পারাপার: দল পরিবর্তনের পর দলাধিপতিদের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারী, পশ্চিম মেদিনীপুর, ১৯ ডিসেম্বর। পিটিআই।
এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে। সত্যিই কি গড়ছে? গড়লেও তা কতটা মজবুত? রাজ্য-রাজনীতি এখন এই সব প্রশ্নে আলোড়িত। ভোট যত এগোচ্ছে, ভাঙনের খেলায় ততই যেন দখল বাড়ছে বিজেপি-র। বস্তুত সাদা চোখে যা সবাই দেখছেন, তাতে তৃণমূলের ঘরে ভাঙনের ছবি খানিকটা হলেও স্পষ্ট। যদিও তাতে প্রতিপক্ষের উল্লাসের আদৌ কতটা কারণ আছে, এখনই হয়তো তা পুরোপুরি বোঝার সময় আসেনি। আরও অনেক কিছু দেখার বাকি।
রাজ্যে শাসক দল ছেড়ে যাঁরা ইতিমধ্যে বেরিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ভারী নাম কয়েকটি। আরও যাঁরা একই পথে পা বাড়াতে লাইন লাগিয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে, তার কিছুটা ঠিক হলেও তৃণমূলের পক্ষে বিষয়টি স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা নয়। কেউ মুখে স্বীকার করুন বা না করুন, দশ বছর রাজ্য শাসন করার পরে কেন এমন হচ্ছে, সঠিক আত্মসমীক্ষায় দল নিশ্চয় তার উত্তর পেয়ে যাবে। তবে এখনকার আলোচনা সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে।
গোড়াতেই বলা দরকার, দল ভাঙা, ভাঙানো বা দলত্যাগ কোনওটিই অভিনব কিছু নয়। ডান-বাম নির্বিশেষে এর ভূরি ভূরি উদাহরণ বাংলায় ছড়িয়ে আছে। সেখানে অবশ্য সর্বদাই সামনে রাখা হয়েছে কোনও নীতি বা আদর্শগত প্রশ্নকে। হতে পারে, সেই সব নীতি-আদর্শ কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট ‘জোরালো’ বলে মনে হয় না। আদর্শের মোড়কেও অন্য স্বার্থের দিকটি পুরোপুরি আড়াল করা যায়নি। তবু আপাত ভাবে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার অঙ্ক বড় করে না-তোলার একটি সচেতন প্রয়াস আগে থাকত।
এখন কিন্তু অন্য রকম। বরং যা হচ্ছে তা প্রধানত ব্যক্তিগত বঞ্চনা-অভিযোগ-ক্ষোভ-অভিমানের আধারে একটি হিসেবি রাজনৈতিক পদক্ষেপ। সেখানে ‘দেখ, কেমন লাগে’-র আত্মপ্রসাদ তো আছেই, তার সঙ্গে রয়েছে কিছু ‘প্রাপ্তি’র হাতছানিও। ভোটমুখী রাজ্য-রাজনীতি এই বাঁকে এসে পড়েছে।
তবে ব্যক্তিগত লাভ-অলাভের ঊর্ধ্বে একটি কথা মানতে হবে, তৃণমূলে এখন যে পর্ব চলেছে, তার বীজ বেশ কিছু দিন আগে রোপণ করা হয়েছে দলের ভিতর থেকেই। এর দু’টি দিক চিহ্নিত করা যায়। ক্ষমতার রাজনীতিতে পুরনো এবং নতুনের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই যদি তার একটি হয়, অন্যটি তবে ঘরের মধ্যে ‘বহিরাগতের’ অনুপ্রবেশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে এই দু’টিই নানা ভাবে অর্থবহ।
এক এক করে দেখা যাক।
প্রথমত, কংগ্রেস ভেঙে মমতা যখন তৃণমূল কংগ্রেস গড়েন, তখন তাঁকে বাড়তি চেষ্টা করে দল ভাঙতে হয়নি। কংগ্রেসের অনেক পুরনো নেতা নিজেরাই তাঁর সিপিএম-বিরোধী আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনিই দল গড়ছেন, মেনে নিয়ে যাঁরা আসার তাঁদের এক ঝাঁক সে দিন বেরিয়ে এসেছিলেন। পরে আরও। তৃণমূলের শুরুও হয়েছিল কার্যত শূন্য থেকে। ‘দেওয়ার’ মতো কিছুই সে দিন ছিল না।
আজ বত্রিশ বছরে দল শুধু কলেবরেই বাড়েনি, দশ বছর ক্ষমতাভোগের সুবাদে তার পরতে পরতে প্রত্যাশা, লালসা, প্রাপ্তি, দুর্নীতি ইত্যাদি বাসা বেঁধেছে। অনিবার্য পরিণামে সংগঠনে বেড়েছে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কামড়াকামড়ি। মমতা নিজে তা সবচেয়ে ভাল জানেন। ক্ষোভে-রাগে সে কথা বলেও দেন অনেক সময়।
ঘটনা হল, তৃণমূলে মমতার সর্বময় কর্তৃত্ব আজও প্রশ্নাতীত। কিন্তু পরবর্তী স্তর থেকেই তো ‘যুদ্ধ’ জারি! যার উৎসমুখে নবীন বনাম প্রাচীন অর্থাৎ আদি ও নব্য নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, আন্দোলন থেকে উঠে আসা এবং পুরনো পোড়-খাওয়া নেতাদের ‘মর্যাদা’ রক্ষার দাবি যার সঙ্গে জড়িয়ে। গত কয়েক বছরে মূলত এই প্রশ্নেই একটু একটু করে দলত্যাগের মাত্রা বেড়ে এখন ভোটের আগে পরিস্থিতি অনেকটাই কঠিন দেখাচ্ছে।
কোনও সচল সংগঠনে নবীন প্রজন্মের উত্থান হবে না কেন, সেই প্রশ্ন অযৌক্তিক নয়। তবে কোনও উত্থানের রূপ যদি অনেকের নজরে ঔদ্ধত্যের অবয়ব বলে মনে হতে থাকে, সংঘাত ও দূরত্ব দুই-ই তখন বাড়তে বাধ্য।
এই ধারণা ঠিক বা ভুল, সেই বিতর্কে না গিয়ে এটুকু বলাই যায়, মমতার দলে ‘শেষ কথা’ তিনি বলবেন, এটা এত দিনে স্বতঃসিদ্ধ। ক্ষমতার অন্য কোনও ভরকেন্দ্র মাথা তুললে তাতে সেই বিশ্বাস ও আবেগ ঘা খায়।
এইখানেই এসে পড়ে শাসক দলের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েনের দ্বিতীয় বিষয়টি। তা হল, ভোটকুশলীর আবির্ভাব! সবাই জানি, গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপি-র কাছে ধাক্কা খাওয়ার পরেই বিধানসভার ভোট মাথায় রেখে পেশাদার ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরকে ডেকে এনেছে তৃণমূল। সিদ্ধান্তটি অবশ্যই মমতার অনুমোদিত। যদিও বাংলার ভোটে মমতার দলে তাঁর উপর আর কাউকে প্রয়োজন হয় কি না, সেই তর্ক আজও বহাল।
কিন্তু আরও বড় প্রশ্ন হল, বাইরের এক জন পেশাদার এসে দলের ভিতরকার ব্যবস্থায় কী ভাবে, কত দূর হস্তক্ষেপ করতে পারবেন? তার একটি লক্ষ্মণরেখা নিশ্চয় থাকা উচিত। পেশাদার তাঁর
মতো করে মূল্যায়ন করতে পারেন, সমীক্ষা করে তাঁর নিয়োগকর্তাদের কাছে নিজের অভিমত বা সুপারিশ পেশ করতে পারেন। সংশ্লিষ্ট দলকে প্রয়োজন মতো কৌশলের ‘প্রশিক্ষণ’ দিলেও ক্ষতি নেই। তার বাইরে গিয়ে দলে অলিখিত নেতা হয়ে ওঠা, সর্বস্তরে বৈঠক করা, নিয়মিত আদেশ-নির্দেশ দেওয়া বা নেতা-জনপ্রতিনিধিদের ‘শাসন’ করা কি তাঁর কাজ?
তৃণমূল যদি তাদের ভোটকুশলীকে ততখানি ‘অধিকার’ দিয়ে থাকে, তা হলে ঠিক করেনি। আর যদি না দিয়ে থাকে, তবে তাঁকে সময়কালে এবং প্রকাশ্যে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল। কোনওটিই হয়নি। আজ ভোটের আগে পুরনো যাঁরা তৃণমূল ছেড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের অভিযোগের পুঁজিতে এগুলিও রয়েছে।
অন্য দিকে ‘মাছ’ ধরতে বিজেপি কী ভাবে জাল বিছিয়েছে সেটাও দেখার মতো। রুই-কাতলা-চুনোপুঁটি কেউ সেখানে ফেলনা নয়! লোকসভা ভোটের আগে তৃণমূলে টিকিট পাবেন না বুঝে বেশ কয়েকজন ‘পদ্ম’ আঁকড়েছিলেন। জাতীয় রাজনীতির হাওয়ায় তাঁদের একাংশ জিতেও যান। আর এ বার রাজ্য দখলের লড়াইতে তৃণমূল-ত্যাগীদের জন্য বিজেপি তাদের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে।
তবে গোড়াতেই বলেছি, এ কূল ভাঙলেই যে ও কূল গড়তে থাকবে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা শক্ত। আর সেটাই এই খেলার সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তার জায়গা। কারণ তৃণমূল থেকে বড় মাপের মন্ত্রী-নেতা-জনপ্রতিনিধিদের বিজেপি-তে যোগদান যেমন দৃশ্যমান, তেমনই তাঁদের নিয়ে বিজেপি-র অন্দরে অসন্তোষও চাপা নেই।
আসলে নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্ব তৃণমূলের ক্ষেত্রে যেমন সঙ্কটের, বিজেপি-তেও তেমন। এটাই হয়তো স্বাভাবিক। তার প্রকাশ ইতিমধ্যে দেখাও যাচ্ছে। তবে সঙ্ঘের অনুশাসনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বিজেপি তুলনায় শৃঙ্খলাবদ্ধ বলেই সেখানে বিরোধ-বিসংবাদ মাথা চাড়া দিলে তাকে দমানোর ব্যবস্থাও আছে। তাই আসানসোলের জিতেন্দ্র তিওয়ারির তৃণমূল থেকে চলে আসার সম্ভাবনা রুখতে বিজেপি-র যাঁরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন, দল তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে দেরি করেনি।
কিন্তু কণ্ঠরোধ করলেই তো ক্ষোভ চাপা পড়ে না। দল ভেঙে এলে রাতারাতি এটা-ওটা পাইয়ে দেওয়া, মর্যাদার আসনে বসানো এবং ‘উজ্জ্বল’ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখানো পদ্ম-শিবিরেও তুষাগ্নির কারণ হচ্ছে।
সে দিন রাজ্য সফরে এসে বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডা বাংলার দলীয় নেতাদের প্রশ্ন করেছিলেন, কেন ভোটের আগে বিজেপি-তে আসার এত ঢল?
প্রশ্নটি অমায়িক, তবে বড় গভীর। এক জনের ‘পৌষ মাস’ হলেই যে অন্যের ‘সর্বনাশ’, এ কথা কি বেদে লেখা আছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy