সত্যিই আপনাদের নিয়ে বড় জ্বালা! আপনারা শুধু ঘরে ফিরতে চাইছেন। আর ‘ফিরব’ বললেই কি ‘ফেরা’ যায়? মনে নেই বায়োস্কোপের সেই সুপারস্টারের ডুপার-সুপারহিট ডায়ালগ— ‘আমি যেখানে দাঁড়াই, সেখান থেকেই লাইন শুরু হয়।’ আপনারা কেন ভাবতে পারছেন না, যেখানে আছেন, সেটাই আপনাদের ঘর। মাথার উপর শামিয়ানা হয়ে ঝুলছে আকাশ! নীচে মখমলের মতো বিছানো রয়েছে ঘাস!
এর পরেও আর কী চান? কী চাওয়ার থাকতে পারে আর! কী অদ্ভুত! আপনারা কিন্তু সমানে ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছেন— ‘খেতে পাচ্ছি না। ত্রাণ পাচ্ছি না।’ সামাজিক দূরত্ব না-মেনে, মুখের মাস্ক কণ্ঠে ঝুলিয়ে আপনারা ভিডিয়ো-বার্তায় কাঁদছেন— ‘প্রশাসন আমাদের ফোন ধরছে না। নেতারা আমাদের সাহায্য করছেন না। রমজান মাসে সেহরি করছি স্রেফ একটা খেজুর দিয়ে। আমাদের বাঁচান।’
বুঝতে পারছেন কি? অল্পেই কেমন অস্থির হয়ে পড়ছেন আপনারা! আসলে, আপনাদের ধৈর্য বলে কিস্যু নেই। আর আপনাদের এত খিদেই-বা কেন, বলুন তো! কই, আমাদের, আমাদের তো এমন খিদে পায় না! আমাদের সেধে-সেধে চিকেন খাওয়াতে হয়। না রুচলে মটন বিরিয়ানি। তা-ও নষ্ট হয় বেশি। যাকগে, এই লকডাউনে কত জনের সুপ্তপ্রতিভা বিকশিত হচ্ছে, জানেন? জানেন, অপটু হাতে কত জন কত রকম রান্না করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ভার্চুয়াল যৌথখামারে? আর গোটা লকডাউন-এপিসোডে ঘ্যানঘ্যান করা, নালিশ জানানো আর ভেউ-ভেউ করে কান্নাকাটি ছাড়া আপনারা কিস্যু করলেন না!
সরকার তো বলেইছে, বাইরে যাঁরা আটকে পড়েছেন, তাঁদের সবাইকে ফেরানো হবে। আপনাদের ‘অশেষ দুর্গতি’ কষ্ট দিয়েছে দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকেও। তিনি ঘোষণা করেছেন, আপনাদের যাঁদের রেশন কার্ড নেই বা খাদ্যসুরক্ষা প্রকল্পে নাম নেই, তাঁরাও আগামী দু’মাস মাথাপিছু পাঁচ কেজি করে চাল অথবা গম এবং পরিবার-পিছু এক কেজি করে ডাল পাবেন। আপনাদের জন্য বড় শহরে বাড়ি তৈরি হবে। সস্তার ভাড়ায় সেখানে থাকতে পারবেন। আপনাদের ফেরাতে ১০৫টি ট্রেন চলবে।
তাই, তাড়াহুড়ো করবেন না। কথায় কথায় রাষ্ট্রকে বিব্রত করবেন না! আর একটা কথা, ট্রেন ছাড়বে শুনেই তড়িঘড়ি লোটাকম্বল নিয়ে স্টেশনেও ছুটবেন না। রবিবার বেঙ্গালুরু থেকে যে ট্রেন ছেড়েছে, তার টিকিটের দাম ছিল ওই হাজারখানেক টাকা। সোমবার সব শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যে ট্রেন ছেড়েছে, তার ভাড়াও সাকুল্যে হাজারচারেক টাকা। বৌ-বাচ্চা নিয়ে ফিরতে গেলে তা ধরুন কত, বড়জোর দশ-বারো হাজার টাকা লাগবে। ফলে, ট্রেন-বাবদ কয়েকহাজার টাকা, তারপরে গাড়ি-টাড়ি ভাড়া করতে হলে আরও কয়েকহাজার। এ আর এমন কী!
ফলে, ছোটাছুটির আগে দেখে নিন, পকেটের জোর কেমন। তবে, এই সামান্য টাকাটাও যদি আপনাদের কাছে না থাকে, তা হলে চুপটি করে যেখানে যে ভাবে আছেন, সেখানেই থাকুন। এই বাজারে কোনও কোনও রাজনৈতিক দল বলেছিল, আপনাদের নিখরচায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আর কয়েকজন অর্থনীতিবিদের প্রস্তাব ছিল— আপনাদের হাতে কিছু নগদ টাকাও গুঁজে দিতে। কী স্পর্ধা!
এ আবার হয় নাকি!
আপনারা বোকার মতো দুমদাম সিদ্ধান্ত নিয়ে মরে-টরে যাচ্ছেন, তাই বাধ্য হয়ে সরকারকে কয়েক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। নইলে আবার মান থাকে না! তাই বলে আপনাদের স্রেফ বসিয়ে বসিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে, হাতে নগদ টাকা ধরিয়ে দিয়ে আবার ট্রেনের টিকিট ‘ফ্রি’ করে দিয়ে বাড়ি পাঠানো কি সম্ভব, বলুন তো! এমনিতেই দেশের আর্থিক অবস্থা তো কহতব্য নয়! সেই আর্থিক অবস্থা সামাল দিতে মদের দোকান খুলে দেওয়া হয়েছে। সুরাপ্রেমীরা চোঁ-চোঁ করে বোতলের মদস্তর যত নীচে নামাচ্ছেন, সাঁ-সাঁ করে উঠছে অর্থনীতির পারদ। এ যেন সেই রাঙাজবা-কম্পিটিশন!
কিন্তু আপনারা ঠিক কোন কাজে লাগবেন, বলতে পারেন?
হ্যাঁ, সামনে যদি ভোট-টোট থাকত, তা-ও একটা কথা ছিল। তখন ব্যাপারটা গণতান্ত্রিক অধিকার হত। প্রশাসন আপনাকে সেই অধিকার প্রয়োগের জন্য চিঠি পাঠাত। ফোন যেত— ‘আয়, শ্রমিকভাই, ভোট দিয়ে যা।’ টুং-টাং শব্দে ঢুকত এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ। পাড়ার নেতারাও বলতেন— ‘ওরে, তোদের যাতায়াতের টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিলাম। শিগ্গির চলে আয়।’
কিন্তু এ তো ভোটের লগন নয়। এ লগন করোনা-র (কী আজব ব্যাপার, ভাইরাসের নামের শেষেও লেপ্টে রয়েছে ‘না’)। যার শুরুতে আমরা বিষয়টিকে তেমন পাত্তা না দিলেও পরে দিব্যি বুঝে গিয়েছি, ভাইরাস আমাদের ভিত্তি আর লকডাউন আমাদের ভবিষ্যৎ। তাই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে যে দিন লকডাউন ঘোষণা করলেন, সে দিনও আপনারা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন— ‘আমাদের ব্যবস্থা না করেই কেন লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়া হল?’
আজব প্রশ্ন! দেশ আগে না কি আপনারা? জরুরি অবস্থায় কত কী করতে হয়! দেশ আপনাকে বাঁচাতে, আপনাকে ‘সলিড’ নাগরিক হিসেবে তুলে ধরতে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড তৈরি করেছে, দেশের যেখানে খুশি কাজে যাওয়ার অধিকার দিয়েছে, আপনি যাতে নিশ্চিন্তে দেশে থাকতে পারেন (শর্তাবলি প্রযোজ্য) তার জন্য তৈরি করেছে নয়া নাগরিকত্ব আইন! আর আপনি, আপনারা দেশের জন্য, এই ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে জিততে এই সামান্য কষ্টটুকু সহ্য করবেন না?
আর সেই সামান্য কষ্টে আপনি, আপনারা যদি মরে যান, যাবেন। তা ছাড়া, এ মৃত্যু যে-সে মৃত্যু নয়। করোনা-মরসুমে আপনাদের এই মৃত্যুকে ‘বলিদান’ও বলা হতে পারে। আবেগের বেগ বাড়লে জুটতে পারে ‘শহিদ’ তকমাও।
শেষকথা একটাই, আপনাদের আত্মনির্ভর হতে হবে। মানে, হতেই হবে। ফলে, কাজ মিলুক নাই বা মিলুক, খাবার জুটুক নাই বা জুটুক, প্রাণ থাকুক নাই বা থাকুক, নিয়ম মেনে মাস্ক পরুন আর অন্তহীন পথ হাঁটতে হাঁটতেও হাতে ঘষতে থাকুন সাবান কিংবা স্যানিটাইজ়ার! বলা যায় না, বরাত ভাল থাকলে জিনের সন্ধানও পেয়ে যেতে পারেন!
শ্রমের দিব্যি, বাকিটা না হয় তিনিই দেখবেন!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy