Advertisement
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪
Coronavirus

জনসংখ্যা ১০ কোটি, আক্রান্ত ২৫০, মৃত ০, কী ভাবে পারল ভিয়েতনাম

করোনা প্রতিরোধে ভিয়েতনাম স্বাস্থ্য দফতর যা যা কাজ করেছিল, তার মধ্যে শুধু বিজ্ঞাপন নয়, সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ছিল অন্যতম। 

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২০ ০০:৪০
Share: Save:

জানুয়ারির শেষ তারিখে ভিয়েতনামের হ্যানয় পৌঁছোই। ঠিক এক সপ্তাহ আগেই সে-দেশে কোভিড-১৯’এর প্রথম দু’জন রোগী শনাক্ত হন। মাত্র তেরোশো কিলোমিটার দূরে চিনের উহানে তত দিনে আক্রান্তের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়েছে, মৃত ১৭০। রওনা দিয়েছিলাম কিছুটা আশঙ্কা নিয়েই। পাঁচ দিন ধরে হ্যানয় ঘুরে বেড়ালাম, নানা মিউজ়িয়ম, পার্ক, এমনকি জলে পুতুল-নাটক পর্যন্ত দেখা হল— অবাধে। শহর নয়, পরিচ্ছন্নতার চলন্ত নমুনা। প্রতিটি মানুষ যেন পরিচ্ছন্নতার বোধ তুলে ধরতে ব্যগ্র। ইতিমধ্যে, ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভিয়েতনামে কোভিড ১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০। সেই রাতে আমাদের ঘরের বেল বাজল। এক জন লোক হাতে একটা লিফলেট ধরিয়ে অনেক ক্ষণ বক্তৃতা করলেন, শুধু ‘করোনাভাইরাস’ ছাড়া কিছুই বুঝলাম না। ব্যাপার কী? ভিয়েতনাম ছেড়ে চলে যেতে বলছে? লিফলেট তিয়েং ভিয়েত— ভিয়েতনামি— ভাষায়, কিন্তু হরফটা রোমান-ভিত্তিক। গুগলের সাহায্য নিয়ে যেটুকু বুঝলাম, নোভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য কী কী করণীয়, সে বিষয়ে বলা আছে তাতে। বুঝলাম, যিনি লিফলেট দিয়ে গেলেন, তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তুও তা-ই ছিল। ভিয়েতনামের লোকসংখ্যা কম না, দশ কোটির কাছাকাছি। প্রতি বাড়িতে গিয়ে এ ভাবে প্রচার চালানো সহজ নয়। কিন্তু করোনা প্রতিরোধে ভিয়েতনাম স্বাস্থ্য দফতর যা যা কাজ করেছিল, তার মধ্যে শুধু বিজ্ঞাপন নয়, সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ছিল অন্যতম।

পর দিন, ৬ মার্চ যাওয়ার ছিল ক্যাট-বা, সেখান থেকে হলং বে। বাস ছাড়ল। একরের পর একর সদ্য পোঁতা ধানচারা, কলার খেত, পথে আশ্চর্য পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, খাবারের দোকান। সে-সব ছাড়িয়ে বাস পৌঁছল বেন ফা গট জাহাজঘাটায়, ফেরি করে আবার বাসে উঠতে হবে। বিপত্তি ওখানেই। বেশ খানিক ক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে কন্ডাক্টর জানালেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ, ছাব্বিশটি দেশের নাগরিককে ক্যাট-বা যেতে দেওয়া হবে না। এই দেশগুলোয় করোনা-আক্রান্ত মানুষের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। এক জন ছাড়া বাকি সবাইকে ফিরিয়ে দিল পুলিশ— তিনি ডেনমার্কের বাসিন্দা, তখনও তাঁর দেশ করোনা-তালিকায় আসেনি। পুলিশ আমাদের ফিরিয়ে দিল বটে, কিন্তু আচরণ খুবই ভদ্র, রাগ করা গেল না।

ফেরার টিকিট দু’দিন পর। ঠিক করা গেল, হ্যানয়ের আরও কিছু মিউজ়িয়ম, ইউনিভার্সিটি, এই সব দেখব। হা হতোস্মি! মিউজ়িয়ম, ইউনিভার্সিটি, বন্ধ। দোকান-বাজার অবশ্য খোলা। জানতে পারলাম, কয়েকটা দিনের মধ্যেই ভিয়েতনাম স্বাস্থ্য দফতর করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতি সেরে নিয়েছে। এমনিতে ভিয়েতনামে প্রতিটি মানুষের জন্য মানবিক মানসম্পন্ন পরিচর্যামূলক চিকিৎসার সুব্যবস্থা আছে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাও খুব উন্নত। তাই রোগ প্রতিরোধ, রোগ হলে মৃত্যুও আটকানো সহজ হয়। এই লেখার সময় (৬ এপ্রিল) অবধি দশ কোটি জনসংখ্যার দেশে কোভিড-১৯’এর আক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। আক্রান্তের সংখ্যা আড়াইশোর কম।

কিন্তু করোনা প্রতিরোধের জন্য আরও কিছু দরকার হয়। তাই সরকারি নির্দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জনবহুল জায়গা বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি সন্দেহজনক সবাইকে খুঁজে খুঁজে পরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষার জন্য ভিয়েতনাম একটা সহজ, কম খরচের কিটও বানিয়ে ফেলেছে, অন্য দেশগুলো সেই কিট কিনতে শুরু করেছে। মার্চের শেষ অবধি হিসেব— প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় প্রায় ১৬ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে (আমাদের দেশে তুলনীয় সময়ে সংখ্যাটা প্রতি লক্ষে ২-এর নীচে!)। তা সত্ত্বেও আর্থিক ক্ষমতা সীমিত হওয়ার কারণে যত পরীক্ষা হওয়া দরকার ছিল তত করে ওঠা যাচ্ছে না, তাই জোর দেওয়া হচ্ছে সংক্রমিতদের খুঁজে বার করার এবং স্থানীয় স্তরে নির্বাচিত নিয়ন্ত্রিত লকডাউনের ওপর। এবং কোয়রান্টিন। ব্যবস্থাটা এমনই, কোয়রান্টিনে কাটানো এক ব্রিটিশ নাগরিকের ভাষায়, ‘থাকার জন্য এত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয় আমার বাড়িতেও নেই।’

সব দেশেই কিছু বেয়াড়া ধনী থাকে। ভিয়েতনামি এক ধনবতী ইউরোপের তিনটি দেশ ঘুরে লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন ২ মার্চ। বলে রাখা ভাল, মার্চের প্রথম সপ্তাহেও লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্টে কোনও পরীক্ষা করা হচ্ছিল না। এও মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, আমেরিকায় ৯ মার্চ তারিখেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সদর্প ঘোষণা ছিল, ‘গত বছরেও ৩৭,০০০ আমেরিকান ফ্লু-তে মারা গেছেন, গড়ে প্রতি বছর ২৭,০০০ থেকে ৭০,০০০ ওতেই মারা যান। করোনা নিয়ে কথা বলবার আগে একটু ভেবে দেখুন!’ সেই ধনী— এবং মূঢ়— ভিয়েতনামি বিমানবন্দরে পরীক্ষকদের ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়েন। তিনি ছিলেন সে দেশের ১৭ নম্বর করোনা আক্রান্ত। তাঁকে খুঁজে পাকড়াও করা হয়। তিনি যে বিমানে এসেছিলেন, তার সব যাত্রীকে কোয়রান্টিনে রাখা হয়। তিনি যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই রাস্তা জীবাণুমুক্ত করা হয়, সেই পথের ধারে বাস করা প্রত্যেককে পরীক্ষা করা হয়। নোভেল করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা এতটাই বেশি যে, এত সতর্কতার পরও সামান্য ফাঁক গলে, মার্চের শেষ কয়েক দিনে এর প্রকোপ বেড়ে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দু’শোয় পৌঁছে যায়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ওই ১৭ নম্বর আক্রান্তের পরীক্ষা ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে এই প্রকোপ বৃদ্ধির যোগ আছে। জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক বার মিশে গেলে তাকে বিচ্ছিন্ন করা কঠিন। কিন্তু সন্দেহভাজনদের পরীক্ষা, কোয়রান্টিন, স্কুল-কলেজ বন্ধ এবং সু-উন্নত চিকিৎসা— ভিয়েতনামের গড়ে তোলা এই সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিরক্ষার পক্ষে হেরে যাওয়াটাই বরং কঠিন। এখনও চিন বা দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় অনেক দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোভিড-১৯’এর বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ের নিদর্শন ভিয়েতনাম রেখে চলেছে, বিশ্বের কাছে সেটা একটা শিক্ষণীয় ব্যাপার।

১০ ফেব্রুয়ারি কলকাতা ফিরলাম। ৩১ জানুয়ারিতেই ভারতে করোনা আক্রান্তের খবর পাওয়া গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, এয়ারপোর্টে খুব পরীক্ষানিরীক্ষা হবে, ছাড় পেতে দেরি হবে। কোথায় কী! গটগট করে বেরিয়ে এলাম, অবাধে। হাতে প্রচুর সময় ছিল, কিন্তু ভারত সরকার তখন শাহিন বাগের প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত! ভারতের স্বাস্থ্য পরিচর্যার কাঠামো দুর্বল, সবাই জানে। কিন্তু, হাতে যা সময় ছিল, দেশের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরামর্শ করে এগোলে অনেক কম খরচে কোভিড-১৯’এর মোকাবিলায় একটা মডেল গড়ে তোলা সহজেই সম্ভব হত। সরকার সে পথে হাঁটেনি— বিজ্ঞান এবং পরামর্শ, দু’টো ব্যাপারেই তার ঘোর আপত্তি। বরং তার কাছে লকডাউন সবচেয়ে সহজ পথ। তাতে যাঁরা মারা যাবেন, তাঁরা দেশের সবচেয়ে অসহায়, দিন-আনি-দিন খাই লোকেরা। ভাইরাসের আক্রমণ থেকে তাঁরা কতটা বাঁচতে পারবেন তা জানা নেই, কিন্তু ক্ষুধার আক্রমণে যে দেশের বিপুল মানুষের প্রাণ যাবে, তা হলফ করে বলা যায়।

কর্তৃপক্ষ মনে রাখেনি, চিন কেবল লকডাউন করেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেনি, আনা যায় না। লকডাউনের সঙ্গে অতি উন্নত মানের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোও সে দেশে আছে। ইউরোপের যে-সব দেশ লকডাউন করেছে, তাদের বেশির ভাগের চিকিৎসা পরিকাঠামো মজবুত, তাই ইটালি ও স্পেন বাদ দিলে বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশেই মৃত্যুহার এক শতাংশের আশেপাশে। এক দিনে চিকিৎসা পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায় না, কিন্তু সঙ্কটকালে নতুন কিছু নির্মাণ করা সহজ। গোটা বিশ্ব দেখছে বেসরকারি চিকিৎসার আরাধনা কতটা বিফলে গিয়েছে, যে দেশ যত প্রাইভেট-নির্ভর, সে- দেশ তত বিপদে পড়েছে। ভারত সরকার এই সঙ্কটমুহূর্তে একটা মজবুত সরকার-পোষিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারত। শুধু তা-ই নয়, তুলনায় অনেক কম খরচ করে অদূর ভবিষ্যতে অনেক বেশি লাভবান হতে পারত, বিশ্ব জুড়ে যে উৎপাদন সঙ্কট নেমে এসেছে, ভারত সহজেই তা থেকে নিজেকে রক্ষা করে আর্থিক ভাবে বিপুল লাভবান হতে পারত। কর্তারা গড়িমসি করে গেলেন। এখন এক দিকে ভাইরাসের মার, অন্য দিকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কোটি কোটি মানুষের আর্ত চিৎকার। দুর্ভাগ্যের শেষ থাকে, কিন্তু ডেকে আনা সর্বনাশের বিস্তার অসীম।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Vietnam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy