Advertisement
E-Paper

মনের জানালা

প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত সম্পর্ককে দেশের ভিতরে স্বদেশমূলক সঙ্কীর্ণ উত্তেজনা সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করা হইতেছে।

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২০ ০০:০৭
Share
Save

জানালা-দরজা বন্ধ করিয়া ভ্রম রুখিবার চেষ্টা করিলে সত্যও যে প্রবেশের পথ পাইবে না, বিদ্যালয়-পাঠ্য এই কথাটি রাজনীতির কারবারিদের মনে করাইয়া দেওয়া ভাল। ভারতীয় রাজনীতি ও পররাষ্ট্র নীতি দিনে দিনে দিশাহীনতায় পর্যবসিত হইতেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত সম্পর্ককে দেশের ভিতরে স্বদেশমূলক সঙ্কীর্ণ উত্তেজনা সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করা হইতেছে। উত্তেজনা বস্তুটি এমনই যার জন্য নিত্য-নিয়মিত কাষ্ঠাহুতি প্রয়োজন, নতুবা উত্তেজনা ঝিমাইয়া পড়ে। ন্যাশনাল-উত্তেজনা ঝিমাইলে জনসাধারণ সরকারের নিকট হইতে কী পাইল আর কী পাইল না তাহার হিসাব কষিতে শুরু করে। বয়কট বস্তুটি চিরকালই উত্তেজনাপ্রদায়ী। অপরের নির্মিত বস্তু-সামগ্রী গ্রহণ না করিবার মধ্যে মহা আত্মতৃপ্তি জাগে। আর মাদক সেবনের তৃপ্তির ন্যায় ধাপে ধাপে সেই তৃপ্তিকে বাড়ানো যায়। প্রথমে বিলিতি-বর্জন, তাহার পরে বিলিতি-দ্রব্যে অগ্নি সংযোগ, যাহারা বিলিতি ব্যবহার করিতেছে তাদের নিকট হইতে দ্রব্যাদি ছিনাইয়া লওয়া, তাহাদের উপর বলপ্রয়োগ করা, ইত্যাদি। দলবদ্ধ ভাবে এই কাজ করিলে নিজেদের বেশ স্বদেশ-সেবক বলিয়াও বোধ হয়, স্বদেশের নামাবলি গায়ে থাকে বলিয়া কেহ গুন্ডামি বলে না, বরং গুন্ডামি দেখাইয়াও ভক্তিশ্রদ্ধা পাওয়া যায়। দেশের নামে লঙ্কাকাণ্ড বাধাইয়া ‘জয় শ্রীরাম’ হাঁক পাড়া যায়।

লঙ্কাকাণ্ডের বিষয়টি সে কালে রবীন্দ্রনাথ কেবল দস্তুরমতো উপলব্ধি করেন নাই, তাহার বিপত্তি দেশবাসীকে বুঝাইতে চাহিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, ন্যাশনাল এডুকেশনের নামে যদি পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বর্জন করা হয় তবে তো পিছন দিকে অগ্রসর হইবার পথই প্রস্তুত হয়। তাই তাঁহার বিশ্বভারতী স্বদেশকে যেখানে গ্রহণ করিবার সেখানে গ্রহণ করিয়াছিল। বিদেশকে কুলার বাতাস দিয়া দূর করে নাই। বিস্তর মানুষ এই কারণে তাঁহার উপর চটিয়াছিলেন। আশ্চর্য যে সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলিতেছে। এখনও স্বদেশির নামে পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বদলে সহসা দেশজ-জ্যোতিষ আর ভেষজ-ঔষধকেই যথার্থ ভারতীয় বলিয়া গর্ব করা হইতেছে। আমাদের দেশে কিছু ছিল না তাহা নহে, কিন্তু অকস্মাৎ আমাদের দেশেই যেন ‘সব’ ছিল বলিয়া বাহিরের মুখের উপর জানালা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইতেছে। ইহা আত্মহনন ভিন্ন কী। সত্যজিতের সিধু-জ্যাঠা ফেলুকে মনের জানালা খুলিয়া রাখিতে বলিয়াছিলেন। বিশ্বভারতীর কলাভবনে বিনোদবিহারীর ছাত্র সত্যজিৎ, যে বিনোদবিহারী বলিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁহাকে এবং রামকিঙ্করকে নন্দলালের স্বদেশি শিল্পের আটচালা অতিক্রম করিতে উৎসাহ দিতেন। যখন বিলিতি বয়কট ও বিলিতি পোড়ানোর উৎসব চলিতেছিল তখন রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, উপযুক্ত বিকল্প স্বদেশি দ্রব্য রহিয়াছে তো? বড়লোকেরা শখ করিয়া বিলিতি বর্জন করিতেই পারেন, কিন্তু দরিদ্র মানুষদের যদি বিলিতির বদলে বেশি দামে অচল স্বদেশি দ্রব্য ক্রয় করিতে হয় তাহা হইলে চলিবে কেন? বিলিতি বর্জনের চাপে দরিদ্র-সাধারণ যে প্রাণে মরিবেন। নিজের এই ঐকান্তিক উপলব্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানপ্রসূত আপত্তি ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে প্রকাশ করিয়াছিলেন। ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ মাথায় এক আধদিন শখ করিয়া তুলিয়া লওয়া যায় কিন্তু দেশজ উৎপাদন ব্যবস্থার হাল না-ফিরাইয়া কেবল বর্জনের কথা বলিলে দেশের উন্নতি হয় না। কেবল বর্জনে অর্থনীতি বাঁচে না। যে কেবলই বয়কট করিতে চায় সে নেতির পথে অগ্রসর হইতেছে, গঠনমূলক স্বাদেশিকতার দায় সে গ্রহণ করিতেছে না।

দেশের সীমান্তের উত্তেজনা প্রশমিত হওয়া দরকার। দেশের কূটনীতিও গঠনমূলক হওয়া জরুরি। কিন্তু সেই কাজ করিতে গিয়া চৈনিকতার স্পর্শ মাত্রেই বর্জন করিতে হইবে, এই দাবি শেষ অবধি ভয়ঙ্কর ব্যাধি হইয়া উঠিতে পারে। বর্জন করিতে করিতে কত দূর? চিনের খাদ্য, চিনের অ্যাপ, চিনের পদ্য, চিনের ভাষা তালিকা দীর্ঘতর হইতে পারে। শেষে হয়তো অতি-উৎসাহী স্বদেশ-ব্রতীরা বিশ্বভারতীর ‘চীন-ভবন’-এও হামলা করিবেন। সকলকেই চিনের দালাল বলিয়া দাগাইয়া দিবেন। বিষয়টি কেবল চিন বিষয়ে আটকে থাকিবে তাহাও না হইতে পারে। রাজনীতিতে যাহারা অপছন্দ করিত, তাহাদেরই সবংশে বর্জন করা হইতে পারে। অপছন্দ মানেই অপর পক্ষকে কলুষিত ও বর্জনযোগ্য বলিয়া মনে করা হইতে পারে। মনের জানলা চিরতরে বন্ধ হইতে পারে। একবিংশ শতকের ভারতীয় কি তেমনই হইতে চাহে?

India-China Clash Nationalism

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}