১৯২৮ সালে মোতিলাল নেহরু কমিটি ঘোষণা করে— “কোনও প্রদেশ যদি নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে চায় এবং প্রতিদিনের কাজকর্ম নিজের ভাষার মাধ্যমে করতে চায়, তা হলে তাকে ভাষা-অঞ্চল হয়ে উঠতেই হবে।” এই কমিটিতে ছিলেন তাঁর ছেলে জওহরলালও, ভারতের ভাষাগত বৈচিত্রকে অনস্বীকার্য মনে করতেন তিনিও। ১৯৩৭ সালে জওহরলাল নেহরু লিখছেন, “আমাদের মহান প্রাদেশিক ভাষাগুলো কোনও উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা নয়, অনেকে না বুঝে সে ভাবে চিহ্নিত করেন...নিজের ভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে জনগণ বেড়ে উঠতে পারে, এ কথা স্বতঃসিদ্ধ।” সে সময় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলিও ব্রিটিশ প্রদেশ বিভাগের বদলে ভাষার ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছিল। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ বা উৎকল।
তবে স্বাধীনতার আগে ভাষাভিত্তিক রাজ্যভাগে সর্বসম্মত কংগ্রেস নেতারা, স্বাধীনতার পর উল্টো কথাই বলতে থাকেন। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যার উদ্ভব, কাশ্মীর সঙ্কটের জন্ম, করদ রাজ্যগুলোকে একত্রিত করা ইত্যাদি অনেক অভূতপূর্ব বিপদের মুখোমুখি হয় ভারত। সে সব বাদ দিয়ে ভাষাভিত্তিক রাজ্যভাগকে অগ্রাধিকার দিতে চাননি প্রশাসকবর্গ। আর নেহরু? মত পাল্টে যায় তাঁরও। তিনি বলেন যে ‘দেশভাগের ফলে এক কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে’ এবং ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা সামনে চলে এসেছে’, অতএব ‘ভারতের সুরক্ষা ও স্থিতিশীলতা’য় জোর দিতে হবে। কিন্তু তার পরও ১৯৫৬ সালে ভাষার ভিত্তিতেই প্রদেশগুলো ভাগ হয়। যে কোনও কিছুতে নেহরুকে দোষারোপ করা এখন ফ্যাশন। এই ‘দ্বিচারিতা’কেও সেই তালিকায় জুড়ে দিতে বাধা নেই, তবে তৎকালীন পরিস্থিতি বিচার করে নেওয়া যেতেই পারে।
১৯৪৯ সালের শেষে দিকে ভারতের সরকারি ভাষা নিয়ে গণপরিষদের বিতর্কে ভারতীয় ভাষাগুলির আধুনিকীকরণের প্রস্তাব ওঠে। সেখানেই অন্য সব ভাষার চেয়ে কোনও কোনও ভাষা এগিয়ে যায়, কেননা ভারত ‘এক সংস্কৃতির দেশ’ এই বিশ্বাস অনেকের মনের গভীরেই বাস করত। ঠিক সেই মতে বিশ্বাসী না হলেও, ‘আমরা সবাই এখানে... ভারতের একতা প্রচার করতে চাই’ বলেছিলেন নেহরু, কাজেই ভারতীয় সংহতি নির্মাণে বহুভাষিকতা ‘অযোগ্য’ বলে বিবেচিত হয়। এর পরেও যে সংবিধান রচিত হয়, তাতে কিন্তু কোনও এক বা একাধিক ভাষার প্রতি নাগরিকদের আনুগত্যের কথা বলা হল না। ভারতকে জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে এক ভাষা জরুরি— বলল না আমাদের সংবিধান। নেহরু আসলে মত পাল্টাননি, ভাষাভিত্তিক রাজ্যভাগের কাজটা পিছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর মনে হয় যে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে শক্তিশালী হয়ে নিজেকে জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এক, দেশভাগের ফলে পাকিস্তানের কাছে প্রচুর উর্বর জমি হারানো; দুই, সেই তুলনায় যথেষ্ট জনসংখ্যা প্রতিবেশী দেশে না যাওয়া; এবং তিন, আচমকা গাঁধীজি-হত্যা— বাস্তববাদী নেহরু ভেবেছিলেন যে এই সময় রাজ্যভাগ করলে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা আরও মাথা চাড়া দেবে। সম্ভবত, বাস্তব ও বিশ্বাসের সংঘর্ষে তাঁর মধ্যে এক দোলাচল তৈরি হয়।
কেমন সেই দোলাচল? আদর্শগত ভাবে জাতিরাষ্ট্র গঠনে এক ভাষার কথা বিশ্বাস করলেও সমসাময়িক ভারতের চরিত্র ও চাহিদার কথা মাথায় রেখে নিেজ হাতেই বহুভাষিক দেশ গঠনের পথ তৈরি করেছিলেন নেহরু। ১৯৪৮ সালে গণপরিষদের খসড়া কমিটি নিযুক্ত দার কমিশন প্রস্তাব করে, প্রদেশগুলি ভাগ হোক প্রশাসনিক স্বাচ্ছন্দ্য অনুসারে, ভাষার হিসেবে নয়। প্রতিবাদে দেশ জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। তেলুগুভাষীদের জন্য আলাদা অন্ধ্র রাজ্যের দাবি করে অনশনে বসেন গাঁধীজির শিষ্য পোট্টি শ্রীরামালু। ১৯৫২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হলে তেলুগুভাষী অন্ধ্রবাসীদের মধ্যে ঝড় ওঠে, এবং কার্যত ‘আত্মসমর্পণ’ করেন নেহরু। ১৮ ডিসেম্বর ভারতের প্রথম ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।
আসলে, ভারতীয় প্রদেশগুলির ক্ষমতায়ন নিয়ে নেহরুর যা মত এবং ধারণা ছিল, ঘটনাপ্রবাহের ফলে তা পাল্টাতে শুরু করে। তিনি ভাবতেন, ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের দাবির বুনিয়াদ— জাতিসত্তার পরিচিতির চাহিদা। আলাদা আলাদা এলাকার মানুষের পৃথক ভাষা ও সংস্কৃতির ধারণার ভিত্তিতে সেই চাহিদা তৈরি হয়েছে। তাই, বিচ্ছিন্নতাবাদী ঝোঁক সম্পর্কে সাবধান করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ভারতে রাজ্যগুলির সীমা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ভাষা যদি নির্ণায়ক হয়, তবে তা সরকারের যুক্তরাষ্ট্রীয় গঠনের বৃহত্তর কাঠামোর ভেতরে থেকেই হবে, নয়তো বর্ণ ও ভাষার ভিত্তিতে এক বিপজ্জনক জাতিসত্তা তৈরি হয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি, দেশের সার্বভৌমত্ব ও একতার জন্যই অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর এবং রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী রাজ্য চাইতেন তিনি।
নেহরুর এই ভাবনার সমর্থক ছিলেন বল্লভভাই পটেল। তবে তাঁদের মধ্যে তফাতও ছিল। নেহরু বুঝেছিলেন যে ভাষাভিত্তিক রাজ্যভাগ অনিবার্য, এক বার পিছিয়ে দেওয়া গেলেও এক দিন না এক দিন তা করতেই হবে। সৈয়দ ফজ়ল আলির নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিশন তৈরি হল। ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রিপোর্ট পেশ করে ভাষাভিত্তিক রাজ্যের প্রয়োজনীয়তা মেনে নিল সেই কমিশন। ১৯৫৫-৫৬ সালে ভাষার ভিত্তিতে মহারাষ্ট্র রাজ্য তৈরির পক্ষে রাজ্যসভায় বক্তৃতা করলেন নেহরু। নানা প্রান্তে ভাষা আন্দোলন যত শক্তি পেল, তত তাকে মান্যতা দিলেন নেহরু, বললেন যে ভাষাভিত্তিক রাজ্যভাগ না করতে পারলে ভারতও তুর্কি সাম্রাজ্যের মতোই টুকরো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই সূত্রেই ‘সরকারি ও জাতীয় ভাষা’ (কিংবা ‘রাষ্ট্রীয় ভাষা’) বিতর্ক নেহরুর পক্ষে বিষম হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দি তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল, কেননা ইংরেজি ‘দাসত্বের প্রতীক’ ও মাত্র এক শতাংশের বুলি, কিন্তু তা অন্য ভাষার ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে, তখনও মনে হয়নি। কথা দেন, অহিন্দি অঞ্চলে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া হবে না। তবে অন্য দেশি ভাষার পাশে সংখ্যার জোরে হিন্দির কর্তৃত্ব বিস্তারে তৎপর হন অনেকেই। ১৯৪৯ সালে গণপরিষদে কেবল হিন্দি গৃহীত হয়, অহিন্দিভাষী এলাকাগুলোকে ১৫ বছরের ছাড় দেওয়া হয়। দক্ষিণ ভারতের দাবিদাওয়া নিয়ে চির কালই সংবেদনশীল ছিলেন নেহরু, তাই ১৯৬৩ সালে আইন পাশ করে ওই ১৫ বছরের সময়সীমা তুলে দেওয়া হয়। গোল বাধে দু’বছর পর, তত দিনে প্রধানমন্ত্রীর আসনে কড়া হিন্দিপন্থী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। নেহরু বলেছিলেন, ১৯৬৫’র পরেও হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে রাখা ‘যেতে পারে’। ‘যেতে পারে’ বলতে নেহরু বুঝেছিলেন ‘যাবে’, আর অন্যরা বুঝেছিলেন ‘না-ও যেতে পারে’। গণ-আন্দোলনের চাপে শেষ অবধি নেহরুর আশ্বাসকে মান্যতা দেন শাস্ত্রী।
নেহরুর এই দোলাচলের তাৎপর্য অনেক। এক সদ্যোজাত গণতন্ত্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে নিজের মত বাদ দিয়ে প্রকৃত রাষ্ট্রনেতার মতোই গণতান্ত্রিক চাহিদা পূরণ করতে হয়েছিল। নিজের মতের বিরুদ্ধে হায়দরাবাদকে নবগঠিত অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার পর তাঁর মন্তব্য— “পরিস্থিতি আমার পক্ষে অত্যধিক কঠিন হয়ে পড়েছে। আমি তা মেনে নিচ্ছি।” এক ভাষার মাধ্যমে জাতীয় প্রতীক তৈরি করতে চেয়েছিলেন নেহরু, যেমন আর পাঁচটা আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রে তখন হচ্ছিল, কিন্তু ভারতীয় আত্মার স্বীকৃতি ও বিকাশেও তিনি বদ্ধপরিকর, তাই বহুভাষা সংক্রান্ত একাধিক অপছন্দের দাবিও তিনি মেনেছিলেন। তার ফলেই এমন এক দেশ তৈরি হল যেখানে বহুভাষিকতাই আসলে জাতীয় প্রতীক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy