Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

অজন্তার গুহাচিত্র ও গ্রিফিথ সাহেবের বই

প্রতিলিপির দায়িত্ব পান মুম্বইয়ের তৎকালীন ‘জামশেদজি স্কুল অব আর্ট’-এর অধ্যক্ষ জন গ্রিফিথ। ১৮৭২ সালে গ্রিফিথ তাঁর দশ জন প্রতিনিধিকে নিয়ে প্রতিলিপির কাজ শুরু করেন। এবং ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত এই কাজ চলে। লিখছেন কবিতা মুখোপাধ্যায়প্রায় দেড় হাজার বছর আগে বৌদ্ধ শ্রমণদের হাতে সৃষ্টি অজন্তা গুহাচিত্র কালের প্রভাবে ঘন অরণ্যের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। প্রায় এক হাজারের বছরের উপরে সময় ধরে সেটি লোকক্ষুর অন্তরালে থাকার পরে, ফের জনসমক্ষে আসে ১৮১৯ সলে, মাদ্রাজ পল্টনের কিছু ইংরেজ কর্মচারীর তৎপরতায়।

অজন্তার গুহাচিত্র। ছবি: আইস্টক

অজন্তার গুহাচিত্র। ছবি: আইস্টক

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:০৪
Share: Save:

কালের নিয়মে হারিয়ে যায় বহু সৃষ্টি। যে উদ্যোগ, যে ভালবাসা, যে নিরলস পরিশ্রমে সৃষ্টি হয় মহৎ কোনও সৃষ্টির তা কালের নিয়মে অযত্নে, অবহেলায় লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। তেমন ভাবেই গিয়েছিল অজন্তা গুহাচিত্র। আজ অবশ্য এই সৃষ্টি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যগুলির মধ্যে একটি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

প্রায় দেড় হাজার বছর আগে বৌদ্ধ শ্রমণদের হাতে সৃষ্টি অজন্তা গুহাচিত্র কালের প্রভাবে ঘন অরণ্যের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। প্রায় এক হাজারের বছরের উপরে সময় ধরে সেটি লোকক্ষুর অন্তরালে থাকার পরে, ফের জনসমক্ষে আসে ১৮১৯ সলে, মাদ্রাজ পল্টনের কিছু ইংরেজ কর্মচারীর তৎপরতায়। আর ১৮৪৩ সালে এই অপূর্ব চিত্রশৈলীকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন ফার্গুসন সাহেব। এ বিষয়ে তিনি গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ার্ল্যান্ডের ‘রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি’তে বক্তব্য রাখেন।

অবশ্য হাজার বছরের অবহেলায় অজন্তার চিত্রশিল্পের অনেকটাই তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অজন্তা গুহাচিত্রের শৈলীকে রক্ষা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় ‘রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি’। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয়, এই ছবিগুলির প্রতিলিপি করা হবে এবং এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় মাদ্রাজ পল্টনের ক্যাপ্টেন রবার্ট গিলকে।

ইতিহাস থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, অজন্তার তিরিশটি গুহা চিত্রের প্রতিলিপি করে রবার্ট গিল লন্ডনে পাঠিয়ে দেন এবং এই তিরিশটি ছবির মধ্যে পঁচিশটি ছবি সিডল হ্যামার ক্রিস্টাল প্যলেসের প্রদর্শনীতে দেখানো হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই পঁচিশটি ছবি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পুনরায় এই গুহাচিত্রগুলির প্রতিলিপি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বারে প্রতিলিপির দায়িত্ব পান মুম্বইয়ের তৎকালীন ‘জামশেদজি স্কুল অব আর্ট’-এর অধ্যক্ষ জন গ্রিফিথ। ১৮৭২ সালে গ্রিফিথ তাঁর দশ জন প্রতিনিধিকে নিয়ে প্রতিলিপির কাজ শুরু করেন। এবং ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত এই কাজ চলে। ১৮৯৬ এবং ১৮৯৭ সালে অজন্তা গুহাচিত্রের প্রতিলিপিগুলিকে নিয়ে তৈরি বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ দু’টি ‘দ্য বুদ্ধিস্ট কেভ টেম্পল অব অজন্তা’ ভলিউম ১ ও ২ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

এই বই দু’টির সবথেকে বড় বিশেষত্ব হল এদের বিশালত্ব। দৈর্ঘ্যে বই দু’টি ৫৫ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ৪২ সেন্টিমিটার। শক্ত বোর্ডে বাঁধাই করা গ্রন্থ দু’টির প্রচ্ছদের রঙ কালচে শ্যাওলা। উপরে সোনালি রঙের বুদ্ধের ছবি। বইয়ের পাতা ওল্টালেই সামনে হাজির হবে সাদা কালো ও রঙিন অজন্তার অজন্তার নানা ছবি।

চিত্রশিল্পী অসিতকুমার হালদার অজন্তা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘সহস্র সহস্র বৎসরের বৌদ্ধ ছবিগুলির কোনওটির রং ও বর্ণের অদ্যপি কো‌নও পরিবর্তন হয়নি। সেগুলি যেন চিরনবীন। অজন্তার ছবি দেখলে মনে হয় এই মাত্র বুঝি কেউ রং দিয়ে গেল।’’ সুকুমার সেন মহাশয় এই বইটির সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছিলেন। তাঁর মতে তৎকালের পক্ষেও এই বই দু’টি অনন্য ছিল। বর্ধমান রাজ কলেজের গ্রন্থাগারিকের টেবিলের উপরে বই দু’টি শোভা পেত।

এই বইয়ের মুখবন্ধে গ্রিফিথ উল্লেখ করেছিলেন, ‘‘অজন্তা গুহাচিত্র অনুলিপি করা হয়েছে। আমি আশা করি, এর মধ্যে দিয়ে সে কালের ইতিহাস পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা সক্ষম হয়েছি।’’ গ্রিফিথের ভূমিকাতেও এই বই দু’টির জন্য সে কালে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তার একটা আভাস দেওয়া হয়েছিল।

অজন্তার গুহার সংখ্যা তিরিশটি হলও বর্তমানে তিরিশটি গুহাই আর অক্ষত নেই। এখন ১, ২, ১৬, ১৭, ১৯ ২০ এবং ২৬ নম্বর গুহা দেখতে দেওয়া হয়। তবে কালের নিয়মে সেগুলি কতদিন অক্ষত থাকবে, সে কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না। তবে গ্রিফিথের বইয়ে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করলে এই গুহাচিত্রগুলির অনেকগুলিই রক্ষা করা যেত। এই গুহাচিত্রের সবথেকে যে বড় বৈশিষ্ট্যের কথা গ্রিফিথ বলেছিলেন, সেটি হল সে কালের বৌদ্ধ শ্রমণদের ব্যবহার করা রং হাজার হাজার বছর ঘরে টিঁকেছিল কোনও রকম কৃত্রিমতা ছাড়াই।

গ্রিফিথের ‘অজন্তা কেভ টেম্পল’ এর খণ্ড দু’টি পৃথিবীর বিরলতম বই। যত দূর জানা যায় ওই বই দু’টির মূল কপি গোটা পৃথিবীতে রয়েছে মাত্র তিন থেকে চারটি। তার মধ্যে একটি রয়েছে দিল্লি আর্কাইভে। আর একটি রয়েছে বর্ধমান রাজ কলেজের আর্কাইভে। অবশ্য কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহেও এই বই থাকতে পারে। তবে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় না। অজন্তার গুহাচিত্রের দলিল এই গ্রন্থকে ধরে রাখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন সিস্টার নিবেদিতাও। তাঁর উৎসাহেই অসিতকুমার হালদার এবং নন্দলাল বসু সেখানে গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ‘অজন্তা’ নামে অসিতকুমার হালদারেরও একটি বই রয়েছে। আবার সিস্টার নিবেদিতাও ‘দ্য এনশিয়েন্ট অজন্তা’ নামে একটি গ্রন্থ রচ‌না করেছিলেন।

অবিলম্বে যদি এই অমূল্য গ্রন্থগুলির প্রতিলিপি বা পুনরুৎপাদন করা না হয় তা হলে এক দিকে যেমন হারিয়ে যাবে মানুষের প্রাচীন ইতিহাস, অন্য দিকে, বিলুপ্ত হবে সেই ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়াসের দলিলও।

বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

অন্য বিষয়গুলি:

Ajanta Cave Temple Cave Painting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE