প্রকৃতিরই এক সৃষ্টি ভাইরাস। জীবাণুর চেয়ে আকারে অনেক ছোট। জীবাণু যেমন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ এক কোষ, ভাইরাস তা নয়। বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য তাকে পরজীবী হয়ে থাকতেই হয়। ডিএনএ বা আরএনএ জাতীয় জিনগত পদার্থ কেন্দ্রে রেখে প্রোটিন ও চর্বি জাতীয় আবরণী দিয়ে তৈরি ভাইরাস। তার অবস্থান যেন ‘ঘরেও নহে পারেও নহে’—অজৈব ও জৈব পদার্থের মাঝখানে। তার একটি পা যেন রাসায়নিক পদার্থ-প্রতিম, থাকে জৈব প্রাণের বসত চৌকাঠের বাইরে। আর অন্য পা’টি ভিতরে। সে অপেক্ষায় থাকে, আক্রমণ শানিয়ে উদ্ভিদ বা প্রাণীর জীবকোষেকে দখল ও ব্যবহার করে পূর্ণ প্রাণে প্রাণিত হওয়ার জন্য ।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস বলে, ভাইরাস, মহামারির মধ্যে দিয়ে তার অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে। সে ছিল নিওলিথিক যুগ, যখন মানুষ চাষের মধ্য দিয়ে ঘন সমাজবদ্ধ হতে শুরু করেছে।
আদি সময়ের গুটিবসন্ত, হাম, পোলিও, প্লেগ ইত্যাদি থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দী ও তার পরে এড্স (এইচআইভি) ভাইরাস, ইবোলা ভাইরাস ইত্যাদি পর্যন্ত তার আতঙ্ক ছড়ানোর জয়যাত্রা অবিরাম। এর মধ্যে মানুষকে চাঁদমারি করে শ্বাসযন্ত্র আক্রমণকারী ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ঘটিয়েছে বেশ কয়েকটি মহামারি। প্রকৃতিতে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য ভাইরাসরা জিনের বিবর্তনমুখী চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তা ঘটায় জিনের মিউটেশন এবং রিএসর্টমেন্ট বা জিনের পুনর্বিন্যাস ইত্যাদির মাধ্যমে। এই পুনর্বিন্যাস ঘটে অন্য ভাইরাসের সংস্পর্শে এসে তার সঙ্গে রাসায়নিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে। এ ভাবেই সে নতুন ও অচেনা রূপ ধরে তছনছ করে দেয় মানুষের স্বাস্থ্যের সংসার।
সম্প্রতি পৃথিবী জুড়ে আতঙ্ক যে ভাইরাসকে কেন্দ্র করে সেটি একটি করোনাভাইরাস। তার উৎপত্তি চিনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। ২০১৯ সালের শেষ দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিন সরকারের কাছ জানাল, এই নতুন ভাইরাসে নিউমোনিয়া আক্রান্তের খবর। তার এক সপ্তাহ পরে জানা গেল তার পরিচয়। আপাতত তার নাম রাখা হয়েছে ২০১৯ নভেল করোনাভাইরাস ২০১৯ এনসিওভি। ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো এই ভাইরাসটিরও আক্রমণ ও সংক্রমণস্থল শ্বাসযন্ত্র বা ফুসফুস। প্রকৃতিতে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি বহু যুগ ধরেই। যদিও এটি আবিষ্কৃত হয় ১৯৬০ সালে। এটির কেন্দ্রে আছে আরএনএ জিনোম যা আরএনএ ভাইরাসদের মধ্যে দীর্ঘতম জিনোম। করোনা শব্দটির অর্থ জ্যোতির্বলয় অথবা পুষ্পমুকুট। ভাইরাসের পৃষ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসা দন্ডাকৃতি প্রোটিনেরাই ভাইরাসটিকে এই চেহারা দিয়েছে। করোনাভাইরাসঘটিত অসুখ প্রধানত স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখিদের অসুখ। এটির চারটি উপশ্রেণি, আলফা, বিটা, গামা এবং ডেলটা। মানুষকে আক্রান্ত করার ক্ষেত্রে ১৭-১৮ বছর আগে পর্যন্ত জানা ছিল এর চার সদস্যের কথা। ২২৯ই এবং এন এল৬৩ আলফাকরোনাভাইরাস এবং ওসি৪৩ এবং এইচকেইউ১ বিটাকরোনাভাইরাস। এরা কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে একেবারেই বিপজ্জনক ছিল না। এদের দৌড় ছিল সাধারণ সর্দি-জ্বরের প্রকোপ সৃষ্টি করা পর্যন্ত। কিন্তু ২০০২ সালে এবং তার পরে ২০১২ সালে করোনাভাইরাস বিবর্তন দেখা গেল। নতুন চেহারায় ঘটিয়ে ফেলল দু’টি মারাত্মক আন্তর্দেশীয় মহামারি বা প্যানডেমিক। ২০০২ সালে ঘটল সার্স (সিভিয়ার অ্যাকাউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম)। এটির জন্য দায়ী ছিল সার্স করোনাভাইরাস। উৎপত্তিস্থল ছিল দক্ষিণ চীনের গুনাডং প্রদেশ। প্রায় ৩৭টি দেশে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৮,০৯৮ জন। মৃত্যুর হার ছিল শতকরা ৯.৬ ভাগ। এতে শ্বাসযন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে আন্ত্রিক সংক্রমণের ঘটনাও ছিল।
আবার ২০১২ সালে প্রধানত সৌদি আরব থেকে শুরু হল মার্স (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম) এর তাণ্ডব। এটির জন্য দায়ী ছিল মার্স করোনাভাইরাস। ২৭টি দেশ জুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ২,৪৯৪ হলেও মৃত্যুর হার ছিল ভয়ঙ্কর, শতকরা ৩৪.৪ ভাগ।
এ বার চিনে নববর্ষের বা বসন্ত উৎসব ছিল ২৫ জানুয়ারি। ডিসেম্বরের শেষ থেকে যখন তার প্রস্তুতিপর্ব চলছে, সেই সময়েই হানা দিল করোনাভাইরাস শ্রেণির সপ্তম এবং নতুনতম সদস্য তথা তুতো ভাই ২০১৯ নভেল করোনাভাইরাস। উৎস উহান শহরের সি-ফুড মার্কেট।
এই শেষ তিনটি করোনাভাইরাসই দেখা গেল জুনোটিক। অর্থাৎ মনুষ্যেতর প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমণযোগ্য হয়ে উঠছে। বিবর্তনের তাগিদে এ ভাবেই প্রজাতি-নির্দিষ্ট হয়ে থাকার বাধাকে অতিক্রম করে ভাইরাস নিজের পরিবর্তন ঘটিয়ে বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে মানুষের কাছে।
সার্সভাইরাসের প্রথম বাহক ছিল বাদুড়। তার পরে তা গন্ধগোকুল বা রেকুন কুকুরকে বাহকের মাধ্যমে (পশুবিক্রির বাজারে) সংক্রামিত করে মানুষকে। মার্স বাদুড় থেকে উটের মাধ্যমে সংক্রামিত করেছিল মানুষকে। গত ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘জার্নাল অব মেডিক্যাল ভাইরোলজি’তে প্রকাশিত তত্ত্ব অনুসারে চিনের নভেল করোনাভাইরাসটি এসেছে বাদুড় থেকে সাপের মাধ্যমে। যদিও, এটি এখনও বিতর্কিত, সর্বস্তরে মান্যতা পায়নি।
আক্রান্ত প্রথম ৪১ জন রোগীকে নিয়ে ২৪ জানুয়ারি ল্যানসেট পত্রিকায় গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন চিকিৎসক চাওলিন হুয়াং ও তাঁর গবেষক দল। তাতে ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের প্রধান উপসর্গ ছিল শুকনো কাশি, জ্বর, ব্যথা ও ক্লান্তি। ওই পত্রিকাতেই প্রকাশিত আর একটি গবেষণাপত্র চিকিৎসক চ্যান ও তাঁর গবেষক দল জানায়, শেনঝেন শহর থেকে উহান-এ হাসপাতালে দর্শনার্থী হিসেবে গিয়ে ফিরে আসা এক পরিবারের ছ’জনের আক্রান্ত হওয়ার কথা। তার মধ্যে এক জন না গিয়েও পরে আক্রান্ত হয়েছেন। এটি ভাইরাসটির মানুষ থেকে মানুষে সংক্রামিত হওয়ার কথা নিশ্চিত করে।
এই অসুখের উপসর্গ ফুসফুসে সংক্রমণের জন্য শুকনো কাশি, জ্বর, ব্যথা, ক্লান্তি ভাব, হাঁপানি ইত্যাদি। সংক্রমণের মাধ্যম বলা হচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সার্স বা মার্সের মতোই বায়ুবাহিত সর্দিকাশির ক্ষুদ্র জলকণা (ড্রপলেট সংক্রমণ)।
নভেল করোনাভাইরাসঘটিত অসুখের জন্য নির্দিষ্ট কোনও ওষুধ নেই। সংশ্লিষ্ট টিকার আবিষ্কার হলেও তা সময়সাপেক্ষ। রোগীর চিকিৎসা তাই উপসর্গ এবং শারীরিক অবস্থাভিত্তিক। তাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রোগ নিবারণের। সে জন্য আক্রান্ত দেশগুলিতে রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য কোয়ারেনটাইন-সহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত স্তরে যে কোন শ্বাসযন্ত্র সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সব আচরণবিধিই পালন করা উচিত। আক্রান্তের কাশি সম্পর্কিত শিষ্টাচারবিধি অবশ্য পালনীয়। যেমন, অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা, হাঁচি বা কাশির সময়ে ব্যবহারের পরে ফেলে দেওয়ার যোগ্য টিস্যু পেপার বা কাপড় ব্যবহার করা এবং পরে হাত ধুয়ে নেওয়া। সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে, হাত মুখ বা নাকের কাছে না নিয়ে যাওয়া, ঘন ঘন হাত ধোয়া, আক্রান্তের বা সেই পরিবেশের নিকট সংস্পর্শ এবং সম্ভব হলে ভিড়ের পরিবেশ এড়িয়ে যাওয়া, অরক্ষিত ভাবে পোষা বা বন্য পশুর সংস্পর্শে না আসা ইত্যাদি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চার ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী এই নভেল করোনা ভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যা চিনে ২০,৪৭১ জন এবং সারা বিশ্ব মিলিয়ে ২০,৬৩০ জন।চিনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ২.৭৮৮ জন। চিনের বাইরে এটি ছড়িয়েছে জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি-সহ ২৩টি দেশে।আতঙ্কের মধ্যেই আমাদের দেশের খবর এই যে চিন থেকে ফেরত আসার সূত্রে ভারতে তিন জনের এই সংক্রমণ ধরা পড়েছে।তিন জনই কেরলার এবং কেরলা সরকার এটি রাজ্যগত বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণা করেছেন।
তবে মন্দের মধ্যে ভরসার কথা দুটি। প্রথমত, এখনও আগের সার্স বা মার্স-এর এর চেয়ে এই ভাইরাসঘটিত অসুখে মৃত্যুহার অনেকটাই কম। দ্বিতীয়ত, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ২ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আর নতুন কোনও দেশে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। এখন স্বাস্থ্যসচেতনতা বজায় রেখে অপেক্ষা সুদিনের জন্য।
আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy