প্যাংগং লেকের তীরে লুকুং পোস্ট। ছবি: পিটিআই।
লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশের দাবি নিয়ে চিন নতুন করে সক্রিয়তা শুরু করেছিল ২০০৬ সালে। তৎকালীন চিনা প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের ভারত সফরের ঠিক আগে। সে সময়ই নতুন করে সীমান্তে অনুপ্রবেশও শুরু হয়। চিনের এমন আগ্রাসী এবং অনমনীয় অবস্থানের জেরে অবনতি হয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলির ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা দিতেও অস্বীকার করে চিন! যুক্তি ছিল, ওই এলাকাগুলি চিনের তাই সেখানকার বাসিন্দারাও চিনা! পাক অধিকৃত কাশ্মীরে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির তৎপরতা এবং কারাকোরাম হাইওয়ে নির্মাণ ঘিরে সে সময় আপত্তি তুলেছিল ভারত। ২০০৮ সালে তিব্বতের রাজধানী লাসার চিন বিরোধী বিদ্রোহের সময় উত্তজেনার আঁচ এসে পড়ে সীমান্তে। সে বারও দু’পক্ষ মুখোমুখি সেনা মোতায়েন করেছিল। এ বারের মতো ‘স্ট্যান্ড অফ’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তখনও। চিন সে সময় তিব্বতে যুদ্ধ পরিস্থিতির ধাঁচে সামরিক পরিকাঠামো সম্প্রসারণের কাজ শুরু করে। জবাবে ভারতকেও বিমানবাহিনী মোতায়েন করতে হয়। দু’টি নতুন সেনা ডিভিশন (মাউন্টেন স্ট্রাইক কোর) গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। তাইল্যান্ডের হুয়া হিনে আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনের সময় মনমোহন সিংহের সঙ্গে তৎকালীন চিনা প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাওয়ের পার্শ্ববৈঠকে কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল। আঞ্চলিক শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখা, কৌশলগত অংশীদারিত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি এই তালিকায় ছিল আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত নিয়ে ‘ছোটখাটো মতপার্থক্য’ দূর করার প্রসঙ্গ।
তিব্বতে ফের ২০১০-’১১ সালে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। অবনতি হয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেরও। সে সময় দলাই লামার তাওয়াং সফরের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল চিন। তিব্বতি বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু তাঁর ওই সফরেই প্রথম বার তাওয়াংকে ‘ভারতের অংশ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। চিনের পক্ষে বিষয়টি ছিল বেশ স্পর্শকাতর। কারণ, ষষ্ঠ দলাই লামার জন্মস্থানটি নিয়ে তিব্বতিতের ভাবাবেগ রয়েছে যথেষ্টই। ঘটনাচক্রে সে সময়ই তিব্বতে চিনা শাসনের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ চলছিল। চিন সে সময়ই ভারতকে সংযম বজায় রাখা এবং বিতর্কিত অঞ্চলে নতুন করে সমস্যা খুঁচিয়ে না তোলার জন্য সরকারি ভাবে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। সীমান্ত চিহ্নিত করার বিষয়ে দু’দেশ কখনোই মীমাংসায় পৌঁছতে পারেনি। শুধু লাদাখ নয়, পূর্ব সেক্টর সম্পর্কেও চিনের অবস্থান স্পষ্ট। অতীতে ওই এলাকার উন্নয়নের জন্য ভারতের তরফে ২,৯০০ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক ঋণের আবেদনেও বাগড়া দিয়েছিল চিন।
২০১৪ সাল এবং তার পরবর্তী সময়ে অরুণাচল, ডোকলাম এবং লাদাখে চিনা সেনার অনুপ্রবেশ ঘিরে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। একাধিক এলাকায় দু’পক্ষের সেনা মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে। ডোকলাম মালভূমিতে চিনের দখলদারি এবং রাস্তা নির্মাণের কাজ ভারত বন্ধ করায় বেজিংয়ের মুখ পুড়েছিল। সে সময় থেকেই ভারতীয় সেনা ধারাবাহিক ভাবে পিএলএ-র সীমান্ত লঙ্ঘন এবং প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় আক্রমণাত্মক আচরণের মোকাবিলা শুরু করে। উহান এবং মমল্লপুরমে মোদী-চিনফিং বৈঠকের পরেও সীমান্ত পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
আরও পড়ুন: শুধু লাদাখ নয়, ভারতের আরও অনেক এলাকাই চিনের টার্গেট
তবে লাদাখে সবচেয়ে হিংসাত্মক ঘটনাগুলি ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। গত মে মাসে প্যাংগং লেকের ধারে এবং জুনে গালওয়ান নদীর উপত্যকায় পেট্রোল পয়েন্ট-১৪-য়। প্যাংগং লেকের উত্তরে ফিঙ্গার এরিয়ায় এলএসি পেরিয়ে প্রায় আট কিলোমিটার অন্দরে ঢুকে এসেছে চিনা ফৌজ। আগে তাদের গতিবিধি ফিঙ্গার এরিয়া-৮-এ সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার ৭, ৬, ৫ পেরিয়ে ফিঙ্গার এরিয়া-৪ পর্যন্ত তারা চলে এসেছিল। উঁচু এলাকাগুলিতে অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি ফিঙ্গার এরিয়া-৪ এবং ৩-এ ভারতীয় সেনার টহলদারির পথেও বাধা দিয়েছিল তারা। ভারতীয় সেনারা তাদের পিছু হটতে বললে লাঠি, রড, পাথরের মতো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা চড়াও হয়েছিল। তবে ২০০৫ সালের সীমান্ত সমঝোতা (রুল অফ এনগেজমেন্ট) মেনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি।
লাদাখমুখী ভারতীয় সেনার কনভয়। ছবি: রয়টার্স।
মে মাস থেকে শুরু হওয়া চিনা অনুপ্রবেশের জেরেই গালওয়ানে সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানে টহল দিতে গিয়ে ভারতীয় বাহিনী হামলার মুখে পড়ে। সংঘর্ষে দু’পক্ষেরই একজন করে কর্নেল স্তরের অফিসার নিহত হন। শহিদ হন মোট ২০ জন ভারতীয় সেনা। পিএলএ-র তরফে হতাহতের সংখ্যা সম্ভবত শতাধিক ছিল। জানা গিয়েছে, ভারতীয় ফৌজের পাহাড়ে ধস নামানোর কৌশলে মারা পড়ে বহু চিনা সেনা। সংঘর্ষের পরে দু’তরফের উচ্চপদস্থ সেনাকর্তারা হস্তক্ষেপ করেন। বহু বাধাবিপত্তির পরে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার ভিত্তিতে পরিস্থিতিতে রাশ টানা সম্ভব হয়।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, চিনের তরফে ওই এলাকাগুলিতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র-সহ দু’টি মোটর রাইফেল ডিভিশন মোতায়েন করা হয়েছে। পেশিপ্রদর্শন করে এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার লক্ষ্যে প্রস্তুত রয়েছে পিএলএ ‘বর্ডার ডিফেন্স ট্রুপে’র একটি ব্রিগেডও। পাশাপাশি, তিব্বত ও শিনজিয়াং মিলিটারি ডিস্ট্রিক্টের অন্তর্গত বাহিনীর উদ্দেশ্যে সতর্কতা জারি হয়েছে। সেখানে মোতায়েন বিমানবাহিনী এবং ক্ষেপণাস্ত্র ইউনিটগুলিকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে।
তবে সরকার বা সেনাবাহিনী যখন চাপের মুখে থাকে, তখন এমন পদক্ষেপ করা অনুচিত। ভারতীয় কর্তারা প্রাথমিক ভাবে পরিস্থিতির গুরুত্ব আঁচ করতে পারেননি। ফলে পিএলএ-র কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সঠিক ভাবে সেনা মোতায়েন করা হয়নি। সময়োচিত তৎপরতাও দেখাতে পারেনি ভারতীয় সেনা। পাকিস্তানও ইতিমধ্যে গিলগিট-বালটিস্তানের উত্তরাঞ্চলে দু’ডিভিশন সেনা পাঠিয়েছে। উদ্দেশ্য, চিনকে সাহায্য করা। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বেশ কিছু জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গেও চিনের যোগসাজস রয়েছে। ভারতীয় সেনাকে চাপে ফেলতে চিন ওই জঙ্গিদের কাশ্মীর উপত্যকায় সক্রিয়তা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে বলেও জানা গিয়েছে।
দলাই লামা— ফাইল চিত্র।
পূর্ব সেক্টরে সিকিম এবং অরুণাচল প্রদেশে এলএসি-র ওপারে চিনা বাহিনীর তৎপরতারও খবর এসেছে। ভারত জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখে সেনা সমাবেশ বাড়ানোর পাশাপাশি অন্য সেক্টরগুলিতেও সতর্কতা বাড়িয়েছে। গালওয়ানে সংঘর্ষের পরে সেনা, কূটনীতিক এবং সরকারি স্তরের আলোচনার পরে দু’পক্ষের সেনা বিভিন্ন এলাকায় ‘চোখে-চোখ’ অবস্থান থেকে এক-দু’কিলোমিটার করে পিছিয়ে গিয়েছে। মাঝে তৈরি হয়েছে প্রায় তিন কিলোমিটারের বাফার জোন। যদিও পরিস্থিতি এখনও যথেষ্ট গুরুতর। চিনকে কোনও অবস্থাতেই বিশ্বাস করা যায় না। সে লাদাখের ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করেছে। যা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। বেজিং এখনও তার দাবিতে অনড়। বিপুল সংখ্যক চিনা ফৌজ সেখানে মোতায়েন রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র বাফার জোন তৈরি করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমান অবস্থান বজায় থাকলে আখেরে ফায়দা চিনেরই। তাই পিপলস লিবারেশন আর্মিকে মে মাসের আগের স্থিতাবস্থায় ফেরানো প্রয়োজন।
চিনের এমন আগ্রাসী আচরণের পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। করোনা অতিমারি নিয়ে ভারতের সরব হওয়া, একাধিক চিনা সংস্থার বরাত বাতিল, আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমী রাষ্ট্র-সহ বিশ্বজুড়ে চিনবিরোধী নানা অক্ষে নয়াদিল্লির সক্রিয় অংশগ্রহণ, জম্মু ও কাশ্মীরে ৪৭০ এবং ৩৫-এ ধারা বিলোপ এর অন্যতম কারণ। পাশাপাশি, ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখে পাক অধিকৃত কাশ্মীর ও আকসাই চিন পুনরুদ্ধারের বার্তা এবং লাদাখে এলএসি বরাবর ভারতের পরিকাঠামো উন্নয়নও বেজিংয়ের উষ্মার কারণ। তার ধারণা, ভারতের এই উদ্যোগ চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের সামনে বড় বিপদ। তাই তা চিনের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তা ছাড়া, ডোকলাম কাণ্ডের পরে প্রতিপত্তি পুনরুদ্ধারের সুযোগ খুঁজছিল চিন। ভারতের দুর্বলতা দেখে তারা সুযোগ নিতে চেয়েছে। ভারত যদি চিনের এই তৎপরতা বন্ধ করতে না পারে তবে ফের তৈরি হবে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট।
দ্বিতীয় অংশ এখানেই শেষ। তৃতীয় অংশে আলোচনা করব দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান না হওয়ার মূল কারণগুলি নিয়ে।
আরও পড়ুন: চিন: আলোচনায় কী হবে, নিশ্চিত নন রাজনাথই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy