—ফাইল চিত্র।
অনেক দিন আগে পড়া কোনও বই আবার নতুন করে পড়লে তার তাৎপর্য একটু আলাদা ভাবে চোখে পড়ে। তেমনই একটি বই খুলে বসেছিলাম, যে বই প্রায় চল্লিশ বছর আগে তরুণ গবেষক হিসেবে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। বইটা হল হিতেশরঞ্জন সান্যালের সোশ্যাল মোবিলিটি ইন বেঙ্গল। ছাপা হয়েছিল ১৯৮১ সালে।
বইয়ের অধ্যায়গুলি অবশ্য প্রথম প্রবন্ধাকারে ছাপা হয় সত্তরের দশকে। বাঙালি সমাজের গঠন নিয়ে তখনও যেটুকু আলোচনা হয়েছে, তা মূলত শ্রেণিভিত্তিক বিশ্লেষণের মধ্যেই আটকে আছে। শ্রেণির সঙ্গে বর্ণের যে সম্পর্ক থাকতে পারে, সে বিষয়ে ইতিহাসবিদদের ধারণা তখনও অস্বচ্ছ। ইতিহাসবিদ ও সমাজবিদরা এ দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেছেন মাত্র, যেমন নীহাররঞ্জন রায়, সৌম্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ও নির্মলকুমার বসু। কেমব্রিজ স্কুলের ইতিহাসবিদরাও বাংলার রাজনীতিতে ভদ্রলোক-আধিপত্য ও জাতপাতের প্রভাবের কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সে সব কথা আমরা খুব মন দিয়ে শুনতাম না! কারণ বাঙালি ভদ্রলোক বিশ্বাস করতেন যে, বাংলায় জাতপাতের বিশেষ ভূমিকা নেই! হিতেশরঞ্জনের গবেষণা এই ধারণাটিকে ভেঙে দেয়। বাঙালি সমাজে বর্ণ-জাতিভেদের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্তরবিন্যাসের যে অঙ্গাঙ্গি যোগ রয়েছে, তা নিয়ে আমার জানা প্রথম পূর্ণাঙ্গ গবেষণাভিত্তিক বই এইটাই।
এই বইয়ে হিতেশবাবু কী দেখালেন আমাদের? বইয়ের শুরু একটি দীর্ঘ ভূমিকা দিয়ে, যেখানে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণী পদ্ধতির সাহায্যে তিনি বাংলায় জাতি-বর্ণ প্রথার বিবর্তনের কথা বলছেন। তাঁর মতে, বর্ণব্যবস্থার প্রসার ঘটে আর্য সভ্যতার বিস্তারের সঙ্গে প্রান্তিক আদিবাসী সম্প্রদায়কে এই সমাজবিন্যাসের আওতায় নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে।
এই সামাজিক স্তরবিন্যাসের দু’টি বৈশিষ্ট্যের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। এক দিকে, যাঁরা কায়িক শ্রম করতেন, তাঁরা সমাজে নিম্নবর্ণ বলে চিহ্নিত হলেন। আর অন্য দিকে, জাতব্যবস্থার সঙ্গে বৃত্তির একটা যোগ স্থাপিত হল। কোনও জাতের লোকেরাই তাঁদের জন্মসূত্রে পাওয়া বৃত্তি পরিবর্তন করার অধিকারী ছিলেন না। এর ফলে অর্থনৈতিক জীবনে প্রতিযোগিতার কোনও স্থান রইল না! নিম্নবর্ণের মানুষকে চিরস্থায়ী ভাবে নীচেই রাখার বন্দোবস্ত পাকা হল! শ্রীসান্যাল অবশ্য একে এক ধরনের সমবায় অর্থনীতি বলছেন, যেখানে সবাই একে অপরের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও সেবা উৎপাদন এবং বিনিময় করে। সব রকম অর্থনৈতিক সুবিধা-সুযোগ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলেও নিম্নবর্ণের লোকেরাও এই ব্যবস্থাটিকে মেনে নিতেন। কারণ, সপ্তম শতক থেকেই ভারতে যে অভাবের অর্থনীতি দেখা দিচ্ছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যবস্থা সকলের জন্য ন্যূনতম সংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান করত।
অন্য দিকে, এর ফলে যে একটা পরিবর্তনবিমুখ সমাজ সৃষ্টি হয়েছিল, তা-ও নয়। সামাজিক গতিশীলতার (সোশ্যাল মোবিলিটি) কিছু পথ খোলা ছিল। উদ্যোগী মানুষেরা নানা অর্থনৈতিক সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতেন; উচ্চবর্ণের সংস্কৃতি গ্রহণ করে, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নিয়মকানুন মেনে বর্ণব্যবস্থায় ওপরে উঠতে পারতেন। ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিষয়টি হিতেশরঞ্জন উপেক্ষা করেননি। তাঁর মতে, জাতে ওঠার সম্ভাবনা খোলা ছিল বলেই নিচু জাতের মানুষেরাও এই নিপীড়নমূলক সমাজব্যবস্থাকে মেনে নিতেন।
ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই স্থানীয় নবশাখ ও অজলচল জাতিগুলির মধ্যে সামাজিক গতিশীলতার কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। তবে অষ্টাদশ শতকের পর থেকে এ নিয়ে আরও বেশি তথ্যপ্রমাণ আমাদের নজরে আসে। এই সামাজিক উত্তরণের পিছনে ভূমি হস্তান্তর, রেশম ও নুনের ব্যবসার সুযোগ, ভক্তি আন্দোলন ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম এবং সর্বোপরি সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য মন্দির নির্মাণের গবেষণা-নির্ভর আলোচনা এই বইতে আছে।
গত চল্লিশ বছরে বাংলার সামাজিক ইতিহাসের আলোচনা এবং বর্ণ-জাতিবিন্যাসের বিশ্লেষণ অনেক এগিয়ে গিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি বিষয় খুব চোখে পড়ে। প্রথমত, জাতপাতের সঙ্গে যে অর্থনীতির বা বস্তুজগতের একটা অঙ্গাঙ্গি যোগ আছে, এটি শুধুমাত্র একটি শুচি-অশুচির ধর্মীয় ধারণা নয়, সেই বিষয়টি শ্রীসান্যাল তথ্যপ্রমাণ দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বর্ণভিত্তিক সমবায় অর্থনীতির গাঁধীবাদী ধারণা সম্বন্ধে আজ হয়তো অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করবেন।
তার কারণ হিতেশবাবু যে বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি, সেটা হল ক্ষমতার সম্পর্ক এবং অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য, বা আধুনিক কালে আমরা যাঁদের বলি দলিত-বহুজন সমাজ, তাঁদের অবস্থা। পরবর্তী কালের গবেষণা থেকে আমরা জেনেছি যে, ব্রাহ্মণ্য ক্ষমতার নিরন্তর প্রয়োগের ফলেই জাতপাতের নিয়মকানুন সবাই মেনে চলত। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাহীনতার ব্যাপারটা ছিল ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া, নিচু তলার সম্মতি সেখানে জোর করে আদায় করা হত। ন্যূনতম সংস্থানের যে কথা তিনি বলেছেন, তার একটি শর্ত ছিল ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের কাছে নিঃশর্ত বশ্যতা স্বীকার। অর্থাৎ নিজ বৃত্তিতে বহাল সব নিয়মকানুন মেনে চললে তবেই ন্যূনতম অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান হত। এই বিষম-ভাবাপন্ন সম্পর্কের ফলেই কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক উত্তরণ ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সম্ভব হত না, বিশেষ করে অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য জাতিগুলির ক্ষেত্রে তা ছিল প্রায় অসম্ভব। তাই সবাই যে বিনা প্রতিবাদে এই অসাম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থাকে মেনে নিতেন, তা নয়; আনুগত্যের পাশাপাশি প্রতিরোধের নজিরও রয়েছে। সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা ওপরে ওঠার চেষ্টা করলেই বাধত সংঘাত। আর যাঁরা জাতে উঠলেন, তাঁরাও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আধিপত্য স্বীকার করে নিতেন, কারণ ব্রাহ্মণের ‘ব্যবস্থা’ ছাড়া সেই উচ্চতর সামাজিক মর্যাদা মান্যতা পেত না।
অর্থাৎ, গত চার দশকে বর্ণ-সমাজের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বগুলি সম্বন্ধে আমরা অনেক বেশি ওয়াকিবহাল হয়েছি। আমরা জেনেছি যে, ঔপনিবেশিক যুগে এই শৃঙ্খলিত সমাজের বন্ধন কিছুটা শিথিল হয়েছিল। আইন, জমির মালিকানা, শিক্ষা এবং সরকারি চাকরি জাতপাত নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল, হাজার বছর ধরে যাঁদের প্রতিযোগিতা থেকে জোর করে সরিয়ে রাখা হয়েছিল, তাঁরা রাতারাতি এই মুক্ত প্রতিযোগিতার বাজারে পেরে উঠছেন না। ফলে নতুন সুবিধা-সুযোগ প্রায় সবই কুক্ষিগত হল সবর্ণ ভদ্রলোক গোষ্ঠীর হাতে, যাঁদের সবাই না হলেও অনেকেই ছিলেন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈশ্য, এই তিন উচ্চজাতির সদস্য। দীর্ঘ দিন একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করে তাঁদের হাতে জমা হয়েছে অপর্যাপ্ত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজি।
এই সামাজিক ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্যই ১৯১৯ সাল থেকে ব্রিটিশ সরকার সংরক্ষণের নীতি গ্রহণ করে, ১৯৩৫-৩৬ সালে যাকে পূর্ণ রূপ দেওয়া হয় আইনসভায় আসন সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে। ১৯৩২-এ পুণে চুক্তিতে গাঁধী ও অম্বেডকর এই ব্যবস্থা মেনে নিলে বাংলার সবর্ণ ভদ্রলোকেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, তাঁদের ভাগের তিরিশটা আসন চলে গেল এই পিছিয়ে পড়া লোকগুলিকে প্রতিনিধিত্ব দিতে গিয়ে! স্বাধীন ভারতের সংবিধানও গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকল্পে সংরক্ষণ নীতি বহাল রাখল। কারণ, এটি হল গত শতাব্দীর ঐতিহাসিক অবিচার ও বঞ্চনার জন্য ক্ষতিপূরণ, যাতে আদিবাসী ও দলিত শ্রেণিগুলি সমাজের বাকি অংশের সমান হয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, গত সত্তর বছরে এই নীতি সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা হয়নি, আর তাই সংবিধানের সেই মঙ্গলময় উদ্দেশ্য অপূর্ণই থেকে গিয়েছে। অবশ্যই শুধু সংরক্ষণ দিয়ে দলিত-আদিবাসী সমাজের উন্নতি ঘটানো যাবে না; সঙ্গে চাই অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রকল্প। কিন্তু যত দিন না পর্যন্ত সংবিধান-প্রস্তাবিত সামাজিক সমতার লক্ষ্যটি পূরণ হচ্ছে, তত দিন সংরক্ষণ নীতি বর্জন করা যাবে না। তার চেয়ে বরং সমতার লক্ষ্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছনোর জন্য শুরু করা যেতে পারে জাত-বিরোধী সামাজিক আন্দোলন।
ইতিহাস বিভাগ, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটন, নিউ জ়িল্যান্ড
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy