অবশেষে করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হল হল রব উঠেছে। ঠিক যে মূহূর্তে বিশ্বে করোনা আক্রান্ত দু কোটি টপকে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে সেই মুহূর্তে এমন চমকপ্রদ বার্তা নিঃসন্দেহে মনোবল বাড়িয়ে তুলেছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়ে দিলেন তাঁর কন্যার উপরও এই স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের সফল প্রয়োগ করা হয়েছে। এই বার্তাতে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও সক্ষমতা যেন আরও দৃঢ় হল। কিন্তু মুশকিল হল, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দীর্ঘতম যে ধাপ সেই পর্যায় অতিক্রম করার আগেই এই ভ্যাকসিনকে ছাড়পত্র দিয়ে দিল রাশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রক! ফলত, ভ্যাকসিন আবিষ্কারক দেশ হিসাবে রাশিয়া এখন ক্লাসের ফার্স্টবয়। শুধু কি লিস্টের প্রথম স্থান দখল করার জন্য এই পদক্ষেপ? তা নিয়ে শুরু হয়েছে বিস্তর জল্পনা।
প্রশ্ন হল, হিউম্যান ট্রায়ালের গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় পর্যায় সফল ভাবে উত্তীর্ণ না হয়ে ক্লাসের ফার্স্টবয় তকমা পাওয়া ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সমান হল না কি? কিন্তু এই ঝুঁকি নিয়ে কেন স্বাস্থ্যমন্ত্রক ভ্যাকসিনের ছাড়পত্র দিলেন? মাত্র দুই মাসের ট্রায়ালে মোট ৭৬ জন ভল্যান্টিয়ারের উপর ট্রায়াল চলে। তাঁদের উপর ভ্যাকসিনের শর্ট রানে তেমন সমস্যা তৈরি করেনি ঠিকই এবং তাঁদের শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতিও পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই বলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ঠিক ভাবে প্রমাণ পায় না। কোনও ভ্যাকসিনকে সফল ভাবে উত্তীর্ণ হতে গেলে ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে (কমপক্ষে ১০০০-৩০০০ জন) বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে হয়। তার পর লং রানে, অর্থাৎ, দীর্ঘ দিন (অন্তত ৬ মাস) ধরে পর্যবেক্ষণ করতে হয় যে, কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা ভ্যাকসিন দ্বারা কেউ নতুন ভাবে আক্রান্ত হচ্ছে কিনা। ভ্যাকসিন আদৌ প্রতিরোধ করতে পারছে কিনা, অথবা প্রতিরোধ করলেও কত দীর্ঘ প্রতিরোধ গড়ে তুলছে— সেগুলো পরীক্ষা করা হয় এই ধাপে। ভ্যাকসিনের রিস্ক-বেনিফিট নির্ধারণ করা হয়।
বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘প্লেসিব কন্ট্রোল্ড, র্যানডোমাইজ ট্রায়াল’। অতি আবশ্যিক ও গুরুত্বপূর্ণ এই ধাপ টপকে নিজের সাফল্য নিজেই জাহির করার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই, বরং আছে শুধু মুর্খামি। নির্দিষ্ট তথ্য ও স্টাডি ছাড়া এমন বার্তায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-সহ সকলেই সন্দিহান। স্বাস্থ্যকে পণ্য হিসাবে বাণিজ্যিক রূপে রূপান্তর অনেক আগেই শুরু হয়েছে। সারা বিশ্বজুড়ে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের রেষারেষিতে রাশিয়ার এই পদক্ষেপ স্বাস্থ্যের বাণিজ্যিকীকরণের অভিযোগকে যেন আরও দৃঢ় করল।
রাশিয়া বরাবরই নিজের আমিত্ব, অহংবোধ জাহির করা ও প্রতিশোধস্পৃহা মনোভাবে বিশ্বাসী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ঠান্ডা যুদ্ধের আবহাওয়ায় বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে মহাকাশযান পাঠিয়ে সবাইকে চমক দিয়েছিল। মনে করা হচ্ছে, সেই ধারা অব্যাহত রাখতে এই তীব্র সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে আবার একটা চমক দিল পুতিনের দেশ। এই রেষারেষিতে হয়তো ক্ষমতার আস্ফালন, বা সামরিক পেশিশক্তি উন্মোচিত হল। কিন্তু সাধারণ মানুষের কি বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হল না? ইতিহাস সাক্ষী আছে, অসম্পূর্ণ তথ্য বিশ্লেষণ, অসাবধানতার ফলে পূর্বে বহু ভ্যাকসিন জনসাধারণের হিতে বিপরীত হয়েছে।
১৯২৯ সালে জার্মানির লিউবেক শহরে বি.সি.জি (টিবি রোগের ভ্যাকসিন) ভ্যাকসিন শিবির হয়েছিল। এই শিবিরের চার মাস পরে দেখা যায়, যে শিশুদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে ২৫১ জনের টিউবারকুলোসিস রোগ দেখা গিয়েছে। তাদের মধ্যে মারা যায় ৭০ জন। এই ঘটনার তদন্ত করে জানা যায় নতুন আবিষ্কৃত এই ভ্যাকসিনে ভিরুলেন্ট টাইপ টিউবারকুলোসিস মিশে ছিল, যেটি থেকে সংক্রমণ ছড়ায়। এই ঘটনা 'লিউবেক ডিজাস্টার' হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে আজও।
১৯৫৫ সালে আমেরিকার পাঁচটি রাজ্যে প্রায় দু’লক্ষ শিশুকে পোলিও ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়েছিল। কিছু দিনের মধ্যে বহু শিশু প্যারালাইসিস লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকে। পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানা যায় প্রায় ৪০ হাজার শিশু পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তদন্তে উঠে আসে কাটার ল্যাবরেটরিতে নতুন আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনে ভিরুলেন্ট পোলিও ভাইরাস ইনঅ্যাকটিভ করা ছিল না। এই ঘটনা শুধু ইতিহাসের পাতায় অন্ধকার 'কাটার ইন্সিডেন্ট' নামে পরিচিত হয়নি, এর পর থেকে বলা হয় আমেরিকানদের মধ্যে অ্যাটোম বোমের পর দ্বিতীয় পোলিও ভ্যাকসিনের প্রতি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হল, রাশিয়ার তৈরি স্পুটনিক ভ্যাকসিনে রিকম্বিনান্ট হিসাবে যে অ্যাডিনোভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে সেই অ্যাডিনো ভাইরাস এর আগেও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। ২০০৭ সালে আমেরিকায় এইচ.আই.ভি ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের সময় দেখা যায় সংক্রমণ আরও বেড়ে যাচ্ছে। ওই ভ্যাকসিনে ব্যবহার করে হয়েছিল অ্যাডিনোভাইরাস যেটি সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এই ভ্যাকসিন ট্রায়াল।
সুতরাং, ভ্যাকসিনের ক্ষতিকর প্রভাব কী কী হতে পারে, তা সহজে অনুমেয়। যদিও এই ভ্যাকসিনগুলোর অধিকাংশই ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপ সম্পূর্ণ করার পরেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। তবুও ভ্যাকসিনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব আটকানো যায়নি। যে কোনও নতুন ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরে তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপর কেমন প্রভাব ফেলে, তার সারভিলেন্সের জন্য আরও কয়েক বছর সময় দিতে হয়। অথচ, রাশিয়া উপযুক্ত তথ্যপ্রকাশ ছাড়া কী ভাবে ভ্যাকসিনের সুদূরপ্রসারী কার্যকারিতা নিয়ে নিশ্চিত থাকছে? শুধুই কি বাণিজ্যিক মনোভাব আর বিশ্ব রাজনীতিতে পেশিবল বৃদ্ধির ভাবনা? এর উত্তর হয়তো সময় দেবে।
প্রসঙ্গত, সারা বিশ্বে ১৫০-১৬০টি সংস্থা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে আছে। কেউ কেউ প্রি ক্লিনিক্যাল স্টেজে আছে। আবার, অনেকেই তৃতীয় ধাপে পৌঁছে গিয়েছে। সকল সংস্থার গবেষণার তথ্য ও পদ্ধতির বিস্তারিত বিভিন্ন গবেষণা জার্নালে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। সময় লাগলেও আশার আলো ফুটতে শুরু করেছে। ভারতও অনেকটাই এগিয়ে। তাই অযথা আতঙ্কিত না হয়ে, ধৈর্য ধরা জরুরি। তাড়াহুড়োতেই কিন্তু বিড়ম্বনা বেশি!
কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy