Advertisement
E-Paper

জনপদ কোচবিহার ধরে রেখেছে সম্প্রীতির আবহমান-অকৃত্রিম ছবি

সংকীর্ণ রাজনীতির অশান্ত এই সময়ে বেঁধে-বেঁধে থাকার চিরকালীন ছবি সযত্নে ধরে রেখেছে কোচবিহার। লিখছেন মনিমা মজুমদারলক্ষ্মীপুজোর পর থেকে এক মাস নিরামিষ খেয়ে রাসচক্রটি তৈরি করেন আলতাপ মিয়াঁ আর তাঁর পরিবারের লোকজন। তাঁর দাদু পান মহম্মদ মিয়াঁ এবং আলতাপের  বাবা আজিজ মিয়াঁও রাসচক্র তৈরি করতেন।

রাসমেলা।—নিজস্ব চিত্র।

রাসমেলা।—নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৯ ০২:৩৭
Share
Save

কোচবিহার উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জেলা শহর। সুদূর অতীত থেকে এই রাজশহর সম্প্রীতির অকৃত্রিম নিদর্শন বহন করে চলেছে। সারা বছর ধরে উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন উৎসব পালন করা হয়। তার শ্রেষ্ঠ উৎসবগুলির মধ্যে একটি রাসমেলা। এই উৎসবের মূল আকর্ষণ কোচবিহারের মদনমোহন মন্দির প্রাঙ্গণের রাসচক্রটি। ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস, এই রাসচক্র ঘুরিয়ে পুণ্যার্জন করা যায়। এটি হিন্দুদের উৎসব, অথচ বংশানুক্রমিক ভাবে রাসচক্র তৈরির কাজ সামলে আসছে এক মুসলিম পরিবার।

লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে এক মাস নিরামিষ খেয়ে রাসচক্রটি তৈরি করেন আলতাপ মিয়াঁ আর তাঁর পরিবারের লোকজন। তাঁর দাদু পান মহম্মদ মিয়াঁ এবং আলতাপের বাবা আজিজ মিয়াঁও রাসচক্র তৈরি করতেন। কোচবিহার জেলার বাসিন্দারা খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে চলেন বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই রীতিকে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এর চেয়ে ভাল উদাহরণ আর কীই-বা হতে পারে! মুসলিম পরিবারের হাতে তৈরি রাসচক্র ঘুরিয়ে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ পুণ্যার্জনের পথে হাঁটেন। এ শহর ধরে রেখেছে মিলনের এমনই উজ্জ্বল এবং শিক্ষণীয় ছবি।

ব্যক্তিগত স্তর থেকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়— প্রতিটি ক্ষেত্রেই উন্নতি এবং অগ্রগতির জন্য সম্প্রীতি বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য অবশ্যই।

মানুষ সৃষ্টির সূচনাপর্বে কোনও ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা গোত্রভেদ ছিল না। ফলে তখন সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটেনি কোথাও। সমাজ আর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শুরু বিভাজন। সেই সূত্রেই ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, জাতি, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদির প্রকাশ। নিজ নিজ ধর্মের প্রতি অতিরিক্ত রক্ষণশীলতায় জন্ম নিল সাম্প্রদায়িকতার বীজ। সে বীজ বিষবৃক্ষের আকার নিয়েছে এবং নিয়ে চলেছে বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের কোচবিহার ব্যতিক্রমী। সম্প্রীতিই এই জনপদের ধর্ম।

কোচবিহার শহরের অনতিদূরে অবস্থিত দেওয়ানহাট গ্রাম। সে গ্রামের বাজার এলাকায় একটি প্রাঙ্গণে পাশাপাশি রয়েছে কালীমন্দির এবং পিরবাবার ধাম। ছোট-বড় যে কোনও শুভ কাজে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মানুষ মন্দির এবং পিরের ধাম, দু’টিতেই পুজো দেন, প্রার্থনা করেন। দীপাবলি উৎসবে পিরবাবার ঘরে দীপ না জ্বালিয়ে কেউ নিজের আঙিনায় প্রদীপ জ্বালান না। এই বিশ্বাস যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে একই ভাবে। এখনও এই গ্রামে হিন্দু মা পিরের মাটি ছুঁইয়ে দেন সন্তানের কপালে। মুসলিম মা প্রার্থনা করেন দীপাবলির রাতে। সন্তানের মঙ্গলকামনায়। এই দৃশ্য প্রমাণ করে যে, পৃথিবীর কোনও বিভেদ-ভাবনাই মায়ের বিশ্বাস ভাঙতে পারে না।

ব্রিটিশ শাসক হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার জন্য হাজারো চেষ্টা করেছিল। তারও আগে উপমহাদেশে কিছু কিছু কোন্দল ঘটেছে। বিভেদের চেষ্টাও করা হয়েছে কখনও কখনও। সেই চক্রান্তের কিছু সফলও হয়েছে। তা সত্ত্বেও আজও মুসলিম ভাইয়ের কবরে মাটি দেন হিন্দু ভাই। হিন্দু মায়ের শেষযাত্রায় কাঁধ মেলান মুসলিম ছেলে। কোচবিহারই তার শাশ্বত প্রমাণ।

কোচবিহার জেলার যে সমস্ত মসজিদ এবং মাজার আছে, তাদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা যায় মহারাণিগঞ্জের তোর্সাপিরের ধাম এবং হলদিবাড়ির ত্রক্রাশুল পিরের মাজারের নাম। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ তোর্সাপিরের ভক্ত ছিলেন। তাঁরই উৎসর্গীকৃত সাত বিঘা জমিতে তোর্সাপিরের মসজিদ বা মাজার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

কোচবিহার রাজবংশের অন্যান্য রাজারাও সব ধর্মকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। প্রতি ফাল্গুন মাসে হুজুর সাহেবের মেলা বসে। এখানে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ মাজারে এসে ফুল, চাদর, ধূপকাঠি উৎসর্গ করে যান। শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, অসম বা প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকেও এই মেলায় নানা ধর্মের মানুষ যোগ দেন। সর্বধর্ম সমন্বয়ের সুন্দর উপমা হল উত্তরবঙ্গের হুজুর সাহেবের মেলা।

আমরা কখনওই বলি না যে, হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ উৎসব হল দুর্গোৎসব বা ইদ মুসলিমদের শ্রেষ্ঠ উৎসব। আমরা চিরকাল বলতে-শুনতে অভ্যস্ত যে, বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো আর ইদ। শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তের বাঙালি দেবীর আরাধনায় ব্রতী হন, ইদের উৎসবে মেতে ওঠেন। মেতে ওঠেন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষ। কোচবিহার জেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। পুজোয় ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সবাই নিজের নিজের ক্লাবকে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দেওয়ার সুস্থ প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এটি এখানকার খুব পরিচিত একটি দৃশ্য। নতুন জামাকাপড় কেনার ভিড়েও আলাদা করে চেনা যায় না কোনও সম্প্রদায়কে। একই ছবি দেখা যায় ইদে। উৎসবের আলোয় খুশিমাখা মুখ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

চার দিকের অনেক অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্যে আমাদের কোচবিহারের এই ছোট ছোট সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃশ্যগুলি মানবধর্মের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হয়ে দিশা দেখায়। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’— চণ্ডীদাসের এই উপলব্ধি চিরকালীন এবং চিরপ্রাসঙ্গিক। সংকীর্ণ রাজনীতিমুখর অশান্ত এই সময়ে প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য হল এই সুমহান দর্শনকে সার্থক করে তোলা। তা হলেই ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান’-এর এই দেশ কাঙ্ক্ষিত অর্থে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ হয়ে থাকতে পারবে, হয়ে উঠতে পারবে ‘সকল দেশের সেরা’।

(লেখক কোচবিহারের বাণেশ্বর জিএসএফ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

Cooch Behar Harmony Hindu Muslim religion

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।