২৫ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

কবি-রাজ রবীন্দ্রনাথ: পাঁচন দাওয়াই কি এখন করোনায় কাজ করবে?

রবীন্দ্রনাথ এই পাঁচন তৈরি করে প্রত্যেক আশ্রমবাসীকে নিয়ম করে খাওয়াতেন এবং সে সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মহামারি আটকেছিলেন।

শান্তিনিকেতনে আশ্রমে ছাত্রদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।ছবি: উইকিমিডিয়া।

শান্তিনিকেতনে আশ্রমে ছাত্রদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।ছবি: উইকিমিডিয়া।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২০ ১২:৪৩
Share: Save:

সেই জ্বর এসে পড়েছে। তখনকার ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘যুদ্ধজ্বর’ নামে পরিচিত হয়েছিল। বহু জায়গায় মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল।শান্তিনিকেতনও রেহাই পায়নি।

রবীন্দ্রনাথ রাণুকে চিঠি লিখলেন, ‘আমাদের ইস্কুলেও সেই জ্বর এসে পড়েচে। কিন্তু অন্য জায়গার মতো তেমন প্রবল নয়। অনেক ছেলেই এখন হাঁসপাতালে গেছে।’ কিন্তু রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে সীতা দেবীর ‘পুণ‍্য স্মৃতি’ থেকে জানা যায়, দেশে জ্বরের মহামারির ছোঁয়া আশ্রমের বহু ছাত্রছাত্রীর উপর এসে পড়ে। তারা অসুস্থ হয়ে যায়। সীতা দেবীর লেখা থেকেই জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ নিজে রোজ ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক অসুস্থ ছাত্রছাত্রীকে দেখতে যেতেন। তাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতেন। এমনকি চিকিৎসাও করতেন। সীতা দেবী লিখছেন, ‘সে বার তিনি একটি ভেষজ প্রতিষেধক তৈরি করলেন। সেই প্রতিষেধকটির নাম ‘পঞ্চতিক্ত পাঁচন’।’

কী এই পঞ্চতিক্ত পাঁচন?

তেউরি, নিম, গুলঞ্চ, নিশিন্দা এবং থানকুনি বেটে একসঙ্গে সবটা মিলিয়ে তৈরি হয়েছিল এই পাঁচন। রবীন্দ্রনাথ এই পাঁচন তৈরি করে প্রত্যেক আশ্রমবাসীকে নিয়ম করে খাওয়াতেন এবং সে সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মহামারি আটকেছিলেন। সীতা দেবী ছাড়াও অজিতকুমার চক্রবর্তীর মরণাপন্ন পীড়ার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ চিকিৎসক দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে ১৯১৮-র ২৯ ডিসেম্বর চিঠিতে লিখছেন, ‘ছাত্র সৌভাগ্যক্রমে সকলেই ভাল আছে— তাদের সকলকেই রোজ পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাওয়াই— আমার বিশ্বাস সেই জন্য তাদের মধ্যে একটি case-ও হয়নি, অথচ তারা অধিকাংশই সংক্রামকের কেন্দ্র থেকে এবং রোগগ্রস্ত পরিবার থেকে এসেচে।’

আরও পড়ুন: সহমর্মী সংহতি​

জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কিশোরবেলা থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে রবির ছিল গভীর অনুসন্ধিৎসা। যৌবনে শান্তিনিকেতনে স্কুল প্রতিষ্ঠার পর কালীমোহন ঘোষকে আশ্রমে আসার আমন্ত্রণ জানান কবি। চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার এখানে চিকিৎসক বলিতে আমি ও ক্ষিতিমোহনবাবু’। একান্ত বাধ্য হয়ে বাড়তে থাকা আশ্রমবাসীদের চিকিৎসার ভার নিজের হাতে নেন রবীন্দ্রনাথ। কবিকে এ কাজে সাহায্য করতেন অমর্ত্য সেনের দাদামশায়, আয়ুর্বেদজ্ঞ ক্ষিতিমোহন সেন। আশ্রম দিনে দিনে বড় হচ্ছে, বাড়ছে আশ্রমিকদের ব্যধি। অগত্যা রোগীদের চিকিৎসার প্রাথমিক দায়িত্ব হাতে তুলে নিতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে।

করোনা যুদ্ধে জর্জরিত ২০২০-র বিশ্ব। এই অতিমারির উৎসও জ্বর। তা হলে কি রবীন্দ্রনাথের এই পঞ্চতিক্ত পাঁচন আজকের জ্বরে সুরাহা করবে? লড়তে পারবে করোনার সঙ্গে?এ কালের আয়ুর্বেদ চিকিৎসক সন্দীপন চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের পঞ্চতিক্ত পাঁচনকে পঞ্চঘৃত পাঁচন হিসেবে চিকিৎসার কাজে লাগান। "আমরা ঘিয়ের মধ্যে এই পাঁচন তৈরি করি, আবার ট্যাবলেট হিসেবেও পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ যে গুলঞ্চ ব্যবহার করেছিলেন তা শুধু করোনা নয়, যে কোনও রোগ প্রতিরোধে খুব উপকারী। এই পাঁচন দেহে অ্যান্টি ভাইরাল জোন তৈরি করে যা করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে অত্যন্ত জরুরি। তবে এই পাঁচন খেলেই যে করোনা সেরে যাবে এটা বলা যাচ্ছে না।" বলছেন সন্দীপন।

আরও পড়ুন: অনলাইনে পয়লা বৈশাখ বাঙালি চালু করলেই পারে!​

১৯১৯-এর ১ জানুয়ারি বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুকে সে সময়ের ইনফ্লুয়েঞ্জার কথা উল্লেখ করে চিঠি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখছেন, ‘আমার এখানে প্রায় দুশো লোক, অথচ হাঁসপাতাল প্রায়ই শূন্য প’ড়ে আছে— এমন কখনও হয় না— তাই মনে ভাবচি এটা নিশ্চয়ই পাঁচনের গুণে হয়েচে।’ ছাত্রদের নিয়ে খানিক নিশ্চিত হলেও তিনি পরিবারের মানুষদের নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। চিঠিতে যেমন লিখছেন,'বউমার খুব কঠিন রকম ন্যুমোনিয়া হয়েছিল। অনেক দিন লড়াই করে কাল থেকে ভাল বোধ হচ্ছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে বোধ হয় অনেক দিন লাগবে। হেমলতা এবং সুকেশী এখনো ভুগচেন। তার মধ্যে হেমলতা প্রায় সেরে উঠেচেন— কিন্তু সুকেশীর জন্য ভাবনার কারণ আছে। কিন্তু ছেলেদের মধ্যে একটিরও ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়নি। আমার বিশ্বাস, তার কারণ, আমি ওদের বরাবর পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাইয়ে আস্চি।"

বোস ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন অধ্যাপক, বিজ্ঞানী রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায় চর্চা করেছেন মলিকিউলার বায়োলজি নিয়ে। এই চর্চার হাত ধরে প্রাচীন ভেষজ নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন তিনি। “এই পঞ্চতিক্ত পাঁচন ভাইরাসের সঙ্গে মানুষকে লড়াই করতে সাহায্য করবে। এতে গুলঞ্চ আছে যা সুগার রোগীদের জন্য ভাল। নিম তো স্কিন থেকে শরীরের ভেতরের রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষমতা বাড়ায়। আর যে ইনফ্লুয়েঞ্জার কথা রবীন্দ্রনাথ বলছেন তা-ও তো ভাইরাস। এই পথ্য করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে কাজে লাগতে পারে।”

আরও পড়ুন: ‘বলছিলুম কি, সাল পয়লার দিনে এট্টুখানি কাঁচা আমের চাটনি হবে তো?’​

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের স্ত্রী রানি। ডাক্তার নীলরতন সরকার প্রশান্তচন্দ্রের মেজ মামা, ডাক্তার সত্যসখা মৈত্র রানির জ্যাঠতুতো দাদা। দুজনেই রানিকে পরীক্ষা করে জানালেন রোগের মূলে এক ধরনের কৃমি। দুই চিকিৎসকের চিকিৎসা ছাড়িয়ে কাজ হল শেষে রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসায়। রানিকে লিখলেন তিনি, ‘কৃমির উপদ্রব পুরো ধ্বংস হলে আরাম পাবে। কৃমি ধংসের ভালো ওষুধ কাঁচা পেঁপের আঠা, অল্প একটু দুধের সঙ্গে মিশিয়ে বারবার খেলে উপকার পাবে বলে মনে করি।’

এ ভাবেই সহজ উপায়ে চিকিৎসা করতেন রবীন্দ্রনাথ। মেডিসিন বিষয়ক চিকিৎসক অরিজিৎ রায়চৌধুরীও আয়ুর্বেদকে এই মুহূর্তে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছেন না।

রবিজীবনী, সপ্তম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ। ​

“কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের সরাসরি কোনও মেডিসিন নেই, কোনও অ্যান্টিডোট নেই, তাই চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা শরীরে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছি যাতে এই ভাইরাস বেশি ক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে অ্যালোপ্যাথি মেডিসিন যে ভাবে কাজ করছে ঠিক সেই রকম ভাবে এজ ওল্ড আয়ুর্বেদের ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের যে পঞ্চতিক্ত পাঁচন তার অনেক গুণ আছে। নিম যেমন অ্যান্টি ইনফেক্টিভ। নিম খাই, লাগাই। এগুলো সরাসরি অ্যান্টি ভাইরাল না হলেও ভাইরাস যে পরিবেশ পছন্দ করে সেগুলো নষ্ট করে দেওয়ার জন্য এগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।’’ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট পাঁচনকে এ ভাবেই মান্যতা দিলেন এ কালের অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসক।

রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ পবিত্র সরকারের কথায়: ‘‘রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত নিমপাতার রস খেতেন। ঠাকুরবাড়িতেও ত্বক থেকে শরীরের যত্নে নানা পথ্য ব্যবহার করা হত। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে মহলে বরাবর রূপের কদর ছিল।’’ সেই সূত্র ধরে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি সুবীরেন্দ্রনাথের মেয়ে সুপূর্ণা চৌধুরী বললেন, “নিয়মিত নিমপাতা আর কাঁচা হলুদ খেতাম। আর স্নানের সময় হলুদ ও মঞ্জিষ্ঠা দিয়ে স্নান করতাম। বলা হত, সব রোগ দূরে থাকবে, চামড়া সুন্দর হবে।”

বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বায়োকেমিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের পঞ্চতিক্ত পাঁচনের উপাদানগুলি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন, "তেউরি, নিম, নিসিন্দা— এই তিন উপাদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তা শ্বাসজনিত রোগ আর ম্যালেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে পারে।’’

রবীন্দ্রনাথের এই পাঁচন যে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো ভাইরাসের সঙ্গে লড়েছিল তার প্রমাণ দিতে তিনি চিঠিতে লিখছেন, "ছেলেদের অনেকেই ছুটীর মধ্যে বাড়ীতে নিজেরা ভুগেছে এবং সংক্রামকের আড্ডা থেকে এবং কেউ কেউ মৃত্যুশয্যা থেকে এসেচে। ভয় ছিল, তারা এখানে এসে রোগ ছড়াবে— কিন্তু একটুও সে লক্ষণ ঘটেনি, এবং সাধারণ জ্বরও এ বছর অনেক কম।" ছাত্ররা কোনওভাবে ফাঁকি না দেয় সে দিকে কড়া নজর ছিল রবীন্দ্রনাথের।

নিজের ডাক্তারি নিয়ে নিজেই মজা করতেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে প্রশান্ত মহলানবিশের স্ত্রী রানিকে এক চিঠিতে লিখছেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় কোনও ভালো কবিরাজি টনিক ব্যবহার করলে তোমার ঘুসঘুসে জ্বরের ক্ষেত্রে কিরকম হয়। কবিরাজ বলতে আমাকে বুঝে নিও না, তাতে আমাকে খাটো করা হবে … আমি কবি-রাজ নই, কবিসম্রাট।’

কেমন করে বানাবেন পঞ্চতিক্ত পাঁচন?

উপকরণ

নিমপাতা— ২-৩টি ডাল

গুলঞ্চ— ডাল থেকে কেটে এক ইঞ্চি

তেউরি (কলাগাছের শেকড়)— এক ইঞ্চি

নিসিন্দা— এক চামচ

থানকুনি পাতা— ১০টা

পদ্ধতি

সব একসঙ্গে ভাল করে ধুয়ে নিন। এ বার জলে ফোটান। এক কাপের উপকরণ ফুটিয়ে আধ কাপ করুন। ঠান্ডা হলে দু’বেলা খান।

বিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মহামারি সারিয়েছিলেন পঞ্চতিক্ত পাঁচন দিয়ে। একবিংশ শতাব্দীর অতিমারি প্রতিরোধে কি তবে রবীন্দ্রনাথের এই কবিরাজি ফর্মুলা পরখ করে দেখা যেতে পারে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy