প্রকৃত প্রশ্ন— নাগরিকের সাইবার নিরাপত্তা কি সরকারের নিকট যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা, দেশের প্রতিরক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ও নাগরিক শৃঙ্খলার প্রতি ক্ষতিকারক, এই অভিযোগে ৫৯টি চিনা অ্যাপকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল কেন্দ্রীয় সরকার। জানাইল, এই অ্যাপগুলি অবৈধ উপায়ে ভারতীয় ব্যবহারকারীদের তথ্য চুরি করিতেছিল এবং সেই তথ্য পাচার হইতেছিল বিদেশে। অভিযোগটির গুরুত্ব বিপুল— নিষিদ্ধ হওয়া টিকটক বা ক্যামস্ক্যানারের ন্যায় অ্যাপের নিকট ভারতীয় বাজার যতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাহার তুলনায় ঢের বেশি। আশা করা চলে, এই অভিযোগ অবিবেচনাপ্রসূত নহে— স্লোগান দেওয়ার ‘অপরাধে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করিবার ন্যায় অতিপ্রতিক্রিয়াও নহে। কেন্দ্রীয় সরকার যখন এত স্পষ্ট ভাবে ৫৯টি অ্যাপের বিরুদ্ধে অভিযোগ করিয়াছে, ধরিয়া লওয়া যায় যে তাহাতে সারবত্তা আছে। সেই পরিস্থিতিতে একাধিক প্রশ্ন তীব্র হইয়া উঠে। প্রথমত, অ্যাপগুলি এই জুন মাসে ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করে নাই— কোনওটি তিন বৎসর আছে, কোনওটি আরও বেশি সময়কাল। চিনের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির উপর যে সে দেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণ কড়া, এবং সরকার চাহিলে সংস্থাগুলিকে তথ্য ফাঁসে বাধ্য করিতে পারে, এই কথাটি জানা থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার অ্যাপগুলিকে ছাড়পত্র দিল কেন? বিশেষত, যেখানে জানাই আছে যে অ্যাপগুলির নিকট গ্রাহকদের তথ্যভান্ডার উন্মুক্ত হইবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, ৫৯টি অ্যাপের বিরুদ্ধে একটি অস্পষ্ট অভিযোগ না করিয়া প্রতিটি অ্যাপের বিরুদ্ধে পৃথক ভাবে অভিযোগ জানানো হইল না কেন? তাহাতে প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতা বজায় থাকিত। দেশের গ্রাহকরাও বুঝিতে পারিতেন যে তাঁহাদের কোন ধরনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হইতেছিল।
প্রশ্নগুলির প্রেক্ষিতে অ্যাপ নিষিদ্ধ করিবার সিদ্ধান্তটি দেখিলে আশঙ্কা হয়, নাগরিকের তথ্যের নিরাপত্তা রক্ষা করিবার ছলে সরকার গালওয়ান উপত্যকায় সম্মানহানির ক্ষতি পূরণ করিতে চাহিতেছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে নহে, দেশের রাজনীতির পরিসরে। যে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিনের দখলে থাকা আকসাই চিনের জমি পুনরুদ্ধার করিতে জান কবুল করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, সেই সরকারই সীমান্তে নূতন জমি ছাড়িতে বাধ্য হইল। তাই কি ছাতির মাপের সম্মানরক্ষার্থে ‘ম্যাপের বদলা অ্যাপ’ নীতি? কূটনীতির চ্যালেঞ্জের সামনে পড়িয়া অকস্মাৎ অভ্যন্তরীণ নাগরিক নিরাপত্তার কথা মাথায় উদয় হওয়া এবং এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ করা? সমগ্র প্রক্রিয়ার মধ্যে তাই একটি সুগভীর উদ্বেগের কারণ থাকিয়া যাইতেছে। কেবল ভারত কেন, যে কোনও দেশেই কূটনীতিকে ঘরোয়া রাজনীতি বা অর্থনীতির হাতিয়ার বানাইলে তাহা সে দেশের বিপদই বাড়াইয়া তোলে।
প্রকৃত প্রশ্ন— নাগরিকের সাইবার নিরাপত্তা কি সরকারের নিকট যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ? বর্তমানে মোবাইল ফোন বস্তুটি দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর প্রাণভ্রমরে পরিণত হইয়াছে। ওই ছয় ইঞ্চিতেই তাহাদের যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য, আর্থিক নথি, এমনকি পরিচয় প্রমাণের পদ্ধতিও ভরিয়া রাখা আছে। অথচ সেই তথ্যভান্ডার সুরক্ষিত করিবার উপায় নাগরিকের হাতে সম্পূর্ণ ভাবে নাই। সেই উপায় ও দায়িত্ব সরকারের হাতে। কোন অ্যাপ কতখানি তথ্য সংগ্রহ করিতেছে, তাহার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, তথ্য কোথায় যাইতেছে, এই নজরদারি কি এ দেশে নিয়মিত ভাবে চলে? না কি তাহা আবির্ভূত হয় কেবল যুদ্ধ-পরিস্থিতির উদ্ভব হইলে? প্রসঙ্গত আর একটি কথা— প্রয়োজনের অধিক তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ কিন্তু আরোগ্য সেতু অ্যাপের বিরুদ্ধেও প্রবল। দেশের সরকার এবং বিদেশের সরকারের মধ্যে কোনও তুলনাই চলে না, তবু ব্যক্তিপরিসরের স্বাধীনতার প্রশ্নটি এই ক্ষেত্রেও থাকিয়া যায় বইকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy