Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
Bijay Kumar Bandyopadhyay

আল পথ ধরে যেতেন ইতিহাসের সন্ধানে

সাম্প্রতিককালে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিজয়বাবুর সময় কিন্তু আবহ আজকের মতো অনুকূল ছিল না। লিখছেন চন্দ্রপ্রকাশ সরকার স্কুল শেষ করার পরে সাইকেল নিয়ে বা পায়ে হেঁটে চলে যেতেন মুর্শিদাবাদের কোনও প্রান্তে। সেখান থেকে কুড়িয়ে আনতেন অমূল্য রতন।

সম্মাননা: কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলে বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্মান জ্ঞাপন। (ফাইল চিত্র)

সম্মাননা: কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলে বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্মান জ্ঞাপন। (ফাইল চিত্র)

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:২৫
Share: Save:

স্কুল শেষ করার পরে সাইকেল নিয়ে বা পায়ে হেঁটে চলে যেতেন মুর্শিদাবাদের কোনও প্রান্তে। সেখান থেকে কুড়িয়ে আনতেন অমূল্য রতন। নিরলস নিষ্ঠায় সেই সন্ধানের কাজটি আমৃত্যু করে গেলেন সদ্যপ্রয়াত ইতিহাস গবেষক বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজয়বাবুর জন্ম ১৯২৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর। তাঁর পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার শ্রীখণ্ডের ফুলিয়া গ্রামে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে (১৭৪২ -- ১৭৫১) বর্গী হাঙ্গামার সময় ভাগীরথীর পশ্চিম দিক অর্থাৎ মুর্শিদাবাদের রাঢ় অঞ্চল ও তৎসংলগ্ন বর্ধমান জেলার বহু বর্ধিষ্ণু পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পূর্ব পাড়ে অর্থাৎ বাগড়ি এলাকায় চলে আসেন। বিজয়বাবুর পিতৃপুরুষেরা সেভাবেই চলে আসেন হরিহরপাড়া থানার মহিষমারা গ্রামে। সুপ্রাচীন ওই গ্রামটি বিখ্যাত ভান্ডারদহ বিলের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত। তাঁর পিতা তিনকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন নিকটবর্তী কেদারচাঁদপুর গ্রামের (নওদা থানা) জমিদার জীবনকালী মুখোপাধ্যায়ের গোমস্তা। মাতা সুবর্ণলতা দেবী ছিলেন বহরমপুর সৈদাবাদের সম্ভ্রান্ত ভট্টাচার্য পরিবারের সন্তান। তৎকালীন সামাজিক প্রথা অনুযায়ী সৈদাবাদের কাঠমাপাড়ায় মামার বাড়িতেই তাঁর জন্ম হয়। তিনি ছিলেন আট ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। মহিষমারার পাশের গ্রাম ঘোড়ামারা ফ্রি প্রাইমারি স্কুল থেকে চতুর্থ শ্রেণি পাশ করে ভর্তি হন মানিকনগর এমই স্কুলে। তারপর সৈদাবাদের মণীন্দ্রচন্দ্র বিদ্যাপীঠে ভর্তি হন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সেখান থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৯ সালে কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পরেই সহকারি শিক্ষক হিসেবে মহিষমারা এমই হাই স্কুলে যোগ দেন। সেখান থেকে ১৯৫০ সালে চলে আসেন নবগ্রামের গুড়াপশলা শিক্ষানিকেতনে। শিক্ষকতার পাশাপাশি চলতে থাকে নিজের পড়াশোনাও। ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেন এই জেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলে।

অত্যন্ত অমায়িক ও বিনয়ী এই মানুষটি কেবল ঋজুদেহীই ছিলেন না, ছিলেন দৃঢ়চেতাও। তাঁর পড়ানোয় মুগ্ধ বহু কৃতি ছাত্র ছড়িয়ে রয়েছেন সারা দেশে।

তিনি নিজে পড়েছেন বাংলা সাহিত্য, সারা জীবন পড়িয়েছেন বাংলা সাহিত্য। সাহিত্যের প্রতি তার আকর্ষণ পারিবারিক বৌদ্ধিক পরিবেশ থেকেই। কিন্তু তাঁর গবেষণার বিষয় ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব। এ বিষয়ে তাঁকে উৎসাহিত করেন এ জেলায় একদা কর্মরত আইএএস অফিসার অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর আরোপিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই ১৯৯২ সালে লিখে ফেলেন ‘পশ্চিমবঙ্গে পুরাসম্পদ : মুর্শিদাবাদ’ গ্রন্থটি। ক্ষেত্রসমীক্ষা ভিত্তিক এই গ্রন্থটির কল্যাণেই তিনি বস্তুত পুরাতত্ত্বের গবেষক হিসেবে রাজ্যের বিশিষ্টজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ২০০৯ সালের ২৫ জুলাই পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে বিজয়বাবুর হাতে তুলে দেন রাখালদাস স্মৃতি পুরস্কার। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘প্রাচীন মুর্শিদাবাদে কর্ণসুবর্ণ ও মহীপাল’ (২০০২), ‘শহর বহরমপুর’ (২০০৩), এবং তার পরে ‘মুর্শিদাবাদ যুগে যুগে’, ‘মুর্শিদাবাদের মন্দির’, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন’-এর মতো গ্রন্থ। এ ছাড়া ছোটদের দিকে লক্ষ্য রেখে লিখেছেন স্বল্পকায় গ্রন্থ ‘ইতিহাসের মুর্শিদাবাদ’। তাঁর প্রতিটি গ্রন্থই মুর্শিদাবাদ চর্চাকারীদের কাছে অপরিহার্য।

তিনি আমৃত্যু অক্লান্ত ভাবে মুর্শিদাবাদ জেলাঞ্চলের ইতিহাস চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে একজন প্রকৃত ইতিহাসবিদের ভূমিকা পালন করলেও সেই অর্থে সরকারি স্বীকৃতি বা পুরস্কার তাঁর জোটেনি। যদিও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ তাঁকে সংবর্ধিত করে। সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে স্থানীয় বাসভূমি পত্রিকার তরফে ২০১২ সালে সম্মাননা জ্ঞাপন করা হয়।

সাম্প্রতিককালে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নতুন নতুন উপকরণও আবিষ্কৃত হচ্ছে। কিন্তু বিজয়বাবু যখন এই কাজ শুরু করেছিলেন, সে সময় আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার আবহ আজকের মতো অনুকূল ছিল না। কিন্তু তাতে তিনি থেমে থাকেননি। বরং তা যেন জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল।

ইতিহাস চর্চার দু’টি ধারা। একটি হলো রাজরাজড়া ও নবাব-বাদশাদের ইতিহাস, আরেকটি হল সামাজিক ইতিহাস বা জনজীবনের ইতিহাস। বিজয়বাবু মূলত প্রথম ধারা নিয়ে চর্চা করেছেন। বিশেষত প্রাচীন স্থাপত্য সম্পর্কিত পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহ করে তা সাধারণের মনোগ্রাহী করে পরিবেশন করেছেন। তাঁর নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় ছিল অসাধারণ। যে সময় তিনি জেলার প্রান্তে-প্রত্যন্তে ইতিহাসের মণিমাণিক্য তুলে আনার সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন, বলা বাহুল্য, তখন জেলার পথঘাট ছিল দুর্গম। পাকা রাস্তা ছিল হাতেগোনা অল্প কয়েকটি। মোটরযান ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। সেই সময় কাদা-জল, ধুলোমাটি, আল পথ ভেঙে কখনও সাইকেলে কখনও পায়ে হেঁটে চষে ফেলেছেন সারা জেলা। জেলাকে তুলে এনেছেন হাতের তালুতে।

শুধু স্থাপত্য বা পুরাতত্ত্বের অনুসন্ধানই নয়, জেলার খাল-বিল, নদনদী, জলাশয় ইত্যাদিও ছিল তাঁর আগ্রহের বস্তু। ২০০৩ সালে মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় আট শতাধিক পৃষ্ঠার বিশালাকৃতি মুর্শিদাবাদ জেলা গেজেটিয়ার। ওই গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রেও বিজয়বাবু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

টুকরো টুকরো আঞ্চলিক ইতিহাসের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে ক্রমবিবর্তিত সমাজ জীবনের সামগ্রিক ইতিহাস। তাই আঞ্চলিক ইতিহাসের মূল্য অপরিসীম। বিজয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে রেখে গেলেন অবিস্মরণীয় অবদান।

তথ্যসূত্র: প্রকাশ দাস বিশ্বাস, সাপ্তাহিক ঝড়

অন্য বিষয়গুলি:

Bijay Kumar Bandyopadhyay Historian Murshidabad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy