প্রতীকী ছবি
সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, আমরা যেন টাইম মেশিনে চড়ে কয়েকশো বছর পিছিয়ে গিয়েছি। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটির কথাই ধরা যাক। ড. ফিরোজ খান, সংস্কৃত সাহিত্যে পিএইচডি, এ বছরই রাজস্থান সরকারের সংস্কৃত যুব প্রতিভা পুরস্কার পেয়েছেন। এহেন মেধাবী যুবকটি ইউজিসি নির্ধারিত সমস্ত যোগ্যাতামান পেরিয়ে, ইন্টারভিউয়ে সফল হয়েও সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজে যোগ দিতে পারলেন না। বিশেষ একটি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী যে ছাত্রেরা বাধা দিয়েছে, তাদের যুক্তিটি চূড়ান্ত ভাবে হাস্যকর। তাদের বক্তব্য, স্বয়ং পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যও নাকি এই নিয়োগ সমর্থন করতেন না! বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, যিনি সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যানও বটে, তিনি বলছেন, সমস্ত নিয়ম মেনেই ফিরোজের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাঁর বক্তব্যই এ ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। এর পরেও যদি কারও মনে হয় নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে (যদিও দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তত এই সিলেকশনটিতে দুর্নীতি হয়েছে বলে বিশ্বাস করা বেশ শক্ত) তাদের জন্য আদালতের দরজা খোলা রয়েছে। তবে নিছক হিন্দু-মুসলিম রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করলে হয়তো আমরা একটু ভুল করব। সাম্প্রদায়িকতার বাইরেও এর অন্য একটি মাত্রা আছে, যেটি অদূর ভবিষ্যতে মেয়েদের বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রাচীন হিন্দু ধর্মের এবং সমাজের ওতপ্রোত বন্ধন কিন্তু মুঘল আমলেই বেশ কিছুটা আলগা হয়ে গিয়েছিল। কখনও অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে, কখনও বা সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের আকাঙ্ক্ষায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ দিল্লির দরবারে যাতায়াত শুরু করেছিলেন। গৌড়বঙ্গে তো নবাব হুসেন শাহের রাজত্বেই (১৪৯৪-১৫১৯) বহু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সরকারি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। সাকর মল্লিক, দবীর খাস (যাঁরা রূপ-সনাতন নামে খ্যাত) তাঁদের অন্যতম। সংস্কৃত ভাষা যখন মুসলিম রাজপুরুষদের কাছে গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে, বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতার মতো সংস্কৃত গ্রন্থ পারসী ভাষায় অনুদিত হচ্ছে (মুঘল সম্রাট আকবরের মক্তবখানার কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য), সেই সময়ও কিন্তু হিন্দু মেয়েদের কাছে অক্ষর পরিচয় অধরাই থেকে গেছে। যে ভাষার আঙিনায় তথাকথিত বিধর্মীদেরও চরণচিহ্ন পড়ছে, সেখানে হিন্দু মেয়েরা ব্রাত্য কেন? উত্তর একটাই, মেয়েদের শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদক যন্ত্র, ভোগ্য সামগ্রী, কিংবা পুরুষের সুখ স্বাচ্ছ্যন্দের জোগানদার হিসেবে বন্দি রেখে পুরুষতন্ত্রের চূড়ান্ত উদ্যাপন! আর এই নিষ্ঠুরতম কাজটিকে সামাজিক মান্যতা দিতে প্রয়োজন ছিল শাস্ত্রের দোহাই দেওয়ার।
শাস্ত্রে কী আছে, সেটি জানতে হলে শিখতে হবে সংস্কৃত ভাষা। সুতরাং মেয়েদের অক্ষর পরিচয় না করানোই বুদ্ধিমানের কাজ! সমাজপতি বা বাড়ির পুরুষ অভিভাবকেরা যা বলবেন, সেটাই আপ্তবাক্য ধরে জীবন কাটাত তখনকার মেয়েরা। প্রধানত, মনু সংহিতাই ছিল এ ব্যাপারে সর্বজনগ্রাহ্য শাস্ত্রগ্রন্থ। শাস্ত্রের ব্যাখ্যা নানা রকম হয়, যিনি ব্যাখ্যাকার, তাঁর মানসিকতা এবং উদ্দেশ্য এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালীন হিন্দু সমাজপতিরা মেয়েদের মেয়েমানুষ থেকে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার পথে বাধা দিতে শাস্ত্রের বিচিত্র সব ব্যাখ্যা করেছিলেন। সে-সব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখেরা। সতীদাহপ্রথা রদ, বিধবা বিবাহ আইন পাশ হল (যথাক্রমে ১৮২৯ ও ১৮৫৬ সাল)। ব্রিটিশ শিক্ষাবিদেরা সেই সময় পুরদস্তুর সংস্কৃত চর্চা করছেন। ইংরেজিতে অনুবাদ হচ্ছে নানা শাস্ত্রীয় আকর গ্রন্থ। ১৭৮৪-এ স্যর উইলিয়াম জোন্স এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন, যা সংস্কৃত চর্চাকে অন্য মাত্রা দেয়। মেয়েদের লেখাপড়া শেখার পথে বাধা একটু একটু করে দূর হচ্ছে। তারা দেখছে বৈদিক যুগে মেয়েরা বিদ্যাচর্চা করছে, অবিবাহিত থাকার অথবা স্বাধীন ভাবে জীবন সঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে (স্বয়ংসা মিত্রং বনুতে জনে চিৎ, ঋকবেদ, ১০।২৭।১২ সূক্ত)। শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে মেয়েদের গৃহবন্দি করে রাখার যে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা সমাজপতিরা করেছিলেন, সেই ফাঁস ক্রমশ আলগা হতে শুরু করেছে। বিদ্যাসাগর মশাই পাল্কির গায়ে মনু সংহিতা থেকে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন ‘কন্যাপেব্যং পালনীয়া শিক্ষনীয়াতিযত্নতঃ’! উদ্দেশ্য একটাই, যাতে ধর্মের দোহাই দিয়ে কোনও ভাবেই নারী শিক্ষার পথ বন্ধ না হয়।
তবে এ সব কিছুই হচ্ছিল ব্রিটিশ শাসকদের তত্ত্বাবধানে, যাদের কিছুটা বাধ্য হয়েই সংস্কৃত ভাষার অঙ্গনে প্রবেশাধিকার দিতে হয়েছে গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীদের। সাহেবদের সমীহ করলেও স্বজাতীয় বিদ্যাসাগরের উপরে আক্রমণ হানতে ওই কট্টর ব্রাহ্মণেরা পিছপা হননি। ফলস্বরূপ, সংস্কৃত কলেজে যোগ দিতে গেলে সহকর্মীদের কাছেই বাধা পেয়েছিলেন তিনি। তাঁদের চোখে বিদ্যাসাগর ‘সদাচারী’ ছিলেন না, ছিলেন ‘শূদ্রাচারী’। তিনি মেয়েদের হয়ে লড়েন, জাতপাতের বিরুদ্ধে কথা বলেন! উল্লেখ্য, গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে তিনি অধ্যক্ষ থাকাকালীনই (১৮৫১) সংস্কৃত কলেজের দরজা অব্রাহ্মণ ছাত্রদের জন্য খুলে যায়। সুতরাং এটা বুঝতে কোন অসুবিধে হয় না যে, একটি বিশেষ ভাষাকে বিশেষ ক্ষমতাশালী কোনও গোষ্ঠীর মুঠোবন্দি করে রাখার নির্দিষ্ট কতগুলি কারণ রয়েছে। সেগুলি যতো না ধর্মীয়, তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক।
বর্তমান সামাজিক পরিসরে মেয়েদের ন্যায্য জায়গাটা তৈরি করতে আরও বহু পথ হাঁটা বাকি। যদিও আজকাল প্রায় সমস্ত পেশাতেই নারীরা সফল ভাবে কাজ করে চলেছে, কিন্তু শতকরা বিচারে সেটি তেমন আশাপ্রদ কিছু নয়। এদেশে এখনও কন্যাভ্রূণ হত্যা, বাল্যবিবাহ, বধূমৃত্যু, নারী ধর্ষণের মতো ঘটনা বন্ধ তো হয়নিই, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অবস্থায় আবার যদি স্বঘোষিত সমাজপতিরা মেয়েদের নিরাপত্তার খাতিরে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই আবদ্ধ থাকবার পরামর্শ দেন এবং শাস্ত্রীয় অনুশাসনের জুজু দেখান, তখন উপায় কী হবে? এ ব্যাপারে চিন্তিত হওয়ার বেশ কয়েকটি যুক্তিগ্রাহ্য কারণ রয়েছে।
প্রথমত, কিছু শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এমন সব মতামত জনসমক্ষে ব্যক্ত করছেন, যা চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক এবং মেয়েদের জন্য সম্মানহানিকর। যেমন, পুত্রসন্তান লাভের জন্য গর্ভবতী নারীদের কী কী করণীয়। সম্প্রতি তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইনস্টাইনের মতো আইকিউ সম্পন্ন সন্তান লাভের পদ্ধতিও। আরও চিন্তার হল ওই সেই সব নেতা বলছেন, এ সবই নাকি প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রেই লেখা আছে! এখনও যেমন সন্তান জন্ম না দিতে পারার দায় সামাজিক ভাবে মেয়েদের উপরেই বর্তায় (চিকিৎসাশাস্ত্র যাই বলুক না কেন), তেমনই অদূর ভবিষ্যতে বহু আকাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তানটি আইনস্টাইনের মতো বুদ্ধিমান না হওয়ার ব্যর্থতাও মেয়েটির উপরেই চাপানো হবে না তো? আশঙ্কা এই জন্যেই যে, রাষ্ট্র এদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাতে একটা বড় অংশের মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে।
আরও একটি দুশ্চিন্তার বিষয় মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান সামাজিক হস্তক্ষেপ। অন্য ধর্মে, অন্য জাতে, এমনকি এক গ্রামের ছেলেকে বিয়ে করার শাস্তিও খাপ পঞ্চায়েত, গাঁয়ের মোড়ল বা পাড়ার রাজনৈতিক দাদারা যে ভাবে দিচ্ছে, তাতে সরকারি বিচারালয়ের বাইরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থার হাত ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। ছেলে-মেয়ে দু’টিকে হত্যা করতেও হাত কাঁপছে না, তার একটা গালভরা নামও আছে ‘অনার কিলিং’। আমাদের সমাজে কাঠামো এমনই, যেখানে হত্যা অপরাধ হলেও, সম্মানরক্ষার্থে হত্যাকারী কলার তোলার দিব্যি সাহস পায়!
তাই মাঝে মাঝে বড় ভয় হয়। সেই ভয় আরও চেপে বসে যখন দেখি দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়েও যুক্তি, তথ্য, ইতিহাস এ-সব ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে মানুষের বিশ্বাস! মেয়েরাই যে নরকের দ্বার, এটা তো পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ধর্মীয় অনুশাসনেরই মূল কথা। এই দেশেই দেবতার কৌমার্য্য নষ্ট হওয়ার ভয়ে একটি বিশেষ বয়সসীমার মেয়েদের মন্দিরে ঢুকতে না দেওয়ার ব্যবস্থাও রমরমিয়ে চলে, এই একবিংশ শতাব্দীতেও। ধর্মান্ধ মানুষ তা বিশ্বাসও করেন। সেই বিশ্বাস যদি কখনও বিজ্ঞানকে, যুক্তিকে, শুভবুদ্ধিকে পদদলিত করে মাথাচাড়া দিতে চায়, মেয়েরা পাশে পাবে তো সমাজ, রাষ্ট্র, সর্বোপরি বিচার ব্যবস্থাকে?
লেখক সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy