ছোটবেলা থেকেই সুন্দরবনের জল হাওয়া খেয়ে বেড়ে ওঠার সুবাদে এই বৃহত্তম বাদাবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভৌগোলিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে বিশদ ভাবে ওয়াকিবহাল। নিজের চোখে পরখ করেছি বিধ্বংসী আয়লা। তার পর সাক্ষী থাকতে হয়েছে ফণী, বুলবুল। এবার সাক্ষী থাকতে হল আগামী দুই শতাব্দীর অন্যতম ভয়ঙ্কর ঘূর্ণীঝড় আমপানের। খুব ধীর গতির কিন্তু বলিষ্ঠ ও পেশিবহুল তার অবয়ব। কী নিষ্ঠুর ভাবে তার তাণ্ডবলীলা চালিয়ে গেল টানা ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ধরে।
এতে অবশ্য আমজনতার পরিবেশ সচেতনতায় কতখানি প্রভাব পড়বে বা আদৌ পড়বে কিনা, তা এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন।
কারণ প্রকৃতির উপর যথেচ্ছাচারের ভয়ানক পরিণতি কী হতে পারে, তা অনেক দিন ধরেই মস্তিষ্কের মধ্যে প্রবেশ করানোর চেষ্টা হয়েছে। তাই এই শিক্ষা দু'দিনেরও নয়,কয়েক মুহূর্তের। আবার মানুষ ভুলে যাবে এবং যেতেই থাকবে। আয়লার স্মৃতি সুন্দরবনবসীর মন থেকে এখনও মুছে যায়নি। এখনও চোখে মেলে তাকালে ভেসে ওঠে চারদিকে ধুধু করা নোনা জল, পুকুরে মরা মাছ। খাল-বিল জলে সব সমান। বাতাসে দীর্ঘশ্বাস নিলে এখনও হয়তো গন্ধ পাওয়া যাবে মৃত গবাদি পশুর। কান্নার রোল শোনা যাবে ঘরহারা মানুষদের। সেই ধাক্কা কোনও রকমে সামলে উঠেছিল তারা। তার পর আবির্ভাব হল ফণীর। দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবনের ধাক্কায় ফণীর ফণা তোলা ব্যর্থ হল সে বার। সেই ব্যর্থতার পর আবার আমপান। নামমাত্র বাঁধে তালিতাপ্পি দিয়ে প্রকৃতির বুদ্ধিমত্তা বিচার করার পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছে।
২০০৯ সালের আয়লায় যখন গোটা সুন্দরবন একবুক জলে ভাসছে তখন কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে ৫০৩২ কোটি টাকার যোজনা কমিশন তৈরি হয় শুধুমাত্র সুন্দরবন দ্বীপের নদীর পাড় কংক্রিটের বেড়া দিয়ে বাঁধানোর জন্য। কাজ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বাম সরকারের পতন হল। তার পর বর্তমান সরকার দায়িত্ব পাওয়ার পর কিছুটা কাজের অগ্রগতি হলেও মাঝপথে জমিজটে আটকে গেল কাজ। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হবে না দেখে কাজের মেয়াদ কিছুটা বাড়ানো হল। অনেক টালবাহানা করে সিদ্ধান্ত হল, ২০১৫ সালের মধ্যে এই প্রোজেক্ট সম্পূর্ণ করার।
আজ ২০২০ সাল, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সুন্দরবনের কিছু নদী বাঁধের জীবন্ত কঙ্কাল চিত্র। কংক্রিটের বেড়া এতোই সূক্ষ্ম যে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না! নদীর বাঁধ বললে হয়তো ভুল বলা হয়। চাষ মাঠের 'আল' সদৃশ্য। নদীর মাছকে একলাফে সে আল টপকাতে দ্বিতীয় বার ভাবতে হবে না। সময়ের মধ্যে কাজ না শেষ হওয়ায় ধার্য্য টাকা ফেরত চলে গিয়েছে। নামমাত্র বেশি ভাঙনপ্রবণ জায়গায় কংক্রিটের বাঁধন পড়লেও অধিকাংশ জায়গায় এই খোলস ছাড়ানো অবস্থায় পড়ে নদীগুলো। কিন্তু তারপর থেকে আবার নতুন করে বাঁধ তৈরি করার সদ্বিচ্ছা কারওর ছিল না। কোনও ভাবে দায়সারা কাজ করতে শুরু হল কংক্রিটের বাঁধের পরিবর্তে বাঁধের উপর সিমেন্টের ঢালাই রাস্তা তৈরি। আর পিচিং-এ পড়ল নদীর কাদা। খুব বেশি হলে মোটা কঞ্চির পাইলিং। এই বাঁধ যে কোনও ঝঞ্ঝা আটকাতে পারবে না, তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও জানত। বাঁধের নির্দিষ্ট উচ্চতা, পিচিং-এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ নির্দিষ্ট মাপের থাকবে। পিচিং ও বাঁধের রাস্তা দুটোই কংক্রিটের বাঁধন হবে এবং স্লুইস গেটগুলোও মেরামতি করলে তবেই শক্তপোক্ত বাঁধ বলা যাবে। কিন্তু স্বল্প দৈর্ঘ্যে তার অস্তিত্ব থাকলেও অধিকাংশ জায়গায় আলগা হয়ে পড়ে আছে। ছোটোমোল্লাখালি, গোসাবা, চণ্ডীপুর, মসজিদবাটি, সোনাখালি, কুলতলি, পাথরপ্রতিমার ও সাগরদ্বীপের কিছু অংশ ইত্যাদি বহু ছোট ছোট দ্বীপ মগুলোর অনেকটাই এখনও শুধুমাত্র মাটির বাঁধে টিকে আছে।
আজ এই বিপর্যয়ে সুন্দবনের সেই উলঙ্গ রূপ সবার সামনে বেরিয়ে পড়েছে। তাই আমরা অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছি। আমপানের ধাক্কা কলকাতার উপর পড়েছে বলে আমরা আজ কপালে ভাঁজ ফেলছি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নদীমাতৃক এলাকাগুলোতে কী ভাবে মাফিয়ারাজ চলে তা আমরা দেখেও মুখ বন্ধ করে ছিলাম। স্থানীয় নেতার ঘরের পাঁচিল না বাথরুম, কোন আত্মীয়ের ঘরের দেওয়াল বা পার্টি অফিসের কোন দেওয়াল কংক্রিট করা হয়নি, সেই চিন্তা নেতারা করে সবার আগে। মালিকপক্ষের থেকে মোটা টাকা নিয়ে নদীর বাঁধ কেটে রাতারাতি গড়ে উঠছে মস্ত বড় মাছের ভেড়ি, ইটভাটা। জনবহুল স্থানে নদীর চড়ের গাছপালা পরিষ্কার করে চারদিকে বাঁধ দিয়ে বসতি গড়ে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ জায়গার থেকে কম দামে মানুষকে লোভ দেখিয়ে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে বিস্তীর্ণ চরগুলো।
ফলস্বরূপ যা হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তাই হচ্ছে। নদীর দুই পারের বাঁধ ধীরে ধীরে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে চলে আসছে। কমছে নাব্যতা, মজছে অসংখ্য জীবন্ত নদী, দুর্বল হচ্ছে বাঁধগুলো। বুকের উপর পলি জমতে জমতে কোন এক বাঁকে গজিয়ে উঠছে বিস্তীর্ণ উঁচু চড়া। হারিয়ে যাচ্ছে নদীর স্বাভাবিক পথ চলা।
বাসন্তী ও গোসাবার মধ্যে হোগল নদীর স্থানে স্থানে গড়ে উঠেছে কবরের ন্যায় উঁচু চড়া। সুন্দরবনে প্রবেশের এই একমাত্র নদীপথ দিয়ে আজ লঞ্চ চলাচল শুধু সীমিত নয়, ঝুঁকিপূর্ণও বটে। নদী তার স্বাভাবিক চলাচলের মধ্যে হিমসিম খাচ্ছে। এত জল বইবে কী ভাবে! তাই ভরা কোটালেও মানুষ বাসন-ঘটি নিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে নিরাপদ স্থানে৷ ওড়িশা বা পুরির সমুদ্র সৈকতে যে ভাবে কংক্রিটের বেড়া দেওয়া হয়েছে সে ভাবে কেন সুন্দরবনকে বাঁধানো যাচ্ছে না? কেন নদীর নিকট ঘরবাড়িগুলো দূরে সরিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে না সরকার? কেন নদীর কাছে বাড়িগুলো আজও মাটির দেওয়াল, খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি? কেন স্থানীয় মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ বলির পাঁঠা হবে? এই প্রশ্নগুলো অনেক আগেই তোলার প্রয়োজন ছিল।
কিছু দিন আগেই চলে গেল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। থিম ছিল 'Celebrating Biodiversity'। আশঙ্কা, সারা বিশ্বে প্রায় এক মিলিয়ন জীবের ভবিষ্যৎ বিপদময়। আমরা কি কোনও দিন সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে চিন্তিত ছিলাম বা আছি? ভারত তথা বিশ্বের সব চেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য হল এই সুন্দরবন। ভারতের মধ্যে শুধুমাত্র বাংলা ও গুজরাটে এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের দেখা মেলে। এই সুন্দরবনেই রয়েছে ভারতের সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্য। একসময় যে সুন্দবনের পরিচয় পাওয়া যেত রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা গাঙ্গেয় ডলফিন বা কুমিরের নাম ধরে, এখন যেন তার পরিচিতি পালটে গেছে। আয়লা, ফণী, বুলবুল আর আমপান যেন সুন্দরবনের নতুন পরিচয়।
সুন্দরবন তো শুধু কয়েক প্রজাতির জীব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বন নয়। সুন্দরবন হল এক প্রাকৃতিক প্রাচীর। ভারতের তিনদিক সমুদ্র দিয়ে ঘেরা। ছোটবেলায় ম্যাপ দেখলে মনে হত, এত বিশাল সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা কেন ভেসে যায় না। পরে জানতে পারলাম প্রকৃতি তার নিজের হাতে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কোথাও দাঁড় করিয়েছে ঘন জঙ্গল, আবার কোথাও দাঁড় করিয়েছে কোরাল বা প্রবাল প্রাচীর। এগুলো সব প্রাকৃতিক সৃষ্ট দেওয়াল। শতকের পর শতক ধরে এই দেওয়াল সহ্য করেছে অনেক ঝঞ্ঝা। আজ শুধু তাণ্ডবের ছাপ শহরের উপর কিছুটা পড়েছে বলে আমরা বেশি চিন্তিত হয়ে উঠেছি। কিন্তু এত দিন আমরা ভাবিনি।
এমন আঘাত সুন্দরবন পেতে পেতে তার স্বাভাবিক জীব বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলছে ক্রমশ। এই জীব বৈচিত্র্য রক্ষা না করতে পারলে এমন দূর্ভোগ ভবিতব্য। নেই নেই করে প্রায় ২৬২৬ প্রজাতির জীব আছে এই বাদাবনে। জীববৈচিত্র্যের আধার এই বনে আছে ৩৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৫৬ প্রাজাতির পাখি,৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১১ প্রজাতির কচ্ছপ ,৩৭ প্রজাতির সাপ, ১৩ প্রজাতির কুমির, ১১ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৭৩ প্রজাতির মোলাস্কা, ৭৫৩ প্রজাতির পতঙ্গ। এছাড়াও আছে কয়েক শত উদ্ভিদ, অ্যালগি,ফাঙ্গি,ব্যাকটেরিয়া,প্রোটোজোয়া ইত্যাদি। তবে এই তথ্য খুব একটা আনন্দের নয়। এদের একটি বড় অংশ চিরতরে বিলীন হয়ে গিয়েছে এবং কিছু অংশ বিলুপ্তির পথে পা বাড়িয়েছে। এখন আমরা গণ্ডার দেখতে ছুটে যাই জলদাপাড়াতে। অথচ আজ থেকে খুব বেশি হলে ২৫০ বছর আগে এই বাদাবন সুন্দরবনেই চরে বেড়াত এক শ্রেণীর গণ্ডার। আমরা তাদের শেষ করে দিয়েছি৷ পরিবেশের গলা টিপে তাদের বসবাস যোগ্য বাসস্থান গড়ে দিতে পারিনি আমরা। আরও হারিয়েছি বুনো মহিষ, পারা হরিণ, বুনো ষাঁড়, চিতা বাঘ। লুপ্ত হয়েছে সাদা মানিক জোড়া, কান ঠুনি, বোঁচা হাঁস, গগন বেড়, জলার তিতির-সহ বিভিন্ন পাখি। আর ভবিষ্যতে আমরা হারাতে চলেছি অন্তত ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী,বহু উদ্ভিদও।
যার নামে এই সুন্দরবন সেই সুন্দরী গাছ আজ হুমকির মুখে। বর্তমানে যতগুলো সুন্দরী গাছে আছে সুন্দরবনে তার অধিকাংশই 'ম্যানমেড' অর্থাৎ কৃত্রিম গাছ বসানো। নদীর জলে লবনাক্ততা, পরিবেশের উষ্ণতা এতই বাড়ছে যে উদ্ভিদের স্বাভাবিক ভাবে জন্মানোর রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কারণ, হিসাবে পরিবেশবিদরা দায়ী করছেন মানুষের অসচেতনতা ও সীমাহীন পরিবেশের উপর যথেচ্ছাচারকে। পরিসংখ্যান বলছে, যা প্রাকৃতিক সম্পদ পরিবেশে আছে তা প্রকৃতির সমগ্র জীবকুলের (মানুষ সহ) জন্য যথেষ্টই। কিন্তু এক দিকে দূষণের ফলে জলজ প্রাণীর জীবনসংকট, অন্য দিকে উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলস্তর বাড়ছে। পক্ষান্তরে নদীর নাব্যতা কমছে। এ ভাবে ধীরে ধীরে জলের তলায় চলে যাচ্ছে সুন্দরবনের ছোট ছোট বদ্বীপগুলো। প্রতিনিয়ত একটু একটু করে কমছে সুন্দরবনের আয়তন।
তেমনই জঙ্গলের ঘনত্ব কমছে, প্রাণীদের খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে। ফলে তাদের স্বাভাবিক চলাচলের মধ্যে হিমসিম খেতে হচ্ছে। পরিবেশ বারবার মানুষকে সতর্ক করার চেষ্টা করছে, কিন্তু মানুষ কবে বুঝবে!বাগদার মিন ধরতে চলে যাচ্ছি মশারী নিয়ে। জালে জড়িয়ে যাচ্ছে আরও কয়েক শত প্রজাতির জলজ জীব। ঝিনুক, শাকুম, কাঁকড়া, ডলফিন বা শুশুক জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। এই বন্যার জলে বহু প্রজাতির প্রাণী গ্রামের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। জল নেমে যাওয়ার পরে সেগুলো গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়বে, নচেৎ মারা যাবে।
এক দিকে কর্মসংস্থানের অভাবে মানুষ প্রকৃতির মাঝে অসম লড়াইয়ে নেমেছে। অন্য দিকে কিছু মানুষ ইচ্ছাকৃত পরিবেশের উপর আঘাত হানছে। দুইয়ে মিলে প্রকৃতি অশান্ত হয়ে উঠছে৷ সঙ্কটে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের। তবে সুন্দরবনের স্থায়ী সমাধানের কথা চিন্তা না করলে মানচিত্র পরিবর্তন হতে বেশি সময় আর বাকি নেই!
চিকিৎসক, কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy