ধসের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন বাসিন্দারা।—ছবি পিটিআই।
দায়িত্বশীল পদে যাঁরা থাকেন, তাঁদের অনেকেই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে যে বেশি পছন্দ করেন, তা আমাদের জানা। কিন্তু এই রকম অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের ক্ষণে তেমনটা হওয়া কাম্য নয়। বৌবাজার যে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে, তার ধাক্কা সামলানোর জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াটা জরুরি। দায় ঠেলাঠেলিটা নয়।
বৌবাজারে যা ঘটেছে, তা ভয়াবহ। বছরের পর বছর কেটেছে যে পাড়ায়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম বড় হয়েছে যে বাড়িতে, রাতারাতি সে সব হঠাৎ নেই। গোটা এলাকার বাসিন্দারা এক সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনছেন, মেট্রো রেলের জন্য সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে ধাক্কা লেগে গিয়েছে জলস্তরে। পায়ের তলায় তাই ক্রমশ বসে যাচ্ছে মাটি। বাসিন্দারা দেখছেন, ফেটে যাচ্ছে একের পর এক বাড়ি, হেলে পড়ছে, তার পরে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এ লেন থেকে ও লেন, এ পাড়া থেকে ও পাড়া— একে একে সব ঢুকে পড়ছে বিপদের বৃত্তে। সরকারি কর্তারা এসে অবিলম্বে বাড়ি ছাড়তে বলছেন। এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে। ঘর-সংসার, স্মৃতি-ছেলেবেলা, জীবনের যাবতীয় সম্বলকে অনির্দিষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে কোনও হোটেলে বা কোনও পরিচিতের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেজে ওঠা সাধের ভিটে ক্রমশ মাটির তলায় চলে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল করেই জলস্তরে ধাক্কা লেগেছে, কিন্তু এ ভুল এড়ানোও কঠিন। কোথায় জলস্তর থাকে, নির্ভুল ভাবে বুঝে নেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই প্রায় অসম্ভব বলে তাঁদের মত। ধরে নেওয়া যাক, বিশেষজ্ঞরা ঠিকই বলছেন। কিন্তু তা হলেও তো গাফিলতির তত্ত্ব থেকেই যায়। অজান্তেই এমন বিপদ ঘনাতে পারে, সে আশঙ্কার কথা তো মাথায় রাখা উচিত ছিল, বিশেষত এত জনবহুল এলাকার নীচে সুড়ঙ্গ খননের আগে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
বৌবাজারবাসী সে বিতর্ক এখন তুলছেনই না। প্রশাসন যে ভাবে বলছে, সে ভাবেই তাঁরা সহযোগিতা করছেন। কোথাও কোথাও আধ ঘন্টার নোটিসে বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে। ঘরদোর, আসবাব-পত্র, জামাকাপড়, বাসন-তৈজস, জরুরি নথি— প্রায় কিছুই নিয়ে বেরোনোর সুযোগ হচ্ছে না। কার কতটুকু জমি ছিল, কার কটা ঘর ছিল, ঘরে কী কী ছিল, হিসেব রাখার ব্যবস্থা নেই। কোথায় থাকতে হবে এখন উদ্বাস্তু হয়ে, কত দিন থাকতে হবে, কী ফেরত পাওয়া যাবে, কবে পাওয়া যাবে, আদৌ পাওয়া যাবে কি না, কেউ জানেন না। অনির্দিষ্টের হাতে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে। তার পরেও বড় কোনও বিক্ষোভ নেই, অশান্তি নেই, অসহযোগিতা নেই। প্রশাসন আর একটু লোক বাড়ালে, নিজেদের মধ্যে আর একটু সমন্বয় বাড়ালে, বিশেষ কোনও উদ্ধারকারী দল নামালে পরিস্থিতি আর একটু সুবিধাজনক হতে পারত বিপর্যয়ের মুখে পড়া এলাকাবাসীর জন্য। এ ভাবে সর্বস্ব ফেলে রেখে বেরিয়ে যেতে হত না। তা-ও কেউ বিক্ষোভে ফেটে পড়েননি। মেট্রো কর্তৃপক্ষ, কলকাতা পুরসভা, রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার— প্রত্যেকের উচিত বৌবাজারবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা, উচিত নতমস্তক থাকা। কিন্তু তার বদলে দায় ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘কাজ, বাড়ি হারিয়ে সোনার খাঁচায় রয়েছি, ছেলেটার মুখে ভাত তুলে দিতে পারছি না’
রাজ্য বলছে, কেন্দ্রের গাফিলতি। কেন্দ্র পাল্টা বলছে, মুখ্যমন্ত্রীই তো নকশা বানিয়েছিলেন। কলকাতা পুরসভার তরফে যে ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা ছিল, সে দৃশ্য অনেকটাই অমিল। হতাশ হতে হয়। বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে সাধারণ নাগরিক কত পরিণত আচরণ করছেন। আর দায়িত্বশীল পদগুলোয় যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা দায় ঝাড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: ৫ লাখের ক্ষতিপূরণ কাদের, আপাতত ৭৫টি পরিবারকে চিহ্নিত করল মেট্রো
লজ্জা আর বাড়াবেন না। রাতারাতি বাস্তুহীন হয়ে পড়া নাগরিকদের পাশে দাঁড়ানোকে একমাত্র কর্তব্য বলে মনে করুন আপাতত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy