ফাইল চিত্র
চিনে নির্মিত স্মার্টফোনের স্ক্রিনে টাইপ করা হইল বজ্রনির্ঘোষ— চিনকে বয়কট করুন! ভূপৃষ্ঠে জলের ভাগ শতকরা যত, ভারতে স্মার্টফোনের বাজারে চিনের দখল তাহার কিঞ্চিৎ অধিক। ঔষধ উৎপাদনের কাঁচামালের বারো আনা আমদানি হয় চিন হইতে। বস্তুত, প্রাত্যহিক ব্যবহার্য পণ্যের তালিকায় চিনের স্পর্শহীন বস্তু খুঁজিয়া পাওয়া ভার। অতি বিপজ্জনক ‘পরনির্ভরশীলতা’— কিন্তু, ইহাই ভারতের বাস্তব। যাঁহারা বাড়ির বারান্দা হইতে চিনা টেলিভিশন সেট নীচে ফেলিয়া দিতেছেন, যাঁহারা স্বদেশির ওম পোহাইতে চিনা পণ্যে অগ্নিসংযোগ করিতেছেন, তাঁহারা উগ্রজাতীয়তাবাদী আবেগের তাড়নায় দুইটি কথা ভাবিয়া দেখেন নাই। এক, কেন এই পণ্য বা কাঁচামালগুলি ভারতে নির্মিত হয় না; দুই, চিনের পণ্য বয়কট করিলে তাহার ফল কী হইবে। চিন হইতে পণ্য আমদানি করা হয়, তাহার কারণ, হয় ভারত এই পণ্য নির্মাণ কার্যত বন্ধ করিয়া দিয়াছে— ঔষধের কাঁচামালের ক্ষেত্রে যেমন, নয়তো ভারতীয় পণ্যের দাম অনেক বেশি। চিনের পণ্য বয়কট করিলে, অথবা চিনই ভারতে পণ্য রফতানি বন্ধ করিলে (তাহা সম্ভব— জাপানের সহিত ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে চিন এক বার সে দেশে পণ্য রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছিল) হয় অন্য কোনও দেশ হইতে তাহা অধিকতর মূল্যে আমদানি করিতে হইবে, নতুবা অপেক্ষা করিতে হইবে, কবে ভারতে তাহার উৎপাদন আরম্ভ হয়। টিভি-র জন্য না হয় দেশপ্রেমীরা অপেক্ষা করিতে পারিবেন— কিন্তু, দুই-এক বৎসর ঔষধ না খাইলেও রোগীকে বাঁচাইয়া রাখিবার মতো দ্রব্যগুণ অতিজাতীয়তাবাদে আছে কি? সন্দেহ হয়।
চিনের মোট আড়াই লক্ষ কোটি ডলার মূল্যের রফতানির মাত্র তিন শতাংশ ভারতে আসে। সে দেশের ভান্ডারে বিদেশি মুদ্রার পরিমাণ তিন লক্ষ কোটি টাকা, এবং বাণিজ্যখাতে বিপুল উদ্বৃত্ত। ফলে, চিনের পণ্য বয়কট করিয়া তাহাদের ভাতে মারিবার কার্যক্রমটি আইটি সেলের হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডে সুন্দর, বাস্তবে নহে। বরং, তাহাতে ভারতের ক্ষতি। এই ক্ষতির প্রধান কারণ চিনের উপর অতিনির্ভরশীলতা। তাহা ভাঙা প্রয়োজন, সন্দেহ নাই। কিন্তু, বারান্দা হইতে টিভি ফেলিয়া সেই কাজটি হইবে না। তাহার দুইটি পথ— একই সঙ্গে দুইটি পথেই চলা বিধেয়। এক, অন্যান্য দেশের সহিত বাণিজ্যিক সম্পর্কবৃদ্ধি— বিবিধ কূটনৈতিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও যে পথে হাঁটিবার প্রবণতা, এমনকি ব্যগ্রতা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে দেখা গিয়াছে, ভারত-মার্কিন বাণিজ্যবৃদ্ধি যাহার প্রমাণ। দুই, উৎপাদন ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া— যে দিকটিতে কিন্তু নরেন্দ্র মোদী-জমানার ব্যর্থতা পাহাড়প্রমাণ। মেক ইন ইন্ডিয়া বলা হউক, কিংবা আত্মনির্ভরশীলতা, নামে কী বা যায় আসে— এই জমানায় উৎপাদন-ক্ষেত্রে ভারত ক্রমেই পিছাইয়া পড়িয়াছে।
দেশের বাজারে চিনের আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই প্রয়োজন, চিনের বাজারে আরও বেশি জায়গার ব্যবস্থা করিতে কূটনৈতিক দৌত্যও বিশেষ জরুরি। কিন্তু খেয়াল রাখিতে হইবে, কুড়ালটি যেন নিজের পায়ে না আসিয়া পড়ে। যে ক্ষেত্রগুলি ভারতের নিকট কৌশলগত কারণে তাৎপর্যপূর্ণ, সেখানে চিনের বাণিজ্যিক আগ্রহকে নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে; যেখানে চিনের অকুশলতা প্রমাণিত, সেই ক্ষেত্র হইতে চিনকে ছাঁটিয়াও ফেলিতে হইবে। কিন্তু, সেই কাজগুলি করিতে হইবে ঠান্ডা মাথায়, স্পষ্ট পরিকল্পনাসমেত— উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগান গর্জাইতে গর্জাইতে সে কাজের কানাকড়িও সাধিত হইবে না। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অতিজাতীয়তার তাস, এবং বিদেশনীতিতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির তাস খেলিবার বিপদ এখানেই। উৎকট বয়কট-বাদ্য বাজানো থামাইয়া বিবেচনাসম্পন্ন কূটনীতিই চিনসঙ্কট মোকাবিলার একমাত্র পথ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy