Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Sundarbans

স্বপ্ন দেখব বলে কাজও করব

সুন্দরবনের ধ্বংসের ছবি দেখে এই ক’দিনে আমরা অনেকেই আঁতকে উঠেছি।

আমপান এসে লন্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল অনেক কিছু। আবার শিখিয়েও গেল যে, কারও অপেক্ষায় বসে থেকে লাভ নেই।

আমপান এসে লন্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল অনেক কিছু। আবার শিখিয়েও গেল যে, কারও অপেক্ষায় বসে থেকে লাভ নেই।

চৈতালি বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

দুনিয়াটা বদলে দেওয়ার স্বপ্ন অনেকেই দেখেন। কিন্তু বদলে দিতে পারেন ক’জন? যাঁরা পারেন, তাঁরা ভাবনার পথটুকু পেরিয়ে কোনও গঠনমূলক কাজ সংগঠিত করে ফেলতে পারেন। ছোট ছোট কাজ করেই বড় দুনিয়াটা বদলাতে পারেন। করোনা-যুগে আমপান-বিধ্বস্ত সুন্দরবন আরও অনেক কিছুর সঙ্গে এটাও ভাল করে শিখিয়ে দিয়ে গেল আমাদের।

সুন্দরবনের ধ্বংসের ছবি দেখে এই ক’দিনে আমরা অনেকেই আঁতকে উঠেছি। খেতে না পাওয়া মানুষ, মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া ঘর, নষ্ট হয়ে যাওয়া চাষ জমি দেখে আমরা যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছি। এও দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়া পেরিয়ে কত মানুষ বলেছেন, চলো ভাই, কাজ করতে হবে! জল, জঙ্গল, সর্বোপরি করোনায় ভয় না পেয়ে তাঁরা মানুষের কাছে ছুটে গিয়েছেন। ভুলে গিয়েছেন, দেশ চালানোর দায়িত্ব প্রশাসকের হাতে, ত্রাণ বাবদ টাকা বরাদ্দ করার ক্ষমতা সরকারের হাতে, ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানার কাজটা ভোটে জেতা জনপ্রতিনিধির। হয়তো তাঁরা এ-ও ভুলে গিয়েছেন, নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার কাজ ছেড়ে সুন্দরবনে ছুটে যাওয়াটা মূর্খামি বই কিছু নয়! অন্তত এমন এক জমানায়। যেখানে কাল চাকরি জুটবে কি না জানা নেই।

এই মানুষরা কি আমাদের কিছু শিখিয়ে গেলেন? নেতাদের ব্যর্থতার সমালোচনা তো করতেই হবে। মার্ক্সবাদ ও ধনতন্ত্রের সংঘাত-তত্ত্বও আলোচনার নতুন উপকরণ জুগিয়ে গিয়েছে কোভিড-যুগে। প্রথাগত পড়াশোনার উপর ভর করে পরিযায়ী শ্রমিক, শরণার্থী সমস্যা নিয়েও ভাবতে হবে। তার সঙ্গে যদি একটু গুরুত্ব দিতে পারি এই সমাজকাজে, হয়তো দুনিয়াটাই একটু একটু করে পাল্টাবে।

আরও পড়ুন: জরুরি অবস্থা কেন, গণতন্ত্র দিয়েই আজ গণতন্ত্রকে স্তব্ধ করা যায়

আমাদের রাজনীতির এই কাজটা করার ছিল। সে করেনি। আর সেই কারণেই অন্য কেউ করলে সে পছন্দ করে না, ভয়ও পায়। তাই গ্রামে গ্রামে ত্রাণ নিয়ে যাওয়া নাগরিকরা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে শুনতে বাধ্য হন— “ও সব আমাদের কাছে রেখে যান, আমরাই ঠিক হাতে তুলে দেব।”

আরও পড়ুন: শব্দে নয়, অর্থে বদল চাই

ক্ষমতা ভয় পায় উদ্যমকে, সৎ উদ্যোগকে, নিঃস্বার্থ ভাবনাকে। কেন ভয় পায়, তা ভাবতে বসলে বুঝতে পারি এ সবের মধ্যে একটা বিরাট শক্তি আছে। মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার শক্তি। সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে অন্যের কথা ভাবলে কী না করতে পারার শক্তি! সমাজ বদলের ভাবনাকে চালিত করা যায় কেবল সদিচ্ছা দিয়ে। সরকারেরই সব দায়িত্ব, তাই সরকারেরই ব্যর্থতায় মানুষের এই দুর্দশা, এই কথা ভেবে হাত গুটিয়ে বসে না থেকে নাগরিক উদ্যোগেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। কী না হয়েছে এই ক’দিনে! কমিউনিটি কিচেন, ত্রাণ বণ্টন, ঘর সারাই, পুকুরের নোনা জল সাফ, বাঁধ মেরামত, পড়ুয়াদের জন্য বইখাতা, সোলার আলোর ব্যবস্থা, নাবালিকা বিয়ে রোখার চেষ্টা।

কেবল উদ্যমী তরুণরাই কি? বুড়ো হাড়ের ভেলকিও তো দেখে এলাম ধ্বংসস্তূপে গিয়ে। ৯৫ বছরের মানুষ দিব্যি বেঁচেবর্তে আছেন ভুবনেশ্বরীর হালদারঘিরি গ্রামে। বাঁধ দিয়ে জল ঢোকার সময়ে বৃদ্ধ যদুপতি গিরি বাচ্চাদের দোলনায় বসে, গ্রামের লোকের কাঁধে চেপে পৌঁছে গিয়েছেন স্থানীয় পাকা স্কুলবাড়িতে। মনের জোর না থাকলে, বাঁচার অদম্য জেদ না থাকলে কি আয়লা, বুলবুল, আমপানের দেশে এত দিন টিকে থাকা যায়? কিংবা ধরা যাক রাঙ্গাবেলিয়ার কথা। ঝড়ের পর তিন দিন কারও পেটে ভাত পড়েনি। তা-ও রিলিফ ক্যাম্প থেকে বেরিয়েই হাতে কোদাল নিয়ে মাটি কাটতে নদীর পাড়ে চলে গিয়েছেন ছেলে, বুড়ো, মহিলা সবাই। উদ্দেশ্য, বাঁধ দেবেন। যে প্রশাসনিক পাকাপোক্ত বাঁধ প্রকল্পের স্বপ্ন তাঁদের বছর বছর বাঁচিয়ে রাখে, কিন্তু গড়ে ওঠে না কখনওই, সেই বাঁধ ওঁরা নিজেরাই গড়ে নেন মাটি কেটে। কোমর অবধি জল ঠেলে, কাদামাটি মেখে ওঁরা জীবনে ফেরার লড়াই শুরু করেন। প্রতি বার শূন্য থেকে শুরু করা কী জিনিস, তা ওঁরা জানেন, তবু হার মানেন না। এক সময়ে নোনা জল সরে গেলে দেখা যায় ফের মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে ম্যানগ্রোভের দেশ।

সুন্দরবনে গ্রামের পর গ্রাম একই ছবি। বাঁধ ধুয়েমুছে বিদ্যাধরীর শাখা নদী দিয়ে জল ঢুকেছে ঘরে, নোনা জলে ভেসেছে খেতের ফসল আর চাষের জমি, তলিয়ে গিয়েছে মাটির বাড়ি। তার মধ্যেই শহর থেকে এসে মেডিক্যাল ক্যাম্প করে রোগী দেখেছেন ডাক্তারেরা। কেন্দ্রীয় সরকার কবে স্বাস্থ্যখাতে টাকা বরাদ্দ করবে, সেই নির্দেশিকার অপেক্ষা না করে ওঁরা অক্লান্ত ভাবে বুঝিয়ে গিয়েছেন হ্যালোজেনের ব্যবহার— “এক লিটার জলে দুটো ট্যাবলেট ফেলে আধ ঘণ্টা রেখে তার পর জল খাবেন।”

আমপান এসে লন্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল অনেক কিছু। আবার শিখিয়েও গেল যে, কারও অপেক্ষায় বসে থেকে লাভ নেই। কার দোষ, সেই বিচারে দিনের পর দিন কাটিয়েও লাভ নেই। বরং হাত লাগিয়ে কাজে নেমে পড়লে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হতে পারে। দিন বদলের স্বপ্ন দেখতে হবে, স্বপ্নে পৌঁছতে কাজও করতে হবে। পাল্টাতে হবে সঙ্কীর্ণ মানসিকতা, স্বার্থময় দৃষ্টিভঙ্গি। তার ওপরেই নির্ভর করবে বাকিটা।

অন্য বিষয়গুলি:

Sundarbans Cyclone Amphan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy