আশ্বিন সমাগতপ্রায়। দেবী আসিতেছেন। বৌবাজারের দেড়শত পরিবারের ঘরেও কি আসিতেছেন? এলাকার প্রায় সাতশত মানুষের পায়ের তলা হইতে আক্ষরিক অর্থেই মাটি সরিয়া গিয়াছে। তাঁহারা হঠাৎই গৃহহীন। নিজ গৃহ হারাইয়া বাসিন্দারা অস্থায়ী সংসার পাতিয়াছেন হোটেলের ঘরে। কিছু দিন পূর্বেও যেখানে ছিল গৃহস্থালির হাঁড়ি-কলসি, ভাতঘুমের আরামকেদারা— সবই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। শরতের সোনা রোদও সেই ধ্বংসস্তূপের সীমাহীন অন্ধকার সরাইয়া ভিতরে প্রবেশের ছাড়পত্র পায় নাই।
কাহার দোষে ঘটিল এমন মহাবিপর্যয়? অভিযোগের মূল তিরটি মেট্রোর দিকে। প্রশ্ন উঠিতেছে, তাঁহারা যথাযথ ভাবে মাটি পরীক্ষা করেন নাই কেন, মধ্য কলিকাতার এমন পুরাতন জনবহুল অঞ্চলে সুড়ঙ্গ কাটিবার পূর্বে পরীক্ষা করিয়া দেখা হয় নাই কেন, প্রাচীন বাড়িগুলি এই ধকল সহিতে পারিবে কি না ইত্যাদি। রাজনীতিও যথানিয়মে প্রবেশ করিয়াছে ধ্বংসস্তূপের আবর্তে। কাহার নির্দেশে মেট্রোর যাত্রাপথের এহেন পরিবর্তন— আসামিকে খুঁজিবার চেষ্টা চলিতেছে। কিন্তু এই সবই নিমিত্তমাত্র। মেট্রোর ভয়ঙ্কর গাফিলতি নিশ্চিত ভাবে প্রমাণিত হইলে, সেই ‘ষড়যন্ত্রকারী’ মন্ত্রী-আমলার হদিস মিলিলে বা ঘটনার অভিঘাতে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের পুরোপুরি সলিলসমাধি ঘটিলেও ভাঙা বাড়িগুলি জোড়া লাগিবে না, যাঁহারা কয়েক রাতের ব্যবধানে সর্বহারা হইলেন, তাঁহাদের ক্ষতেও প্রলেপ পড়িবে না। হ্যাঁ, ক্ষতিপূরণ তাঁহারা পাইতে শুরু করিয়াছেন বটে। কিন্তু যিনি একবস্ত্রে বাড়ি ছাড়িয়াছেন, পরিচয়পত্র, ব্যাঙ্কের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রটুকুও সঙ্গে লইতে পারেন নাই, তাঁহাদের সেই অপরিসীম ক্ষতি পূরণ হইবার নহে।
উন্নয়নের আখ্যানে যখন সাধারণ মানুষের প্রসঙ্গ আসে, তখনও তাহা আসে সমষ্টি রূপে। তাঁহাদের সমষ্টিগত সমস্যা, ক্ষোভ, রাজনীতি, সমাধানসূত্রের সন্ধান। এককের আখ্যানগুলি কিন্তু সমষ্টির অঙ্গ হইয়াও পৃথক। হোটেলের অস্থায়ী আস্তানায় যে শিশুটির মন টিকিতেছে না, আর নিজের বাড়ির একচিলতে বারান্দায় আসিয়া পড়া রৌদ্রের জন্য মন উচাটন হইতেছে যে বৃদ্ধার, তাঁহাদের সহিত কি তুলনা চলে বিবাহ স্থির হওয়া সেই তরুণীর, বিবাহের পর যাহার পিতৃগৃহ হইতে বিদায় লইবার সুযোগই হইবে না? যে ভাড়াটিয়ারা, হয়তো অন্যায্য ভাবেই, নামমাত্র ভাড়ায় শহরের প্রাণকেন্দ্রে বাস করিতেছিলেন দীর্ঘ দিন, তাঁহাদের অনিশ্চয়তার চরিত্র কি বাড়ির মালিকদের তুলনায় পৃথক নহে? নূতন বাড়ি তৈরি হইলেও সেই ঠিকানায় তাঁহাদের ঠাঁই হইবে কি না, এই প্রশ্ন সমষ্টির নহে, এককের। আবার, দূরবর্তী কোনও অঞ্চল হইতে সোনার গহনার কাজ করিতে যাঁহারা বৌবাজারে আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের বেকারত্বের আখ্যানটি অন্যদের তুলনায় পৃথক। ভাঙনের পর এই এককের গল্পগুলির আর কোনও উপসংহার হয় না। মাটির নীচে মেট্রোর সুড়ঙ্গ খুঁড়িবার পূর্বে যদি মাটির উপরের এই আখ্যানগুলির কথা কর্তৃপক্ষ ভাবিতেন, যদি গুছাইয়া লওয়ার সুযোগটুকু দেওয়া হইত তাঁহাদের, তবে হয়তো যে ক্ষতি পূরণ করা অসম্ভব, তেমন ক্ষতির পরিমাণ কমিত। কারণ, সেই ক্ষতির মূল কারণ পায়ের নীচে মাটি সরিয়া যাওয়া নহে, বুকের ভিতরের মাটিতে ধস। চাহিলে তাহা ঠেকানো যাইত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy