দুর্ঘটনার পরে ভোপালের একটি হাসপাতালে। ফাইল ছবি
৩৫ বছরেরও আগে ভোপাল শহরের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চোখে ভেসে উঠত সবুজে মোড়া এক শহরের ছবি। ভোপাল মানে সবুজ নগরী, ভোপাল মানে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম হ্রদের এক নগরী। এই সেই রাজ্য যাকে চার প্রজন্ম শাসন করেছেন নবাব বেগমেরা (১৮১৯-১৯২৬)। কিন্তু, ৩৫ বছর আগে ১৯৮৪-এর ২ ডিসেম্বরের রাত পাল্টে দিল সব কিছু। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়ঙ্কর শিল্পদূষণের অভিঘাতে ঢাকা পড়ে গেল ভোপালের নান্দনিক পরিচয়। দূষণের ক্ষত নিয়ে সে হয়ে থাকল এক মর্মান্তিক উদাহরণ।
ভোপালের জনবসতির মধ্যেই ছিল ইউনিয়ন কার্বাইড-এর রাসায়নিক কারখানা। তৈরি ও সঞ্চিত হত উদ্বায়ী বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট। ২ ডিসেম্বর রাতে কারখানার ‘সি প্ল্যান্ট’-এ সঞ্চিত মিথাইল আইসোসায়ানেটের ৬১০ নম্বর ট্যাঙ্কে কোনও ভাবে জল মিশে যায়। তাপদায়ী বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস। উদ্ভূত ভয়ঙ্কর তাপ ও চাপে ট্যাঙ্ক খুলে প্রায় ৪০ মেট্রিক টন মারণ মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। চোখজ্বালা, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের প্রদাহে আক্রান্ত হন প্রায় সাড়ে আট লাখ জনবসতির ভোপালের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ।
বাতাসে মিথাইল আইসোসায়ানেটের ০.৪ পিপিএম (পার্ট পার মিলিয়ন)-এর উপস্থিতিই বিপজ্জনক। তা ২১ পিপিএম এ পৌঁছলে মৃত্যু অনিবার্য। ভোপালে এর মাত্রা পৌঁছেছিল তারও কয়েক গুণ বেশি। তাই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অসহনীয় কষ্ট নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন প্রায় তিন হাজার মানুষ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভোপাল গ্যাসকাণ্ডে মোট মৃতের সংখ্যা ৩,৭৮৭, শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ৫,৫৮,১২৫ জন। যার মধ্যে ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে স্থায়ী পঙ্গুত্বের শিকার হন ৩,৯০০ জন। তবে ভোপাল গ্যাসকাণ্ডের দুর্গতদের পক্ষে আন্দোলনকারীদের দাবি, অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা আট থেকে দশ হাজার।
মারণ গ্যাস থেকে রেহাই পায়নি গর্ভস্থ সন্তানেরা। গর্ভাবস্থায়ই শতকরা ৪৩ জন নারীর সন্তান মারা যায়, ঘটে গর্ভপাতও। যারা পৃথিবীর মুখ দেখতে পেয়েছিল তাদের শতকরা ১৪ জনের মৃত্যু ঘটে জন্মের এক মাসের মধ্যে। মারা যায় হাজার হাজার পশুপাখি, পাতাহীন হয়ে পড়ে গাছেরা, হলুদ হয়ে যায় ঘাস, জল হয়ে পড়ে দূষিত। পরে দেখা যায় বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে উদাসীনতা আর অসতর্কতা এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। যেমন, ছোট ছোট ড্রামের বদলে রাসায়নিক রাখা হত বড় বড় ট্যাঙ্কে। ক্ষয়ে যাচ্ছিল পাইপলাইনও। ঘাটতি ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং বিপর্যয় মোকাবিলার পরিচালন ব্যবস্থাতেও।
প্রকৃতি ও পরিবেশকে অবহেলা করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির দম্ভকে এ ভাবেই দুমড়ে-মুচড়ে দিল ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা। আসলে সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটেছে দূষণ, বিশেষ করে বায়ুদূষণ। তা আগুনের আবিষ্কারেই হোক কিম্বা দু’হাজার বছর আগে কৃষিসভ্যতার পত্তনে। রোমান সভ্যতায় পশুপালন ঘটিয়েছে মিথেন-এর দূষণ। চিনের হান সভ্যতায় ধাতুর ব্যবহার, স্পেনীয় উপনিবেশ হওয়ার আগে ও পরে ইনকা সভ্যতায় ধাতুনিষ্কাশন সবই উপহার দিয়েছে বায়ুদূষণ। অষ্টাদশ শতকের শিল্পবিপ্লবে চরম প্রশ্রয় পেল বায়ুদূষণ। এ নিয়ে সচেতনতা ছিল দূর অস্ত্। ১৯৪৮ সালে পেনসিলভেনিয়ার শিল্পনগরী ডোনোরা শহরে ঘটল বায়ুদূষণের চরম বিপর্যয়। দূষিত গ্যাস ও ধাতুকণায় পাঁচ দিন অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল শহর। হাজার হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। মারা যান অন্তত কুড়ি জন। জনমত প্রবল হয়ে উঠল শিল্পের বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে।
১৯৭২ থেকে চেষ্টার পরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে ১৯৭৪ সালের পাঁচ জুন পালিত হয় প্রথম ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। কিন্তু তার পাঁচ বছরের মাথায় আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার কাছে থ্রি-মাইল দ্বীপে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটল পারমাণবিক চুল্লিঘটিত দুর্ঘটনা। যদিও তৎপরতায় বিশেষ ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। আর দশ বছরের মাথায় ঘটল বৃহত্তম শিল্পবিপর্যয় ‘ভোপাল দুর্ঘটনা’। এই দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বায়ুদূষণ বা শিল্পদূষণের ভয়াবহতা। তাই এরই প্রেক্ষিতে সচেতনতার তাগিদে ভারতবর্ষে প্রতি ২ ডিসেম্বর পালিত হয় ‘জাতীয় দূষণ প্রতিরোধ দিবস’। কিন্তু শিল্পজনিত দুর্ঘটনা থেমে থাকেনি। ১৯৮৬ সালে ২৬ এপ্রিল আরও একটি ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনার সাক্ষী থাকে বিশ্ব। ইউক্রেনের চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চার নম্বর ইউনিটে বিস্ফোরণ ঘটে। সে দুর্ঘটনার জেরে আজও ইউক্রেনের ওই বিশাল অঞ্চল জনশূন্য। ভারত সরকার দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও নিবারণের জন্য তৈরি করেন অনেক আইন। যেমন, ১৯৮৬-এর পরিবেশ সুরক্ষা আইন, ১৯৮৯-এর ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুত সংরক্ষণ ও ব্যবহারবিধির জন্য আইন, ১৯৮৯-এর ক্ষতিকারক বর্জ্যসংক্রান্ত আইন, ১৯৯৬-এর রাসায়নিক দ্রব্যঘটিত দুর্ঘটনা সংক্রান্ত আইন ইত্যাদি।
পরিবেশ দূষণের কারণ হিসেবে জলদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিকদূষণ, তেজস্ক্রিয়তার দূষণ ইত্যাদি তো রয়েছেই, তবে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান ভাগীদার বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ শুধু মানুষের ক্ষতি করছে না, ক্ষতিসাধন করছে প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্রেরও। বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছরে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটছে। এর জন্য ফুসফুসের রোগে প্রাণ হারান প্রায় ১৮ লক্ষ, হৃদরোগে ২৪ লক্ষ, স্ট্রোকে প্রায় ১৪ লক্ষ মানুষ। সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে অ্যালজামাইর্স রোগে বায়ুদূষণের ভূমিকার কথা।
বায়ুদূষণের কারণ বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন ক্ষতিকারক ক্ষুদ্র বস্তুকণা এবং কিছু বিষাক্ত গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি। তাদের উৎস কয়লা ও অন্য জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবহার, কৃষিকাজ, পশুপালন, ইঞ্জিনচালিত গাড়ির ব্যবহার ইত্যাদি। তেমনই উৎস হিসেবে বড় ভূমিকা শিল্পেরও। একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গত আট বছরে ভারতে দূষণকারী কারখানার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলেও বায়ুদূষণে শিল্পের ভূমিকা কম নয়। ‘আর্বান এমিশন’-এর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে আসানসোল শিল্পাঞ্চলে বায়ুদূষণের উৎস হিসাবে কারখানার অবদান শতকরা ৯ ভাগ, ইট পোড়ানো বা নির্মাণ শিল্পের অবদান শতকরা ১৪ ভাগ ,গাড়ির ধোঁয়ার অবদান শতকরা ১২ ভাগ। আর দূষণের মাপকাঠি পিএম ২.৫ (বাতাসে ভাসমান ২.৫ মাইক্রোমিটার কম ব্যাসের কণা)-এর মোট পরিমাণ ৬৯,৪০০ ইউনিট টনের মধ্যে কারখানা শিল্প দিয়েছে ৪৫,৭৫০ ইউনিট এবং পিএম ১০-এর মোট পরিমাণ ১,১৪,৩৫০ ইউনিট টনের মধ্যে শিল্পের দান ৫১,১৫০।
বিকাশের জন্য শিল্পের অবশ্যই প্রয়োজন। তবে শিল্প ও পরিবেশের মধ্যে একটি ভারসাম্য থাকা দরকার, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। দূষণ সম্বন্ধে এবং দূষণ সম্পর্কিত আইন সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের সচেতনতার যেমন দরকার, তেমনই প্রয়োজন আইনভঙ্গকারীদের কড়া হাতে দমন করে তাদের জন্য দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থার।
লেখক আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy