ইতিহাস নিয়ে মানুষের মনে নানা ভয়। ছোটবেলা থেকে শুনেছি, ইতিহাস শুধু ‘মুখস্থ’ করতে হয়, আর ইতিহাস নাকি ‘বানিয়ে লেখা’ খুব সহজ। ছোটবেলায় শোনা কথা থেকেই আসলে বিপদ শুরু।
আমরা ইতিহাস বিমুখ, যে যেমন ইতিহাস বানিয়ে পরিবেশন করেন, মনে ধরলেই তাকেই ধারণ করি, আর সত্যাসত্য বিচার করি না। সারা দেশে CAA বা NRC নিয়ে যা চলছে, তা নিয়ে কিছু বলার থেকেও এর সঙ্গে যুক্ত কিছু অন্য মানবিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আজ আমি আপনাদের শরণাপন্ন। আমার এক মুসলিম বন্ধুর ছোট ছেলে কলকাতার এক নামী স্কুলে পড়ে, তাকে অন্য বাচ্চারা ‘পাকিস্তানি’ বলে বিরক্ত করে। এমন কথা মাঝে মধ্যে শোনা যায় অবশ্য। তা হলে কি আমরা শিক্ষিত হচ্ছি কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা ভুলে সামনের দিকে না এগিয়ে পিছনের দিকে যাচ্ছি? আজকাল আবার নতুন করে লোকে মুসলিম দেখলে ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘বাংলাদেশি’, ‘লুঙ্গি বাহিনী’ আরও কত কি বলে আওয়াজ দিচ্ছেন। আইন তো আইনের জায়গায়, কিন্তু আইন প্রয়োগের আগেই আমরা নিজেরাই যাদের সঙ্গে এত দিন একসঙ্গে বাস করছি, তাদের গায়ে কী ভাবে বিভিন্ন অপমানজনক তকমা এঁটে দিচ্ছি?
সব মুসলিম অনুপ্রবেশকারী, বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি নন, অন্তত ইতিহাস তাই বলে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারতবর্ষের বেশ কিছু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। সেই সময় সারা ভারতের মোট মুসলমানের এক তৃতীয়াংশের বাস ছিল পশ্চিম বাংলায়। র্যাডক্লিফ যখন ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত নির্ধারণ করেন, তখন পশ্চিম বাংলায় প্রায় ৫০ লক্ষেরও বেশি মুসলমান অন্তর্ভুক্ত হন। এর ফলে দুই দেশের সীমান্ত রেখা বরাবর বসবাসকারী মানুষ একাধিক জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
যুগে যুগে বিদেশীরা ভারতে এসেছেন, জয় করেছেন, মিশে গেছেন ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে। তেমনই ১২০৩ ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি বাংলায় সৈন্য নিয়ে প্রবেশ করলেন, বাংলা তথা উত্তর ভারতে (১২০৬) সূচনা ঘটল তুর্কি শাসনের। তুর্কিদের পথ ধরেই বাংলায় এলেন আরব, পারস্য, অ্যাবিসিনিয়ার অভিজাত, বণিক, সাধক প্রমুখ। এরপর মুঘল সম্রাটদের বাংলা জয়ের পর ইসলাম ধর্ম বাংলার নদী বিধৌত অঞ্চলে আরো গভীর ভাবে প্রসারিত হয়। এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের মূল ঘাঁটি কলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলে এখানেও মুসলিমদের আধিক্য দেখা দেয়। কলকাতা নগরী যখন সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র সারা দেশ থেকে কত মানুষ কাজের সন্ধানে আসেন এই অঞ্চলে, এদের মধ্যে মুসলমান অভিজাত, বণিক, কারিগর, শিল্পী, দর্জি, এছাড়া কসাই, রাঁধুনি, মিস্ত্রি এবং আরও অন্যান্যরা ছিলেন, যারা এসে কলকাতা নগরীকে আরও গতিময় করলেন। আবার নদীর পাশে গ্রামগুলিতে যেখানে ধান চাষ হত সেখানে মুসলিম কৃষকের সংখ্যা ছিল বেশি, যাদের ঘামে ফসল শ্যামল হল।
বাংলায় বাস করা মুসলিম সমাজেও সিয়া-সুন্নি, উচ্চ-নিচের ভেদাভেদ ছিল। আবার ভাষা-ব্যবহারেও ছিল পার্থক্য। অভিজাত মুসলমান পরিবারে ফার্সি-উর্দু বলার চল ছিল আর অন্যান্য ধর্মান্তরিতদের কথ্য ভাষা বাংলা, কিন্তু তাতে আঞ্চলিক টানের প্রভাব ছিল। তাই সব ক্ষেত্রে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠেনি। এর প্রভাব পরবর্তী কালে রাজনীতিতে পড়ে ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানের আন্তরিক সম্পর্ক দেখা গিয়েছিল। বাংলায় বহু দিন হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি বাস করেছেন, একটা সম্মিলিত সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন, হয়ে উঠেছেন ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’। উনিশশতকে ইংরেজদের আনুকূল্যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বহু বাঙালি অভিজাত পরিবার কোনও না কোনও উপায়ে নবাবী সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। ১৮৩৫ পর্যন্ত ফার্সি বাংলা তথা ভারতের সরকারি ভাষা রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলা শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয় ফার্সি, উর্দু শব্দে; বাংলায় মুসলমান দর্জির সেলাই করা জামা কাপড় জনপ্রিয় হল, হিন্দু সমাজে কিন্তু সেলাই না করা কাপড় পরার বিশেষ রেওয়াজ ছিল। এ ছাড়াও মোগলাই, বিরিয়ানি আরও বহু খাবার, যা আজও বাঙালির রসনাকে জয় করে রেখেছে, তাও নিয়ে এসেছিলেন মুসলিমরাই। আর সঙ্গীত শিল্পে তাদের অবদানও ভোলার নয়।
ভারতবর্ষ এক মিশ্র সংস্কৃতির আকর, ‘মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ’। কিন্তু ইংরেজ তার সাম্রাজ্যবাদী লালসা তৃপ্ত করতে হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করা প্রয়োজন, তা বুঝেছিলেন। তারা খুব নিপুণভাবে ধর্মকে সামনে রেখে যে আগুন লাগালেন, তাতে সারা দেশ ধর্ম-সম্প্রদায় নিয়ে বিভাজনের দাবানলে পুড়ে ছারখার হল, শুরু হল দাঙ্গা, রক্তাক্ত হল মাটি। ১৯৪৭ এ দেশ বিভক্ত হল, দেশভাগের আকস্মিকতা সব মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। অনেক হিন্দু যেমন ভিটেমাটি ছাড়া হলেন, তেমনই মুসলমানরাও। ১৯৫১ সালে পশ্চিমবাংলার জনগণনার তথ্যানুসারে কত মুসলমান দেশ ছাড়া হলেন তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও পাকিস্তান সরকার দেওয়া ১৯৫১‘র জনগণনার তথ্যানুসারে ৪৮৬,০০০ জন মুসলমান ‘মুহাজির’ এই দেশত্যাগ করে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপরও লাখে লাখে হিন্দু-মুসলিমের আসা যাওয়া অব্যহত ছিল। হিন্দুদের যেমন কষ্ট হয়েছিল, নিজের জায়গা ছেড়ে আসতে, তেমনই তৎকালীন পাকিস্তানের বহু মুসলমানের জন্ম হয়েছিল ভাগ হয়ে যাওয়া ভরতের মাটিতেই, নিজের জন্মভূমি ছেড়ে নতুন দেশে মুসলমান উদ্বাস্তুরা বেশিরভাগই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিলেন, অন্যপ্রান্তে হিন্দুরাও সকলে নিষ্ক্রিয় থাকেননি, যা দাঙ্গার রূপ নেয়।
কোনও সরকারই উদ্বাস্তু সমস্যার ইতিবাচক সমাধান করতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গে হাজার হাজার নমশূদ্র, অন্যান্য ‘নিচুজাতের’ হিন্দু বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন জীবিকা ও আশ্রয়ের আশায়, কিন্তু দাঙ্গা নয় সরকারের গাফিলতি, ভুল সিদ্ধান্ত বা চক্রান্তের শিকার হয়ে প্রাণ দিয়েছেন অজস্র মানুষ। তাই অনেকে যারা মুসলমান দেখলেই ভাবেন ‘অনুপ্রবেশকারী’ তারা নিজেদের ভুলটা সংশোধন করে নিলেই ভাল। আমরা প্রত্যেকে, কোনও না কোনও ভাবে প্রত্যহ রাজনীতির শিকার, আর আমাদের মদতেই রাজনৈতিক দলাদলি, চক্রান্ত আরো ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। ভেবে দেখবেন একবার নিজেদের মধ্যে শত্রুতা না বাড়িয়ে আমরা কি সত্যিই পারিনা ইংরেজরা যে বিভাজনের আগুন লাগিয়েছিলেন তাতে আরো বারুদ না দিয়ে শান্তির শীতল বারি বর্ষাতে?
শিক্ষিকা, ডোমকল গার্লস কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy