অঙ্কন: কুনাল বর্মণ।
ইতিকথা
ছোটোপিসিমা দিল্লি থেকে খুব বড় একটা বিলেতি পুতুল এনে দিয়েছেন খুকুকে। সেটা দেখামাত্র বাড়ির ছোটরা ছোড়াছুড়ি খেলতে লাগল উঠোনে। এক সময় পুতুলের মুন্ডুটা গেল খুলে। সেটা নিয়ে সমিদা আর পুলদার সে কী ফুটবল খেলা! খেলতে খেলতে পুলদার এক শটে মুন্ডু গিয়ে পড়ল কুয়োর মধ্যে। তখন ধড়টা নিয়ে পুলদা ‘এটা রেখে আর কী হবে’ বলে হাত-পাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিল কুয়োর জলে।
পুলদা অর্থাৎ পুলুর সঙ্গে পিঠোপিঠি বোন খুকুর ঝগড়া মারামারি লেগেই থাকে। খুকুও কম যায় না। একবার পুলুর বুকে এমন খামচে দিল যে, অনেক বড় বয়স পর্যন্ত পুলুর বুকে আঁচিলের মতো গুটি বেঁধে রইল। শেষে অপারেশন করে বাদ দিতে হয় সেই আঁচিল। খুকু মাস্টারমশায়ের কাছে গান শিখতে বসলে পুলু হারমোনিয়ম টেনে নিয়ে নিজেই আগে গান তুলে নেয় গলায়। পাশের বাড়ির ভোঁদুদার কাছ থেকে একদিন একটা ব্যাপার শিখে এল। খাওয়ার আগে পিঁড়িতে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে বসতে হয়। সেই দেখে মা আর দাদুর কী বকুনি!
পুলুর দাদু অর্থাৎ ঠাকুরদা ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় কেশনগরের খুব উঁচু দরের মানুষ। ধনবান, অভিজাত, বিদগ্ধ। শহরের নামকরা উকিল। গোয়াড়ি এলাকায় হাইস্ট্রিট থেকে সোনাপটি-মুখো রাস্তায় তাঁর ‘সুধা-নিলয়’ নামে দোতলা বাড়ি। তাঁর বড় মেয়ে তারার শ্বশুরমশায় হলেন স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। লোকে বলে, বাপ রে, ‘বাংলার বাঘ’-এর বেয়াই! তাঁর স্ত্রী সুধাময়ী, বিদ্যাসাগরের বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের মেয়ের বিধবা-বিবাহজাত কন্যা। সে কালে এমন মেয়েকে বিয়ে করা সোজা কথা ছিল না। শুধু কি তাই? মহাবিপ্লবী বাঘাযতীনের ছোট মামা তিনি। মামাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করার সময় প্রায় সমবয়সি ললিতকুমারের কাছেই তাঁর বিপ্লববাদে দীক্ষা। ১৯১০ সালে হাওড়া গ্যাং কেসে মামা-ভাগ্নে একসঙ্গে জেলও খেটেছেন।
ললিতকুমারের বড় ছেলে মোহিতকুমারও আইন পাশ করে কলকাতায় থেকে ওকালতি করেন। সপ্তাহ-শেষে বাড়িতে আসেন। তাঁর ক্লাস টেনে পড়ার সময় মারা গিয়েছেন মা সুধাময়ী দেবী। ফলে মোহিতকুমারের চার ছেলেমেয়ে, সম্বিৎ(সমি), সৌমিত্র(পুলু), অনুরাধা(খুকু) আর অভিজিতের ভালমন্দ দেখাশোনার ভার ললিতকুমারের। গুরুগম্ভীর রাশভারী ললিতকুমার খুব কড়া ধাতের মানুষ। বিশৃঙ্খলা একেবারে না-পছন্দ। কৃষ্ণনগর খুব সংস্কৃতিপ্রাণ শহর হলে কী হয়, সেখানে বখে যাওয়ার উপকরণও যথেষ্ট মজুত। তাই ললিতকুমারের ছিল কঠোর অনুশাসন। ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে দুরন্ত পুলুর দিকেই তাঁর বেশি নজর। দুষ্টুমির জন্যে শাস্তিও কম জোটে না তার। একবার বাইরে থেকে শিখে আসা খারাপ কথা বলে ফেলল বাড়িতে। জানতে পেরে একটা উঁচু রিংয়ের সঙ্গে পা বেঁধে পুলুকে ঝুলিয়ে রাখলেন ললিতকুমার।
তা বলে নাতি-নাতনিদের প্রতি বাৎসল্যও কম নয় তাঁর। নিজে পড়াশোনা, সংস্কৃতিকর্ম ভালবাসেন। কৃষ্ণনগরে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে মেয়েদের দিয়ে নাটকের অভিনয় করিয়েছেন, যে কালে তা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। নাতি-নাতনিদেরও এ সব বিষয়ে উৎসাহ দেন। বড়-জামাই রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব। প্রতি পুজোয় জামাইয়ের কলকাতার বাড়িতে তাঁর নিমন্ত্রণ বাঁধা। জামাই-বাড়ি গেলে নাতি-নাতনিদেরও সঙ্গে নিয়ে যান। সেখানে স্যর আশুতোষের বিশাল লাইব্রেরিতে দুই ভাই সমি আর পুলু বই পড়ে দিন কাটায়। বইয়ের প্রতি আগ্রহ তাদের খুব ছোটবেলা থেকেই। কৃষ্ণনগরের বাড়িতে জন্মদিনে মা-বাবা বই উপহার দেন। তাঁরা নিয়মিত বই কেনেন। সে সব পড়ে আলোচনা করেন বাড়িতে। বসু সাহিত্য মন্দিরের প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্রের কাহিনিগুলোতে বুঁদ হয়ে থাকে পুলু।
বই পড়ার সঙ্গে পুলুর যোগ হয়েছিল আবৃত্তি, গান আর নাটক। মা আশালতা দেবীর বাপের বাড়ি রবীন্দ্রচর্চার কেন্দ্র। বিখ্যাত রবীন্দ্রগানের শিল্পী সুচিত্রা মিত্র মায়ের পিসতুতো বোন। পুলুদের ছোটো মাসি। আশালতাও রবীন্দ্র-কবিতার ভক্ত। গলায় গান নেই বলে ছেলেমেয়েদের ঘুমোনোর আগে কবিতা বলেন ‘শিশু’ থেকে, ‘শিশু ভোলানাথ’ থেকে। সে সব কবিতা ঘুম-জাগরণের আবছায়া পেরিয়ে স্থায়ী হয়ে রয়ে যায় পুলুর ভিতরে। বাবা মোহিতকুমার কলেজবেলায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে আবৃত্তি করে মেডেল পেয়েছিলেন। তিনি খুবই ভাল আবৃত্তি করেন। সপ্তাহান্তে বাড়িতে এসে সান্ধ্য-আসরে ছোট ডেস্কের ওপর রবীন্দ্রনাথের ‘চয়নিকা’ রেখে তা থেকে কবিতা পড়েন। কখনও স্মৃতি থেকে বলেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের কবিতা। একদিন সেই আসরে বাবা আবৃত্তি করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’। সেই কবিতার করুণ আখ্যান পুলুর শিশুমনকে এমন ভাবে আচ্ছন্ন করল যে, সমস্ত রাত ভাল করে ঘুমই এল না।
ধূলিধূসর প্রাচীন শহরের রাস্তায় পুরসভার ঝাঁঝরি দেওয়া গাড়ি বিকেলে জল ছিটিয়ে যায়। সন্ধের শো-এর খানিক আগে থেকে একমাত্র সিনেমা হল ‘চিত্রমন্দির’-এ মাইকে গান বাজতে থাকে। তা শুনে সবাই বলে, ‘টকিতে গান দিয়েছে’। বেশির ভাগই রবীন্দ্রনাথের। পঙ্কজ মল্লিক, কে এল সায়গল অথবা কাননবালা দেবীর কণ্ঠে টকির গান শুনে বালক পুলুর প্রদোষকালীন বিষণ্ণতা গাঢ়তর হয়ে ওঠে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কাকা সুহৃদকুমার একদিন একটা দম দেওয়া ‘কলের গান’ কিনে আনলেন। তাতে দিলীপকুমার রায়, উমা বসু, রেণুকা সেনগুপ্ত, হরেন চট্টোপাধ্যায়, শান্তা আপ্তের নানা ধরনের গান বাজে। সন্ধেবেলা পুলু পড়ায় ফাঁকি দিয়ে রেকর্ড চালিয়ে গান শোনায় মগ্ন হয়ে যায়।
সে চিৎকার করে বাড়িতে কবিতা আওড়ায়, গান করে। কোথাও নাটক দেখে এসে ভাবভঙ্গি করে তার সংলাপ বলে। ভাইবোন-সমবয়সিরা হাসাহাসি করে। তার তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই কোনও। অবশ্য সে বাড়ির উঠোনে নাটক করার উদ্যোগ নিলে সকলে এসে যোগ দেয় আবার। বড়রা উৎসাহ দেন, সহযোগিতা করেন। তক্তপোশ জোড়া দিয়ে মঞ্চ তৈরি হয়। মায়ের শাড়ি দিয়ে উইংস, বিছানার চাদরের ড্রপসিন। নাটকের দর্শক— বাড়ির মানুষজন, কাজের লোকেরা। কখনও পাড়া-পড়শি দু-এক জন। বাবা একদিন বললেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুকুট’ নাটকটা করতে। নিজেই বই এনে দিলেন। সিগারেটের প্যাকেটের রাংতা কেটে নিজের হাতে মুকুট বানিয়ে দিলেন মা। মহা উৎসাহে অভিনয় হল। এই অভিনয় করতে গিয়ে নাট্যকার সম্পর্কে প্রথম সচেতন হল পুলু। কী আশ্চর্যই না লেখেন তিনি! তিনিই ‘বীরপুরুষ’, ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতা লিখেছেন, আবার ‘মুকুট’ও তাঁরই লেখা! একটা বিস্ময়বোধ তাকে আপ্লুত করল। নিজের অজান্তেই রবীন্দ্রনাথের নিত্য চলাচল শুরু হয়ে গেল তার মনে।
কৃষ্ণনগরের সি এম এস হাইস্কুলের ক্লাস ফোরের ছাত্র পুলু। ‘স্লিপিং প্রিন্সেস’ নামে একটা ইংরেজি নাটক হবে। পুলুর তাতে একটা পার্ট জুটল। প্রিন্সিপাল মিস ম্যাকার্থার রিহার্সালের মধ্যে কিছু একটা চাইবার ভঙ্গি করতে বললেন পুলুকে। কিছুতেই ঠিকঠাক পেরে উঠছিল না সে। শেষে মিস বললেন, ভিখারিরা যে ভাবে ‘হামাকে কিছু চাল দাও’ বলে হাত বাড়িয়ে দেয়, সেই ভাবে অভিনয়টা করতে। অনেক বার অভ্যাসের পর বলার ভঙ্গিটা ঠিক হল। জীবনের অভিজ্ঞতা কী ভাবে অভিনয়ে কাজে লাগানো যায়, তারও খানিকটা শিক্ষা হয়ে গেল পুলুর। নাটকের মধ্যে নানা রকম মানুষ হয়ে উঠতে তার খুব ভাল লাগে।
১৯৪৫ সাল। পুলুর বয়স বছর দশেক। পুরনো এই শহরটা এ বার ছেড়ে যেতে হবে পুলুদের। বাবার নতুন চাকরি হয়েছে বারাসাতে। কালো ঘেঁষ ঢালা একটা চওড়া রাস্তা, নাম তার হাইস্ট্রিট, গোয়াড়ি থেকে চলে গিয়েছে সোজা রাজবাড়ির গড়ের দিকে। শহরের চারদিকে খোলা নর্দমা আর জঞ্জালের স্তূপ। দুর্গন্ধ। মাটি বা খোয়ার এবড়োখেবড়ো অলিগলি। নতুন বাড়ির সংখ্যা হাতে গুনে বলা যায়। বেশির ভাগ ইটের পাঁজর বের করা, জরাজীর্ণ। তবু শহরটার জন্য বড্ড মন কেমন করে পুলুর। হাঁটতে হাঁটতে সে চলে যায় শহরের কোল ঘেঁষা ছোট নদী জলঙ্গির পাড়ে। চুপচাপ বসে দেখে জলঙ্গির প্রায় স্থির জলে সার বেঁধে নেমে যাচ্ছে হাঁসের দল। শরবনের ভিতরে সতর্ক পানকৌড়ি। দূরে ডিঙিনৌকোয় মাছ ধরছে জেলেরা। এরকম সময়ে তার মনে কবিতা জেগে ওঠে। ইতিমধ্যে কয়েকটা কবিতা লিখেও ফেলেছে ইস্কুলের খাতায়।
জলঙ্গির পাড়ে বসে তার চোখে রাজবাড়ির দুর্গার বিসর্জন ভেসে ওঠে। কী যে অসামান্য সেই রাজরাজেশ্বরী দুর্গা! তার ধারণা এমনটি আর কোথাও হয় না। বিসর্জনের শোভাযাত্রায় সবার আগে থাকবেন সেই দুর্গা। অন্য সব ঠাকুর তার পেছন পেছন। নদীর পাড়ে এসে একটা নীলকণ্ঠ পাখিকে উড়িয়ে দেওয়া হবে কৈলাসের উদ্দেশে। তার পর জোড়া নৌকোয় রাজরাজেশ্বরী জলঙ্গির জলে ভাসবেন। নদীর মাঝামাঝি গিয়ে দু'টো নৌকো যাবে দু-দিকে সরে। সেই ফাঁক দিয়ে জলে পড়বেন দেবী।
এই সব ছেড়ে যেতে হবে ভেবে মন খারাপ করে পুলুর। তবু যাবার দিন এসে পড়ে একদিন।
বাবার চাকরি সূত্রে নানা জায়গা ঘুরে শেষে মায়ের বাপের বাড়ি কলকাতায় মির্জাপুর স্ট্রিটে থিতু হল তারা। ততদিনে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে পুলু। সারা ক্ষণ অভিনয় চিন্তা, নাটকের ভাবনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষাটাই সেজন্যে আর দেওয়া হয়ে উঠল না। ১৯৫৮-তে পুলু অর্থাৎ সৌমিত্রর বয়স যখন তেইশ, সত্যজিৎ রায়ের ডাক এল সিনেমায় অভিনয়ের। পুলু হয়ে উঠল ‘অপুর সংসার’ ছবির নায়ক অপূর্বকুমার রায়।
অনেক পরে এই অপূর্ব চরিত্র সম্পর্কে লিখবেন অভিনয়ের কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় :
“বিভূতিভূষণের চরিত্রটিতে যে নিসর্গপ্রীতি বা প্রকৃতি প্রেমের লক্ষণ ছিল, তার সঙ্গে আমি নিজের একটা মৌল সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলাম। আমিও মফসসলের ছেলে। কৃষ্ণনগরে আমার ছেলেবেলা কেটেছে। আমি তখন যে কৃষ্ণনগরকে চিনতাম সেটি ছিল ৩৫ হাজার লোকের একটি শহর, যার একটু বাইরে পা বাড়ালেই গ্রাম। আর আমিও, অপুর মতোই, পরবর্তী জীবনের কলকাতায় এসে পড়াশুনা করেছি। গ্রাম ছেড়ে আসা অনেক ছিন্নমূল বন্ধু-বান্ধবের মত আমিও নাগরিক জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু হৃদয় থেকে স্বীকার করে নিতে পারিনি। ফেলে আসা গ্রামগঞ্জ, খালবিল, মফসসলের মন্থর জীবনধারার জন্য একটা কাতরতা আমার মধ্যে থেকে গিয়েছিল। সেজন্যই অপুর প্রতি আমার টান এত প্রবল, চরিত্রটির সঙ্গে আমি সর্বতোভাবে নিজেকে মিলিয়ে দিতে পেরেছিলাম।"
ঋণস্বীকার:
সত্যিসত্যিই আজ আমি ‘খুবই খুশি’
—অনুরাধা সিনহা (নাট্যকল্প, মার্চ ২০১১)
সেইসব দিন
—সম্বিৎকুমার চট্টোপাধ্যায় (নাট্যকল্প, মার্চ ২০১১)
আমার পুলুদা
—অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় (নাট্যকল্প, মার্চ ২০১১)
প্রতিদিন তব গাথা
—সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
চরিত্রের সন্ধানে
—সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy