৃতিক সম্পদ নয়। বাণিজ্যিক পণ্যও। আজ রাস্তার মোড়ে, মুড়ির দোকানে, ওষুধের দোকান, বাসে-ট্রামে নানা কোম্পানির বোতলবন্দি জল নিতান্ত ‘জলের দরে’ বিক্রি হচ্ছে। গ্যাঁটের কড়ি খসিয়ে সেই স্বস্তি গলাধঃকরণ করছেন সবাই।
ছোটবেলা ভূগোল বইয়ে পড়েছি, পৃথিবীর এক ভাগ মাটি, তিন ভাগ জল। চারপাশে কত নদী। নাম মুখস্থ করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হত। অথচ আজ পানীয় জলের তীব্র সঙ্কট। আসলে বিজ্ঞান বলে, পৃথিবীর মোট জলের পরিমাণের মাত্র ২.৫ শতাংশ পানযোগ্য। এই পানযোগ্য জলের ১ শতাংশ ভূগর্ভে, নদী-নালা, হ্রদ ও পুকুরে আছে। যা আগে সহজলভ্য ছিল। পরিবেশ দূষণ, জনস্ফীতির মতো নানা কারণে আজ পানীয় জল ব্যবসায়িক মহার্ঘ পণ্য।
বিভিন্ন সময়ে ভারতে জলের বেসরকারিকরণ করার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৯৮ সালে ছত্তিসগঢ়ে শেওনাথ নদীর ২৩ কিলোমিটার একটি কোম্পানিকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। যার ফলে নদীর দু’পাশের গ্রামগুলিকে দৈনন্দিন ব্যবহারের জল কিনতে হত। সে পানীয় জল হোক বা চাষের জল। বহু আন্দোলনের ফলে ওই নদী মুক্ত হয়। মহারাষ্ট্রে নীরা নদীর ২০০ কিলোমিটার এক হাজার কোটি টাকায় বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিরোধিতার ফলে ২০০৯ সাল থেকে ওই প্রস্তাব স্থগিত আছে।
বাইরের কথা বাদ দিন; নিজের এলাকার চারপাশে দেখুন তো! জল বিক্রির জন্য কত রকমের মন-ভোলানো বিজ্ঞাপন! এ সবের কল্যাণে সবার বাড়িতে এখন ২০ লিটারের জেরিকেনের অবাধ প্রবেশ। অথচ বেশিরভাগ কোম্পানির না আছে সরকারি অনুমতি, না আছে আইএসআই-এর শংসাপত্র। এমনিতে ব্র্যান্ডেড কোম্পানির মিনারেল ওয়াটারের দাম অনেক বেশি। ২০ লিটার জলের দাম পড়ে প্রায় ৯০ থেকে ১০০ টাকা। সে জল কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই বহু লোকের। কিন্তু আমার-আপনার বাড়িতে যে জল আসে সেটা তো ৩৫-৪০ টাকাতে পাওয়া যায়। রোজের সংসারে জল তো লাগেই। আর এই কোম্পানির জলগুলোও তো ‘মিনারেল ওয়াটার’। আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয়তা আর বাস্তব জ্ঞানহীন ধারণাকে কাজে লাগিয়েই ব্যবসা করে চলেছে বেশ কিছু সংস্থা। মাটির নীচের জল জেরিকেনে ভরে ছোট ছোট গাড়িতে পৌঁছে যায় আপনার বাড়ির দোরে।
প্রতিদিন প্রায় তিন থেকে চার হাজার জেরিকেন বিক্রি হয় একটা ছোট মফস্সল-শহরে। গ্রীষ্মের সময় সরবরাহ আরও বেড়ে যায়। কিন্তু এই জলের জন্য প্রয়োজনীয় বটলিং প্ল্যান্টের কথা আমরা ক’জন জানি? আইএসআই-এর লাইসেন্স প্রাপ্ত বটলিং প্ল্যান্ট কি না তাও জানি না। সরকারি নিয়ম মাফিক বটলিং প্ল্যান্টের জন্য থার্মাল শিটের ছাদ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রো বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও সিলিন্ডার রুম, দু’টি জল পরীক্ষাগার, স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি জলের পাইপ ও রিজার্ভার, জেরিকেন ও বোতল রাখার পৃথক ঘর প্রভৃতি না থাকলে মেলে না অনুমোদন। তা ছাড়া পরিশোধন ব্যবস্থা এবং পরিকাঠামো স্বাস্থ্যসম্মত কি না তা খতিয়ে দেখতে প্রতি দু’মাস অন্তর পরিদর্শনে আসেন আইএসআই-র প্রতিনিধি দল। এই ভাবে একটি বটলিং প্ল্যান্ট গড়তে কমপক্ষে ৩০-৩৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন হয়।
অথচ আমাদের চারপাশে নব্য গজিয়ে ওঠা প্ল্যান্টে স্রেফ একটা গভীর শক্তিশালী পাম্প বসিয়েই কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে। জল রিজার্ভারে রেখে সরাসরি জেরিকেনে ভরা হচ্ছে। পরিশোধনের প্রক্রিয়া নামমাত্র মানা হয়। লাখ দুয়েক টাকা খরচ করলেই একটা ছোট্ট খুপরি ঘর হয়ে উঠছে বটলিং প্ল্যান্ট। এদের ২০ লিটারের এক একটি জেরিকেনে উৎপাদন খরচ পড়ে বড়জোর চার টাকা। পরিবহণ বাবদ ৩-৪ টাকা খরচ ধরলে ২৫ টাকা মতো লাভ।
এ ভাবে প্রতিদিন গড়ে ২০০টি করে জেরিকেন বিক্রি করতে পারলেই দৈনিক লাভ পাঁচ হাজার টাকা। ২০০০ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের জারি করা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অনুসারে, আইএসআই ছাপ ছাড়া কোনও ভাবেই কেউ বোতলবন্দি জল তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু তার পরেও অনুমোদনহীন বহু সংস্থা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে গোটা রাজ্যে।
গ্রামীণ মহিলারা বহু দূর থেকে কাঁখে করে জল বয়ে আনছেন। কুয়োয় নেমে তলানি জল তুলছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন এমন ছবি ভাইরাল। চারপাশে হায় হায় রব। আমাদের ঠাকুর্দা নদীতে জল দেখেছেন, বাবা কুয়োয়, আমরা কল থেকে জল পেয়েছি, আমাদের ছেলেমেয়েরা পাচ্ছে বোতলে। এরপরে কী হবে? পরবর্তী প্রজন্ম কি তবে ক্যাপসুলেও জল দেখবে?
সম্প্রতি প্রকাশিত নীতি আয়োগের জল সূচক বিষয়ক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ২১টি বড় শহরের ভূগর্ভস্থ জল কমে আসছে। ২০২০ সালের মধ্যে তা শেষ হয়ে যাবে। ফলে চরম জলকষ্টের মধ্যে পড়বেন অন্তত ১০ কোটি মানুষ। সম্প্রতি বহু জায়গায় পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সে সব জায়গায় জলের অস্বাভাবিক দাম। অনেকে বাড়ির আসবাবপত্র, সোনাদানা বিক্রি করে জল কিনছেন। ভাবা যায়! শক্তিশালী পাম্প দিয়েও আর নীচের জলস্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জলের অপচয়ের পাশাপাশি জল-ডাকাতিও বন্ধ না করা গেলে আগামী দিন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে।
ঋণ— Churning the Earth: The Making of Global India By Aseem Shrivastava, Ashish Kothari
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy