শরতে জলাশয়ে শালুক বাহার। নিজস্ব চিত্র
আরাধনা বাসের কামালদা জর্দা-পান ছাড়া স্টিয়ারিং ধরতেন না। মনে হত গাড়ি তাঁর ধর্মস্থান, মনে হতো গাড়ি তাঁর ভাত-কাপড়ের নিয়ন্তা যেন। আমাদের মতো নিত্যযাত্রীরা তাঁর প্রভু না অনুচর তা নিয়ে অনেক বার ভেবেছি। সে ভাবনার এক একটি পর্দা উড়ে যেতে না যেতেই মফস্সলের বাস ঢুকে পড়ত গাঁয়ের হাটে, ঢুকে পড়ত ধান-জমির অনাবিল এক নিরিবিলি পাড়ায়।
সে বার ছিল সমাপতনের বছর, সে বার ইদ ও পুজো পিঠোপিঠি দুই ভাই-বোনের মতো হাত ধরে এসেছিল। ছুটি শুরুর দিন সকালে স্কুলের রেওয়াজ আছে। তাই আমরাও সাতসকালে কামালের সঙ্গী হয়েছিলাম। আমরা ঠিক তাঁর জীবিকা-যাপনের সঙ্গী হইনি সে দিন, আমরা সঙ্গী হয়েছিলাম তাঁর এক অতি-চেতন অভিযাত্রার। কথাবার্তার ফাঁক ফোকরে ঢুকে পড়ছিল কিছু নিত্যক্রিয়া। দেখলাম একজন সৎ ও হাসিখুসি মুসলমান অবলীলায় উইন্ডস্ক্রিনের গা ঘেঁষে রাখা লক্ষ্মী, গণেশ ও দুর্গা প্রতিমার ফুল বদলে দিচ্ছেন। দেখলাম বাসি ফুলের মায়া কী ভাবে টাটকা ফুলের সৌহার্দ্য দিয়ে পৌরাণিক করে তোলা যায়!
আসলে আরাধনা বাসের কামালদা কোনও নির্দিষ্ট নাম নয়, উৎসব ও সম্প্রীতি এ দেশের প্রত্যেক জনকেই খুব গোপনে মানুষ হয়ে ওঠার পাঠ দেয়! আমার এক বন্ধু, হাওড়ার অশোক যেমন দিল্লির একটি মসজিদ-পাড়ায় জরির টুপি বিক্রি করেন। জরির কাজ পেশা তাঁর। শুনেছি স্নান সেরে শুদ্ধ মনে সেই চালু মহল্লায় অশোক দোকান লাগান। নমাজ তাঁর আচরণ না হলেও নমাজিদের খিদমৎ তাঁর কাছে জীবিকার চেয়েও পবিত্র ধর্ম। এই কামাল, এই অশোকদের পুঁথি-পড়া শিক্ষায় গরিবি থাকে। সংসার আগলে রাখার তাগিদে দলিল-দস্তাবেজ ঠিক মতো বুঝে নেওয়ার অথবা আগলে রাখার ফুরসত মেলে না তাঁদের। ফলে ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন’ তাঁদের গায়ে বিছুটির মতো লাগে। বনেদি কন্যের কান থেকে দুটো পাশা বা ঝুমকো খুলে রাখলে যেমন দেহভার খানিকটা লাঘব হয়, কামাল বা অশোকদেরও যদি খুলে রাখি আমরা...। হ্যাঁ, দেশের জনভার লাঘব হবে কিঞ্চিৎ। তবে সংবিধানে লেখা অদৃশ্য-বাস্তুতন্ত্রের মায়ায় কোথাও যেন বন্যা-খরা-ভূমিকম্পের স্বাদ লেগে থাকবে। জিহ্বার সে স্বাদ হবে ভারসাম্যহীনতার। সে স্বাদ অনেকটা জ্বরপীড়িত অ্যান্টিবায়োটিক পরিষেবার মতো। তাই এই শারদবেলায়, দুর্গাপুজোর আবহে চিন্তকদের পায়ে ফুল রাখি, দেখো কোথাও যেন অনিচ্ছাকৃত ভুল না হয়ে যায়। সৎ কোনও জীবন-চর্যায় যেন ছুরির দাগ লেগে না যায়।
শরৎবেলায় আমার এ রকম হবেই। প্রত্যেক বছর মনে হবে যেন নিঃসীম দিগন্তের গায়ে আমি একা, যেন কাশবনের অলীক দোলাচলে অপু-দুর্গার ওই দৌড়ে চলে যাওয়ার অনেক পিছনে এই তো আমিও আছি। শরৎবেলার প্রতিটি ভোরের অদ্ভুত এক গন্ধ পেয়ে বসে আমাকে! মনে হয়, এ বুঝি আমার একার সময়। কিন্তু আসলে তা নয়, ভিতু-ভেতো-বাংলাভাষী প্রত্যেকের কাছেই এ এক অপাপবিদ্ধ ঋতুকাল।
ধুমের মধ্যেই এক দিন দেখলাম, নরম পানীয়ের ভাঙা বোতলে গত বছর যে কাশবন লাগিয়েছিলাম, এ বছর সেখানে সাদা হয়ে ফুটে আছে আহ্লাদ। আলো হয়ে আছে জানলায় লেগে থাকা এক চিলতে বারান্দা। যেন এক টুকরো শরৎকাল মশারি তুলে কানে কানে এসে বলছে, দূষণ-টুষণ ছেঁদো কথা গো। এই দেখ, তোমাদের কল্পিত গ্লোবাল ওয়ার্মিং, তোমাদের বানানো জলকষ্ট আর প্লাস্টিক-ভয় উপেক্ষা করে আমি তোমাদের ছেঁড়া মেঘ উপহার দিলাম!
ঘুম ভেঙে ভাবলাম, সত্যিই তো, আমার মাথার প্রত্যেক চুলেই যেন কাশফুলের এক একটি স্টিক! আসলে এ সেই শারদবেলা। প্রকৃতির মায়াটানে মা দুর্গা শুধু এসে হাজির হন এমনটা নয়, এই শরৎ যেন আমাদের হাজারও কৃত্রিমতাকে অবলীলায় পরাস্ত করে। সে আসলে আমাদের মেকি বাহুল্যকে চোখে আঙুল দিয়ে পাঠদান করে। বলে, প্রকৃতিকে তোমরা হারাতে পার না। তা সম্ভব নয়। তোমাদের ভাবনা মেকি, চিন্তা চটুল। তোমরা কর্মশালায় ‘পেপার’ পড়ে বল প্লাস্টিক ব্যবহার ক্ষতিকর, তোমাদের আইনে প্লাস্টিক ব্যবহারকারীর জেল ও জরিমানা থাকে, তোমরা স্কুলে পড়াও প্লাস্টিক বায়োডিগ্রেডেবল নয়, তাই অবিলম্বে তার ব্যবহার ছাড়তে হবে।
কিন্তু অবাক বিস্ময়, প্রকৃতিসেবী থেকে ফেসবুকিস, আমলা থেকে রাজনৈতিক কেউ প্লাস্টিক কারখানা বন্ধের কথা মাথায় আনো না! এই শরতে দেশ-চিন্তকদের পায়ে আবারও ফুল রাখি, বলি, অনুগ্রহ করে অহেতুক ভ্রান্তির ডানায় বায়ু ভরবেন না। ওই দেখুন, আমার ভাঙা প্লাস্টিক বোতলের কোল আলো করে কাশ ফুটে আছে। আচ্ছা শরতের কি কোনও ভাষা আছে? সে-ও কি সঙ্কেত রাখে পরা ও বাস্তবতার মাঝখানে? নাকি সে-ও হিন্দিতেই কথা বলে! এ বছর সেটাও বুঝে নিতে চাই। বুঝে নিতে চাই, শরতের ভাষা আসলে কী। ভোরে হালকা চাদর লাগে, বেশ লাগে। নিশীথে মাথার উপর চাঁদ-বুড়ির গান শুনতে পাই, ‘আরও চাই’।
চারটি ছাত্র পড়িয়ে দিনান্তে যখন বাড়ি ফিরি, তখন মনে হয় দিনের তাপভারে যতটা ক্লান্ত হয়েছ তুমি, কাশবন, এ বার তা শুষে নেবে রাতের কুহেলিকা। কিন্তু কী ভাষায় পরীক্ষা নেব তার। ভাবি, পিতা নাকি মাতা কে প্রকৃত ভাষার প্রদাতা! ভাবি, ভাষা কি আবেগ নাকি সে আসলে কাজের উপকরণ?
তবে কেনই বা ভাষা নিয়ে এতো দলাদলি, চাপানউতোর। শেষমেশ ঠাওর করতে পারি না যখন, তখন মনে হয়, ভাষা আসে মায়ের দেহ থেকে। মা যে প্রথম শিক্ষক! তাই তো দেশ ‘মা’ আমাদের। পূজনীয়া সে। অভাষা চাপিয়ে দেওয়া কাজ নয় তার। আজ এই উত্তর-কলির শারদ উৎসবে ভাষাসুর হয়তো নতুন কোনও কাঠামো। আমাদের বিশ্বাস মণ্ডপে মণ্ডপে এককাঠি অস্ত্রে মা তাকে প্রতিহত করবেই করবে। তাই দেশ-দেবতাদের পায়ে শেষতক ফুল রাখি, বলি, সুবিচার ছাড়া কিছুই চাই না। বলি, পূজনীয়া দেশ আমার, শারদবেলায় প্রীতি জেনো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy