Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Purulia

জন্মকালীন কম ওজন শিশুমৃত্যুর বড় কারণ

কম ওজনের শিশু দু’টি কারণে জন্মাতে পারে। এক ধরনের শিশুর জন্ম হয় গর্ভকাল পূর্ণ হওয়ার আগেই। আর এক ধরনের শিশুর গর্ভাবস্থায় বৃদ্ধি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম হয়। মূলত এটি গর্ভবতীর সমস্যা। আলোচনায় আজিজুর রহমান কম ওজনের শিশু দু’টি কারণে জন্মাতে পারে। এক ধরনের শিশুর জন্ম হয় গর্ভকাল পূর্ণ হওয়ার আগেই। আর এক ধরনের শিশুর গর্ভাবস্থায় বৃদ্ধি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম হয়। মূলত এটি গর্ভবতীর সমস্যা। আলোচনায় আজিজুর রহমান

মা ও শিশু। —ফাইল চিত্র

মা ও শিশু। —ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২০ ০২:২৮
Share: Save:

নবজাতকের বেঁচে থাকা, ঠিকমতো বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য জন্মের সময়কার ওজন (জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, যে সব নবজাতকের ওজন আড়াই কিলোগ্রামের কম হয়, তাদের স্বল্প ওজনের শিশু (‘লো বার্থ ওয়েট বেবি’) বলা হয়। এই ওজনে নবজাতকের গর্ভকালীন বয়সকে ধরা হয় না।

স্বল্প ওজনের নবজাতক মাতৃত্ব ও শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। শিশুমৃত্যুর অন্যতম বড় কারণই হল জন্মকালীন কম ওজন। ওজন যত কম হবে, ততই শিশুর নানা জটিলতা দেখা দেবে। বেশির ভাগই ধীরে ধীরে প্রোটিনের অভাবজনিত অপুষ্টির শিকার হয় এবং তার সঙ্গে নানা ধরনের সংক্রমণের ফলে এক বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যায়। এটা অনস্বীকার্য যে, স্বল্প ওজনের শিশুর জন্মের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মায়ের অপুষ্টিই দায়ী। কয়েকটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র, যেমন—ভ্রূণের জিনগত ত্রুটি ও গর্ভফুলের ত্রুটি ছাড়া মায়ের পুষ্টির সঙ্গে গর্ভধারণের সময়কাল ও নবজাতকের ওজনের সরাসরি যোগাযোগ আছে।

কম ওজনের শিশু দু’টি কারণে জন্মাতে পারে। এক ধরনের শিশুর জন্ম হয় গর্ভকাল পূর্ণ হওয়ার আগেই। ২৮ থেকে ৩৭ সপ্তাহের মধ্যে কোনও শিশুর জন্ম হলে, ‘প্রিটার্ম’ বা সময়ের আগে জন্মানো শিশু বলা হয়। গর্ভকালীন অবস্থায় সময় অনুযায়ী হয় তো শিশুর বৃদ্ধি ও ওজন ঠিকই ছিল। কিন্তু আগে জন্মানোর জন্য শিশুটি নির্দিষ্ট ওজন অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ঠিকমতো পরিচর্যা পেলে এ সব শিশুরা দু-তিন বছরের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হয়।

আর এক ধরনের শিশুর গর্ভাবস্থায় বৃদ্ধি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম হয়। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের ঠিকমতো বৃদ্ধি না হওয়ার বহু কারণ আছে। মূলত এটি গর্ভবতীর সমস্যা। কিছু ক্ষেত্রে ভ্রূণ বা গর্ভফুলের সমস্যা থাকতেও পারে। গর্ভবতীর সমস্যাগুলির মধ্যে প্রধান অপুষ্টি। পাশাপাশি, রক্তাল্পতা, কম বয়সে গর্ভধারণ, ঘন ঘন গর্ভধারণ, মায়ের দুর্বল দৈহিক গঠন, বহু সন্তানের জন্মদান ইত্যাদি রয়েছে। অশিক্ষা, দারিদ্র, নিম্ন মানের খাদ্য ও বাসস্থান, অতিরিক্ত পরিশ্রম, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, ম্যালেরিয়া ও কৃমির সংক্রমণও সমস্যা তৈরি করে।

কম ওজনের শিশুরা জন্মের কিছু দিনের মধ্যে অতি সহজেই প্রোটিনের অভাবজনিত অপুষ্টি ও তার সঙ্গে নানা সংক্রমণের শিকার হয়। স্বল্প ওজনের নবজাতক জন্মানো কমিয়ে আনার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তবে এর জন্য কোনও সাধারণ পদ্ধতি নেই। দরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। এর জন্য যেটা জরুরি, তা হল প্রাক্-প্রসবকালীন নিবিড় পরিচর্যা। প্রত্যেক গর্ভবতীকে দ্রুত চিহ্নিত করে পরিষেবার আওতায় আনতে হবে। এর জন্য আশা, অঙ্গনওয়াড়ি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের যথেষ্ট তৎপর ও যত্নবান হতে হবে। দেখতে হবে এক জন গর্ভবতীও যেন বাদ না পড়ে। বিশেষ করে দরিদ্র, অশিক্ষিত, পিছিয়ে পড়া এবং বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর গর্ভবতীদের বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার।

স্বাস্থ্যকর্মী বা প্রয়োজনে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক দ্বারা গর্ভবতীদের নিয়মিত ওজন, রক্তচাপ, হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ, গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধির হার ইত্যাদি পরিমাপ করা দরকার। গর্ভবতী যাতে নিয়মিত ভাবে আয়রন, ফোলিক অ্যাসিড ও ক্যালসিয়াম বড়ি, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র ও বাড়িতে পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত খেতে পান, তার জন্য নজরদারি প্রয়োজন। গর্ভবতী ব্যতিরেকেও তাঁর স্বামী ও পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠ সদস্য, বিশেষত মা বা শাশুড়িদের অবশ্যই কাউন্সেলিং করা দরকার। অন্যথায় শুধু গর্ভবতীকে উপদেশ প্রদান শুকনো কথা হিসেবে রয়ে যাবে! কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অল্পবয়সি গর্ভবতীর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

এত কথা বলা এই জন্য যে, গর্ভবতী মায়ের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে এখনও বহু বিধিনিষেধ প্রচলিত আছে। জাতিগত, বর্ণগত, গোষ্ঠীগত ও এলাকাভেদে সামান্য তফাৎ হলেও প্রায় সব ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের বাধা রয়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বহু গর্ভবতী অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের খিচুড়ি ও সেদ্ধ ডিম খান না। অনেকে আবার ডিম, পোল্ট্রির মাংস, মাছ ইত্যাদি বাড়ির গুরুজনদের নির্দেশে খেতে পারেন না। পেটপুরে খাওয়াতেও থাকে নিয়ন্ত্রণ। গর্ভবতী যদি পেট পুরে খায় তা হলে ‘গর্ভস্থ সন্তান এত বিরাট আকৃতির হবে যে স্বাভাবিক প্রসব হবে না, পেট কাটতে হবে’—এমন ধারণাও অনেকের মনে থাকে।

এ সব ধ্যান-ধারণার বেশির ভাগই অবৈজ্ঞানিক, স্বাস্থ্যের পরিপন্থী এবং দীর্ঘদিনের লালিত কুসংস্কারের ফল। এ সব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ভাবে পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে ভুল শুধরে দিতে হবে। তা এক দিনে বা একার চেষ্টায় সম্ভব নয়। তবু হাল ছাড়লে চলবে না।

পুষ্টিকর খাবারের পরিমাণ কিছুটা বাড়ালে, সংক্রমণ এড়ানো গেলে, নিয়মিত প্রাক্-প্রসবকালীন স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও প্রথমাবস্থায় গর্ভকালীন সমস্যাগুলির আশু সমাধান হলে স্বল্প ওজনের নবজাতকের সংখ্যা কমতে বাধ্য। কম ওজনের নবজাতককে বহু ব্যয়ে উন্নত মানের চিকিৎসা দিয়েও সব সময়ে বাঁচানো যায় না। তাই স্বল্প ওজনের শিশুই যাতে না জন্মায়, সেই লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে।

লেখক প্রাক্তন জেলা মাতৃত্ব ও শিশুস্বাস্থ্য আধিকারিক, পুরুলিয়া

অন্য বিষয়গুলি:

Purulia Infant Chiild Birth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy