Advertisement
E-Paper

এমন নাটক এ যুগেই সম্ভব

উপনিষদ থেকে শুরু করে চরক সংহিতা ছুঁয়ে, পঞ্চ সতীকে স্মরণ করে, গীতা-কোরান-বাইবেলের পাতা উল্টে, কেইনসকে স্পর্শ করে, রিচার্ড থেলারকে আলিঙ্গন করে মোদ্দা কথা যা বলা হল তা হল বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

প্রতীপ কুমার দত্ত

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০১৯ ০০:০৫
Share
Save

সাম্প্রতিক কালে নতুন একটি অর্থনৈতিক মিথ্যাচার প্রকাশিত হয়েছে— আগামী পাঁচ বছরে ভারতীয় অর্থনীতিকে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে দেওয়ার মিথ্যাচার। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় চোখ বোলাচ্ছিলাম। কেননা আগামী পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা সঙ্কটের পূর্বাভাস এখান থেকেই পাওয়া সম্ভব। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থনীতির এমন বৃদ্ধির কোন সম্ভাবনা বা পথপ্রদর্শন বিস্তর খুঁজেও পেলাম না।

অবশ্য যা লেখা আছে তার ব্যাপ্তি বিশাল। উপনিষদ থেকে শুরু করে চরক সংহিতা ছুঁয়ে, পঞ্চ সতীকে স্মরণ করে, গীতা-কোরান-বাইবেলের পাতা উল্টে, কেইনসকে স্পর্শ করে, রিচার্ড থেলারকে আলিঙ্গন করে মোদ্দা কথা যা বলা হল তা হল বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে, না হলে ভারতীয় অর্থনীতির ৫ লক্ষ কোটির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনোর আর কোনও রাস্তা নেই! বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়লেই আসবে ‘ইকনমিক গ্রোথ’ নামক মিডাসের ছোঁয়া, স্বপ্নের উড়ানে চেপে ভারতীয় অর্থনীতি কয়েক বছরের মধ্যেই চিনকে ছাপিয়ে ধাওয়া করবে আমেরিকাকে! আমি সাধারণ মানুষ, নিতান্তই মধ্যমানের অর্থনীতির ছাত্র। পড়াশোনার এত বিশাল ব্যাপ্তি আমার নেই। তাই ছোটবেলায় পড়া পাঠ্যবইয়ের মধ্যে থেকেই সব কিছুর উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করি। সেটা করতে গিয়ে, আইআইএম-এর প্রাক্তনী, মাননীয় উপদেষ্টা সমীক্ষায় যা বললেন, তা খুঁজে পেলাম আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্তরের বইয়ের প্রথম অধ্যায়েই!

ম্যাক্রো ইকনমিকস-এর প্রথাগত আলোচনা শুরু হয় দেশের পরিবারক্ষেত্রের সঙ্গে সেই দেশের উৎপাদনক্ষেত্রের মধ্যে আয়ের এক রকমের বৃত্তাকার প্রবাহ আছে ধরে নিয়ে। বলা হয়, উৎপাদনক্ষেত্র শ্রম, জমি ইত্যাদি উৎপাদন-উপকরণগুলি পরিবার থেকে নেয়, বিনিময়ে পরিবারকে মজুরি, খাজনা ইত্যাদি দেয়। আবার মজুরি, খাজনা ইত্যাদি থেকে পাওয়া অর্থ পরিবারগুলি উৎপাদনক্ষেত্রে ফিরিয়ে দেয় এবং তার বিনিময়ে কেনে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য ও সেবা। আর তাই, বিনিয়োগের হাত ধরে উৎপাদনক্ষেত্রের আকার বাড়লে শ্রম-সহ নানান উপকরণের নিয়োগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারক্ষেত্র সমৃদ্ধ হওয়ার কথা, অন্তত মূলধারার অর্থনৈতিক তত্ত্বের শুরুটা সেই কথাই বলে। মনে করা হয়, উৎপাদনক্ষেত্র বাড়লে পরিবারক্ষেত্রের সব অংশের মানুষই সেই প্রক্রিয়ায় শামিল হবে; ফলে জনসাধারণের কাজ ও আয়েরও সংস্থান হবে। বাজার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে লাভের গুড় চুঁইয়ে পড়বে সর্বস্তরের মানুষের হাতেও। তাই বোধ হয় আর্থিক বৃদ্ধির হার সমীক্ষার পাতায় পাতায় এত গুরুত্ব পেয়েছে। নতুন আর্থিক নীতি, উদারীকরণ ইত্যাদির কল্যাণে নব্বইয়ের দশক থেকেই উৎপাদনক্ষেত্রের প্রায় পুরোটাকেই বেসরকারি করে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে, শুরু হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ আবাহনের কাজ। তাই অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ভারতীয় অর্থনীতির রোগমুক্তির জন্য যে প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়েছে, তা হল বেসরকারি বিনিয়োগ, বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রেসক্রিপশন।

কিন্তু উৎপাদনক্ষেত্রের বৃদ্ধি হলেই যে পরিবারক্ষেত্রের মধ্যে থাকা শ্রমিকের কাজের সুযোগ বাড়বে এমন নিশ্চয়তা কোথায়? এই প্রশ্ন উঠছে কারণ এই মুহূর্তে শুধু আর্থিক বৃদ্ধি নয়, অর্থনীতিতে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত। তথ্যগত ভাবে প্রমাণিত সত্য এটাই যে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির যা চরিত্র, তা কাজের সুযোগ তৈরি করছে না। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৯ সাল আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৮%, কাজের সুযোগ বেড়েছিল ১% হারে; ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল অর্থনীতি বাড়ছে ৫.৭% হারে আর কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে মাত্র ২.৮% হারে; ২০০৪ থেকে ২০০৯ এই দুই হারের প্রথমটা ৮.৭% আর দ্বিতীয়টা মাত্র ০.১%; ২০০৯ থেকে ২০১১ প্রথমটা ৭.৪% আর দ্বিতীয়টা ১.৪%; ২০১১ থেকে ২০১৫ প্রথমটা ৬.৮% আর দ্বিতীয়টা ০.৬%।

আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় হল, এই ধরনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রভাব যে শুধু কাজের বাজারে দেখা যাচ্ছে না তা-ই নয়, এ বৃদ্ধির চরিত্র এমনই যে, কায়িক পরিশ্রম করেন, এমন শ্রমিকের প্রকৃত আয়ও দীর্ঘ দিন ধরেই সে ভাবে বাড়াচ্ছে না। ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০১৫-১৬ এই ১৮/১৯ বছরে এ রকম শ্রমিকের প্রকৃত আয় বেড়েছে মাত্র ১০% এর মতো। পাশাপাশি আর একটা হিসেব বলছে ২০১২ সালে মাত্র ১% ধনী ব্যক্তি বা পরিবারের হাতে ভারতের মোট সম্পদের ২৮% ছিল, যা ১৯৯১ সালের তুলনায় ১১% বেশি। পাশাপাশি এই দুটো তথ্য রাখলেই বোঝা যাচ্ছে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি আসলে কাদের ফুলে ফেঁপে ওঠার বাস্তবতা!

আগামী পাঁচ বছরে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা সন্দেহাতীত ভাবে আর একটি বড় জুমলা। কিন্তু যদি ধরেও নেওয়া যায় যে বার্ষিক আট, নয় বা দশ শতাংশ হারে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটিয়ে ভারতীয় অর্থনীতি লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে গেল, তাতেও আম জনতার খুব বেশি অবস্থান্তরের সম্ভাবনা কম। কারণ নব্বইয়ের দশক থেকে আজ অবধি কোনও কালেই আর্থিক বৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষের কাছে সম্মানজনক কাজের সুযোগকে নিয়ে আসেনি। ব্রিফকেস ছেড়ে লাল শালু জড়িয়ে বাজেট নথিকে সংসদে পেশ করে পশ্চিমি দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার ডাক দিয়ে পশ্চিমি বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো— এমন নাটক এ যুগেই সম্ভব।

Indian Economy GDP Five trillion Economy Economic Survey

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।