Advertisement
০৩ জানুয়ারি ২০২৫
Coronavirus

শুধু স্বাস্থ্য নয়, ভেঙে পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতিও

বিশ্ব বাজারে পণ্য উৎপাদন ও জোগানের শৃঙ্খলটিই বিঘ্নিত হয়ে পড়েছে। তার প্রভাবে বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার এক অশনিসঙ্কেত লক্ষ করা যাচ্ছে।বিশেষজ্ঞেরা বড় অংশ মনে করছেন, চিনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহর নোভেল করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল।

ভাস্কর গোস্বামী
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২০ ২৩:২৪
Share: Save:

আমাদের একটি প্রচলিত রসিকতা, যা কিছু চিনে উৎপাদিত তা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু বিশ্ববাজার ছেয়ে গিয়েছে চিনা দ্রব্যে। কারণ, চিনে উৎপাদিত দ্রব্যের দাম তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। উদ্বৃত্ত সস্তার শ্রম ও উপযুক্ত প্রযুক্তির মেলবন্ধন চিনের উৎপাদনের ব্যয় অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। তাই বিশ্বায়নের হাত ধরে বিশ্ববাজারে চিনা সামগ্রীর রমরমা।

বিশেষজ্ঞেরা বড় অংশ মনে করছেন, চিনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহর নোভেল করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল। কারণ, এই ভাইরাস প্রথম শনাক্তকরণ হয় সেখানে। মানুষ ও পণ্যের চলাচলের হাত ধরে সারা বিশ্বে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে। ধারণাটিও অমূলক নয়। চিনের হুবেই প্রদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা বহুজাতিক সংস্থার কারখানা। বেশ কয়েকটি বহুজাতিক গাড়ি উৎপাদক সংস্থার কারখানাও সেখানে রয়েছে। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষজন যাতায়াত করছেন সেখানে। আবার পরিসংখ্যান বলে, চিনারা সবচেয়ে বেশি বিশ্বভ্রমণ করেন। ফলে খুব সহজেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। এবং খুব দ্রুত হারে। যার পরিণতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন) একে অতিমারি (প্যানডেমিক) ঘোষণা করেছে। কিন্তু, এটাও স্বীকার করতে হবে, চিন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। ভাইরাস কবলিত অঞ্চলে জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাধ্যতামূলক ভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে, যাতে সংক্রমণ ছড়িয়ে না পড়ে। চিনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গভীরতা ও দায়বদ্ধতা এই ভাইরাসের সংক্রমণ অনেকাংশেই প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছে। কাল চিনে মাত্র ৩৪ জন করোনা আক্রান্তের খোঁজ মিলেছে।

বিশ্বের অর্থনীতিতে এই ভাইরাসের ব্যাপ্তি ও প্রভাব অসীম। এর কেন্দ্রবিন্দু চিন বলেই ক্ষতি শুধু চিনেই সীমাবদ্ধ থাকবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। বিশ্বায়নের যুগে প্রতিবেশী আক্রান্ত হলে তার প্রভাব নিজের ঘরেও এসে পড়ে। আলোচনার সুবিধার জন্য, অর্থনীতির উপরে করোনার প্রভাব তিনটি ধাপে আলোচনা করা যেতে পারে— চিনের প্রেক্ষাপট, বিশ্ববাজার ও ভারতে প্রভাব।

প্রথমে আসা যাক চিনের অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের প্রভাব প্রসঙ্গে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যসামগ্রীর বড় অংশ রফতানি হয় চিন থেকে। আবার পেট্রোলিয়াম ও ডিজেলের চাহিদায় শীর্ষে থাকে চিন। কিন্তু চিনের নিজস্ব কোনও খনিজ তেলের সম্পদ নেই। চিনের পেট্রোল ও ডিজেলের জোগান আসে মূলত আমেরিকা এবং কিছুটা উপসাগরীয় দেশগুলি থেকে। করোনার প্রকোপে চিন বহির্বিশ্ব থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। বলা ভাল, স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে। যাতে ভাইরাসের সংক্রমণ আর ছড়িয়ে পড়তে না পারে। মানবজাতির স্বার্থে এই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াটা পুরোটাই ঐচ্ছিক, অন্তত চিনের ক্ষেত্রে। ফলে, চিনের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝাঁকুনি আসতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনের তৈরি দ্রব্যের চাহিদা হ্রাসের জন্য দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রও সংকুচিত হবে। এর ফলে চিনের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি এক ঝটকায় অনেকটাই কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। অর্থনীতিতে এই ঝাঁকুনির তীব্রতা ও গভীরতা চিনকে অনেকটাই পিছিয়ে দিতে পারে। বিশ্ব দরবারে চিনের অর্থনীতির এই নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে ওঠা দুষ্কর। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক অস্পৃশ্যতা কতদিন স্থায়ী হয় তার উপর নির্ভর করছে চিনের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা।

বিশ্বায়নের ফলে চিনের অর্থনীতি এই দুরবস্থার প্রভাব খুব সহজেই অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়বে। চিনের মতো দ্রুত বেড়ে ওঠার অর্থনীতির সঙ্গে যে সব দেশের খুব নিবিড় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, সে দেশগুলিতে এই ভাইরাসে প্রভাব বেশি পড়তে বাধ্য। অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলা হয়, ‘স্পিলওভার এফেক্ট’ (spillover effect) বা কন্টাগিয়ন (contagion)। এই ‘স্পিলওভার এফেক্ট’-এর জন্যই আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের চাহিদা অনেকটা পড়ে গিয়েছে। ফলে বিশ্ববাজারে ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেল প্রতি মাত্র ৩০ ডলারে ঠেকেছে। দ্রুত গতিতে উঠে আসা অর্থনীতির ক্ষেত্রে কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে পণ্য জোগানের বাজার বিপুল ভাবে মার খায়। আসলে বিশ্ব বাজারে পণ্য উৎপাদন ও জোগানের শৃঙ্খলটিই (supply chain) বিঘ্নিত হয়ে পড়েছে। তার প্রভাবে বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার এক অশনিসঙ্কেত লক্ষ করা যাচ্ছে। আবার করোনা ভাইরাস প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য অন্য দেশেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তার প্রভাবে প্রত্যেকটি দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার আনুমানিক প্রায় এক থেকে দু’শতাংশ কমতে বাধ্য। উন্নত দেশগুলিতে ব্যাপক হারে শেয়ার বাজারের পতন সেই দিকেই নির্দেশ করছে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (আইএলও) সর্বশেষ রিপোর্টে বলছে, এতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২.৫ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে।

এ বার আসা যাক আমাদের দেশের অর্থনীতির উপরে করোনার প্রভাব প্রসঙ্গে। এ কথা ঠিক যে, ইটালি, ইরান, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও অন্য দেশগুলি থেকে আমাদের দেশে করোনা আক্রান্ত সংখ্যা এখনও অনেকটাই কম। তবে আক্রান্তের সংখ্যা দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করা মুর্খামি হবে। এক জন আক্রান্ত থেকেও খুব দ্রুত হারে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই এই ভাইরাসটি প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন সবার একনিষ্ঠ প্রয়াস। একটা ভয়ের পরিবেশ এর মধ্যেই তৈরি হয়ে আছে। শুনশান বাজার হাট, রাস্তাঘাট, অফিস— অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপরে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক উড়ান ও ভ্রমণের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।

স্তব্ধ অর্থনীতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে। বিগত বছরের সরকারি ভ্রান্ত নীতির জন্য এমনিতেই এই ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষেরা খুব একটি ভাল নেই। তার উপরে করোনা ভাইরাসের প্রকোপে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের এক দিকে কাজ হারানোর আশঙ্কা, অন্য দিকে পরিবারের সদস্যদের জন্য দু’বেলা দু’মুঠো অন্নসংস্থানের চিন্তা। সরকারি চাকুরেদের কাজ চলে যাওয়ার চিন্তা নেই, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর সঞ্চয় করার দুশ্চিন্তা আছে। ব্যাঙ্কগুলিতে টাকা তোলার লাইন ও নিত্য প্রয়োজনীয় ও খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহের লম্বা লাইন লক্ষ করা যাচ্ছে। মাস্ক, স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ কেনার হিড়িক পড়ে গিয়েছে সর্বত্র। এ সব দ্রব্যের কালোবাজারিও শুরু হয়েছে। এই ক্ষেত্রে ভুললে চলবে না, শুধু নিজে ভাইরাস প্রতিরোধ করলে হবে না, অন্যদেরও প্রতিরোধের সুবিধা করে দিতে হবে। সব সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রগুলিকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কিটের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষের কাছাকাছি। দেশের জনসংখ্যার নিরিখে তা খুবই নগণ্য। উপরের তথ্যই বলে দেয়, এমন সঙ্কট সামলাতে আমরা কতটা অপ্রস্তুত। তার সঙ্গে রয়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব। আর হবেই না বা কেন, প্রায় প্রত্যেক কেন্দ্রীয় বাজেটে বিজ্ঞান গবেষণা, স্বাস্থ্য ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় সংকুচিত হয়ে আসছে। আর প্রাধান্য পেয়ে যাচ্ছে প্রচার, বিশ্বভ্রমণ, মূর্তি আর মন্দির নির্মাণ। বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এই অবস্থার মোকাবিলা না করলে খুব শীঘ্রই আমাদের রবিনসন ক্রুসোর আইল্যান্ডের বাসিন্দা হয়ে পড়ে থাকতে হবে।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health World Economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy