বিজেপি তা হলে এসেই গেল, শিবুদা?” দুঃখিত গলায় প্রশ্ন করে শিশির। একটা দেশলাই কাঠির পিছন দিকটা দিয়ে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে কান চুলকোচ্ছিলেন শিবুদা। শিশিরের প্রশ্নটা শুনে কাঠিটাকে অ্যাশট্রে-তে ফেলে বললেন, “সে কী রে! এত খেটেখুটে ওপিনিয়ন পোল করল, আঠারো হাজার স্যাম্পল সাইজ়— তার রেজ়াল্ট তো বলছে, দিদিই ফিরছেন। তবু বলছিস, বিজেপি এসে গেল?”
“ওই আনন্দেই থাকুন,” ফুট কাটে তপেশ, “ফেসবুকে সবাই কী লিখছে, দেখছেন না? এত মানুষ বেশি জানে, না আপনার ওপিনিয়ন পোল?”
“যারা লিখছে, তারাই বা কী করে জানল যে, বিজেপি ভোটে জিতছে? ক’টা লোকের সঙ্গে কথা বলে লিখছে, ক’টা জায়গায় ঘুরে লিখছে?” পাল্টা প্রশ্ন করলেন শিবুদা।
শিবুদা তার প্রশ্নটাকে সিরিয়াসলি নেবেন, ভাবেনি তপেশ। তবে, তার জবাব হাজির, “সবাই বলছে, তা-ই সবাই বলছে।”
“এক্জ়্যাক্টলি, সবাই বলছে, তা-ই সবাই বলছে। সেই বলাটায় চার আনারও বাড়তি ইনফর্মেশন নেই। কাজেই, সবাই বলছে বলেই বিজেপি আসছে, ব্যাপারটা অত সস্তা নয়।” এত ক্ষণ টেবিলের ওপর ঝুঁকে ছিলেন, কথা শেষ করে শিবুদা চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। তার পর বললেন, “কোন দল ভোটে জিতবে, সেটা বলা রাম-শ্যাম-যদু-মধুর পক্ষে, তোর-আমার পক্ষেও, অসম্ভব। কারণ, আমাদের কাছে সেই ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো তথ্যই নেই। থাকা সম্ভবই নয়। গোটা গোটা ওপিনিয়ন পোল ফেল মেরে যাচ্ছে রেজ়াল্টের ভবিষ্যদ্বাণী করতে— যেটায় স্পষ্ট মেথডলজি আছে, বিরাট স্যাম্পল সাইজ় আছে— আর, চায়ের দোকানে বসে আড্ডা মারতে মারতে বলে দেওয়া যায় যে, বিজেপি আসছে? ইয়ার্কি হচ্ছে? এই কথাটা আসলে আমরা সবাই, অবচেতনে হলেও, জানি। আর জানি বলেই, নিজেদের বলার ওপর নিজেদেরই খুব ভরসা নেই— আমরা দেখতে চাই, অন্যরা কী বলছে। যদি দেখি যে, অন্য অনেকে এক কথা বলছে, আমরাও সেই কথাটাই আওড়াতে থাকি। আমরা বিশ্বাস করে নিই, যে হেতু অনেকে বলছে, তাদের কাছে নিশ্চয়ই এমন কোনও তথ্য আছে, যেটা আমার কাছে নেই, আর তারা যেটা বলছে, সেই তথ্যের ভিত্তিতেই বলছে।”
“ইনফর্মেশন কাসকেড-এর কথা বলছেন তো? যত বেশি লোক এক কথা বলবে, তত বেশি লোক সেই কথাটায় বিশ্বাস করবে?” প্রশ্ন করে সূর্য।
“একদম। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি পুরনো একটা এক্সপেরিমেন্টের কথা বলি, শোন।” গোপালের দিয়ে যাওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কথার খেই ধরে নেন শিবুদা। “১৯৬৯ সালে, যদ্দুর মনে পড়ছে জার্নাল অব পার্সোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজি-তে বেরিয়েছিল পেপারটা। সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের তিন সাইকোলজিস্ট, স্ট্যানলি মিলগ্রাম, লেনার্ড বিকম্যান আর লরেন্স বার্কোউইটজ় একটা বিচিত্র এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তায়, শীতের বিকেলবেলায়। রাস্তায় তখন অফিস-ফেরত মানুষের ভিড়। সেই রাস্তায় মিলগ্রামদের ঠিক করা কিছু লোক ছিল— যাদের কাজ ছিল, একটা নির্দিষ্ট সঙ্কেত পাওয়ামাত্র টানা এক মিনিট আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। কখনও এক জন লোক, কখনও দু’জন, কখনও পাঁচ, কখনও দশ, আবার কখনও পনেরো জন লোক ওই রকম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত এক মিনিট— তার পর টুক করে কেটে পড়ত জায়গাটা থেকে।
“মিলগ্রামরা আসলে দেখতে চাইছিলেন, কত জন লোক আকাশের দিকে চেয়ে আছে, সেই সংখ্যাটা কি পথচলতি মানুষকে প্রভাবিত করে? দেখা গেল, বিলক্ষণ করে। যখন এক জন লোক ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকল, পথচারীদের এক জনও তাকে দেখে দাঁড়াল না। দু’জন দাঁড়ালে সামান্য কয়েক জন এক বার আকাশের দিকে তাকিয়েই হাঁটা দিল। কিন্তু, যখন পনেরো জন এক সঙ্গে আকাশ দেখল, দেখা গেল, ৮৭ জন পথচারী দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। উপরে কী হচ্ছে, না জেনেও তাঁরা দেখছেন। কেন? কারণ, এত জন লোক যখন দেখছে, তখন নিশ্চয়ই কিছু একটা হচ্ছে, তাই না?”
“মানে, আপনি বলতে চাইছেন যে, আইটি সেলের ভাড়া করা লোকজন গোড়ায় একটা হাওয়া ছড়িয়েছে যে বিজেপি আসছে, আর মানুষ কিছু না জেনেই সেটা আওড়ে চলেছে?” প্রশ্ন করল তপেশ।
“বলতে চাইছি না, সেটাই বলছি।” অবিকল দেয়া-নেয়া’র কমল মিত্তিরের গলায় উত্তর দিলেন শিবুদা। শিশিরের প্যাকেটটা টেনে নিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। একটা টান দিয়ে খুক-খুক করে একটু কাশলেন, তার পর বললেন, “এই প্রচারটা যে বেশ সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে চালানো হচ্ছে, সেটা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। প্রশ্ন হল, কথাটার যদি কোনও বাস্তব ভিত্তি না থাকে, তা হলে গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে এই প্রচার চালিয়ে লাভটা কী?” কথার মধ্যেই কাশির দমক বাড়ে শিবুদার। সিগারেটের অবশিষ্টাংশ অ্যাশট্রেতে গুঁজে দেন। শরীর বলছে, এই বার বুদ্ধির গোড়ায় ধোয়া দেওয়ার অভ্যাসটা ছাড়তেই হবে।
“আচ্ছা, আমি বলছি, আপনি শুনুন। ভুল বললে শুধরে দেবেন।” শিবুদাকে থামায় সূর্য। “যখন যথেষ্ট সংখ্যক লোক বলতে শুরু করে যে বিজেপি আসছে, তখন বাকিরা— যাদের কাছে এমনিতে এই কথাটা বিশ্বাস করার মতো তথ্য নেই— তারাও কথাটায় বিশ্বাস করতে শুরু করে। এমনকি, যাদের কাছে উল্টো কথাটা বিশ্বাস করার মতো তথ্য আছে— যারা চারপাশে দেখছে যে মানুষ এখনও তৃণমূলকেই সমর্থন করছে— তারাও নিজেদের জানাটাকে পাশে সরিয়ে রেখে অন্যদের জানায় বিশ্বাস করতে থাকে। কারণ, ‘সবাই কি আর ভুল বলবে’?
“এর পর হল ‘ব্যান্ডওয়াগন এফেক্ট’— সবাই যে দিকে ঝুঁকছে, আমিও সে দিকে ঝুঁকব। বিশেষত সেই ক্ষেত্রে, যেখানে আমার নিজের প্রেফারেন্স খুব স্ট্রং নয়। আপনি বলুন শিবুদা, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কি এই ফ্লোটিং— ভাসমান— ভোটারদের পাকড়াও করতে চাইছে না এই প্রচারটা চালিয়ে?”
“অ্যাদ্দিনে একটা বলার মতো শাগরেদ তৈরি হল!” সূর্যর পিঠ চাপড়ে দেন শিবুদা। কাশির দমক সামলেছেন এত ক্ষণে। “একদম ঠিক ঠিক জায়গাগুলো ধরেছিস। আমার মতো লোক, যারা মরে গেলেও বিজেপিকে ভোট দেবে না, তাদের নিয়ে বিজেপিরও মাথাব্যথা নেই। তারা ধরতে চাইছে সেই সব লোকদের, যারা তৃণমূলের উপর খানিকটা খাপ্পা, অথবা আগে সিপিএমকে ভোট দিত, এই রকম। সেই সংখ্যাটা কিন্তু নেহাত কম নয়। তারা যদি অন্যরা বিজেপিকে ভোট দিচ্ছে ভেবে নিজেদের ভোটগুলোও বিজেপিকে দিয়ে দেয়, ভোটের রেজ়াল্ট ঘুরে যেতে পারে। এই প্রচারের মূল উদ্দেশ্য সেটাই। হার্ড বিহেভিয়রই বলিস কি ইনফর্মেশন কাসকেড, সেখানে সিকোয়েন্সিং-এর গল্প থাকে— অন্যরা কী করছে, আগে সেটা দেখে তার পর লোকে সেটা করে। ভোটের ক্ষেত্রে তো আর আগে থেকে জানার উপায় নেই যে কে কাকে ভোট দিচ্ছে। সেই কারণেই এই প্রচারটা তৈরি করা, যাতে মানুষের মনে একটা সিকোয়েন্সিং-এর বিভ্রম তৈরি করা যায়।
“কিন্তু, একটা অন্য প্রশ্ন আছে— ‘ব্যান্ডওয়াগন এফেক্ট’ হয় কেন? অন্যরা একটা দলকে ভোট দিচ্ছে দেখে আমিও কেন সেই দলকে ভোট দিতে দৌড়োব, এমনকি সেই দলের সমর্থক না হয়েও?” গল্পে একটা নতুন টুইস্ট দিয়ে শিবুদা থামলেন। শিশিরের সিগারেটের প্যাকেটটার দিকে হাত বাড়িয়েও ফের গুটিয়ে নিলেন। তার পর বললেন, “মানুষ হারতে ভয় পায়। যেখানে রাজনৈতিক বিশ্বাস খুব গভীর, সেখানে দল হারলে হার মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু, যেখানে বিশ্বাস বা সমর্থন তত শক্তপোক্ত নয়, সেখানে মানুষ যে দল জিতবে বলে মনে হচ্ছে, সে দলের দিকে হেলে পড়ে। বিস্তর রিসার্চ হয়েছে এ বিষয়ে। বিশেষ করে, যেখানে নির্বাচন হয় দুটো দলের মধ্যে, সেখানে। পশ্চিমবঙ্গে তো এখন দুটোই দল— বাকিগুলো তো নামমাত্র।
“রাজ্যের একটা বড় অংশের মানুষের মনে যদি এই ধারণা তৈরি করে দেওয়া যায়— কোনও বাস্তব ভিত্তি ছাড়াই যদি গোড়ায় ধারণাটা তৈরি করা হয়— যে, বিজেপি জিতবে, অনেক মানুষ সেই জয়ী দলের পক্ষে থাকার জন্য বিজেপিকে ভোট দিতে পারেন, এমন সম্ভাবনা আছে। তাঁরা অনেকেই হয়তো ব্যক্তিগত ভাবে বিজেপির বিভেদনীতিতে বিশ্বাসী নন। এটাও মানেন যে, নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের অশ্বডিম্ব বই বিশেষ কিছু মেলেনি। তবুও, শুধু জয়ী দলের দিকে থাকবেন বলে অনেকে বিজেপিকে ভোট দিতে পারেন, এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা যায়। বিজেপি সুকৌশলে সেই খেলাটাই খেলছে।”
“তা হলে কী বলছেন, বিজেপি ক্ষমতায় আসছে না?” তার গোড়ার প্রশ্নটায় ফিরে যায় শিশির।
“গোপালের দোকানে বসে ভোটের প্রেডিকশন করার মতো গণ্ডমূর্খ এখনও হইনি,” উত্তর দেন শিবুদা। “আমি শুধু বলছি, কোন দল জিতবে, সেটা বলার মতো তথ্য আমার মতো সাধারণ মানুষের হাতে নেই। কাজেই, যাকেই দেখবি বলছে যে বিজেপি জিতবে, চেপে ধর। জানতে চা, কোন মন্ত্রবলে সে এই কথাটা জেনেছে। এই লোকগুলো, জেনে অথবা না জেনে, আইটি সেলের লেজুড় হয়ে গেছে। এদের থামানোই এখন প্রথম কর্তব্য।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy