Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

সিনেমাকে যদি সাবালক হতে হয়

নিউ থিয়েটার্স-এর ‘চণ্ডীদাস’ ১৯৩২-এ মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু দেবকীকুমার বসু পরিচালিত এই কিংবদন্তি ছবিটি দেখেননি বুদ্ধদেব। একটি লেখায় কবুল করেছিলেন, ‘‘দেখিনি যে, সেটা যদি আশ্চর্যের হয়, তার চেয়েও আশ্চর্যের এই যে, দেখার ইচ্ছেও কখনও হয়নি।’’

শিলাদিত্য সেন
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

বাসে করে যাচ্ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। পিছনের সিটে বসা দু’টি ছেলে, এক জন জানতে চাইছে, কেমন হয়েছে ‘চণ্ডীদাস’? উত্তরদাতা বিস্মিত, ‘‘সে কী! চণ্ডীদাস তুই দেখিসনি? এ-ক-বা-র-ও ন-য়?’’ কুণ্ঠিত জিজ্ঞাসু তা স্বীকার করতেই ধমক, ‘‘তোর লজ্জা করে না মুখ দেখাতে? চণ্ডীদাস দেখিসনি এখনও পর্যন্ত!’’ নিজেকে সংবরণ না করতে পেরে মাথা ঘুরিয়ে তাকান বুদ্ধদেব। তাতে সরব যুবকটি বলে ওঠে: ‘‘দ্যাখ দ্যাখ, এই ভদ্রলোকও অবাক হয়ে তোকে দেখছেন। চণ্ডীদাস দেখেনি, এমন আর-একটা লোক বার কর তো কলকাতা শহরে।’’

নিউ থিয়েটার্স-এর ‘চণ্ডীদাস’ ১৯৩২-এ মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু দেবকীকুমার বসু পরিচালিত এই কিংবদন্তি ছবিটি দেখেননি বুদ্ধদেব। একটি লেখায় কবুল করেছিলেন, ‘‘দেখিনি যে, সেটা যদি আশ্চর্যের হয়, তার চেয়েও আশ্চর্যের এই যে, দেখার ইচ্ছেও কখনও হয়নি।’’ সে-সময়ের বাংলা ছবির ব্যাপারে বড়ই কঠোর ছিলেন তিনি, লিখছেন, ‘‘যার মন বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছে সে ও-থেকে নিছক ক্লান্তি আর বিরক্তি ছাড়া কিছুই পেতে পারে না। তবে পৃথিবীর বেশির ভাগ লোক ঐতিহাসিক হিসেবে বড়ো হয়ে উঠলেও তাদের মনের নাবালকত্ব কখনও ঘোচে না— এই যা।’’ তাঁর খেদ: ‘‘জাগ্রতবুদ্ধি লোকের জন্য ফিল্ম যে তৈরি হতে না পারে তা নয়— হয়েও থাকে। কিন্তু তার সংখ্যা এত— ওঃ, এত কম!’’ সেই সংখ্যালঘু শিল্পিত ছবির উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন চ্যাপলিনের ‘গোল্ড রাশ’-এর কথা।

এ বছরটি বাংলা ছবির শতবর্ষ বলে উদ্‌যাপিত হচ্ছে। যতই ‘ইতিহাসমুখী’ হওয়ার চেষ্টা করি না কেন, অনেকেই বাংলা ছবির সেই প্রথম যুগকে শিল্প-ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত বলে মানতেই চান না। সেই বিচারে, সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’-ই ফিল্মের শিল্পরূপের সূচনা করেছিল এ-দেশে। দিনক্ষণের নিক্তিতে নয়, সিনেমাকে চিনতে হবে কলাকৃতির নিহিত সাবালকত্বে, শিল্পীর আধুনিক বোধ ও মননে, দেশকালের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার হাত-মেলানোয়।

সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব— যাঁর ‘সিনেমা/ ছায়ার মায়ার বিচিত্র রহস্য’ বইখানি সত্যজিৎ নিজের সংগ্রহে রেখেছিলেন যত্ন করে— প্রায় শিক্ষকের মতো তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, বাংলা ফিল্মকে সাবালক হতে হলে আন্তর্জাতিক শিল্পসম্মত সিনেমার গুণগুলি স্পঞ্জের মতো শুষে নিতে হবে। উল্লেখ করছেন মার্কিন চলচ্চিত্রকার গ্রিফিথের কথা, জার্মান ছবি ‘দ্য ক্যাবিনেট অব ডক্টর ক্যালিগরি’, আইজ়েনস্টাইনের সোভিয়েট ফিল্ম ‘দ্য ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’... গত ত্রিশের দশকে যখন তিনি লিখছেন, তখন প্রতিভাবান বাঙালি কলাকুশলীরা বাংলা ছবির প্রযুক্তিগত উন্নতি করছেন ক্রমাগত। কিন্তু শৈল্পিক উৎকর্ষ? নরেন্দ্র দেবের মন্তব্য, সে সব বাংলা ছবি ‘‘গল্প ও নাটকের এমন কোনো রূপান্তর ঘটাতে পারেনি আজও, যাকে ফিল্ম-শিল্পের দিক থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও নিজস্ব বলা যায়।’’

বাংলা ফিল্মে শিল্পভাষার এই অভাববোধ থেকেই সত্যজিৎ রায় আর তাঁর সমসাময়িকেরা আন্তর্জাতিক শিল্পভাবনায় লগ্ন হয়েছিলেন চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে। ঠিক ষাট বছর আগে, ১৯৫৯ সালে ঋত্বিকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিতে হরিদাস নিজের ঝোলা আর লম্বা দাড়িটা বাড়ি-থেকে-পালানো কাঞ্চনকে দিয়ে বলেছিল, ‘‘তুমি এগুলো প’রে অনেক নতুন দেশ খুঁজতে বেরুবে...।’’ নতুন দেশ, নতুন ধরনের সিনেমার খোঁজেই তো বেরিয়েছিলেন ঋত্বিককুমার ঘটক। তাঁর কাছে ঐতিহাসিক ঘটনা ছিল কলকাতার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। সোভিয়েট রাশিয়া, ইটালি, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি দেশের ছবি দেখে প্রথমে রেগে গিয়ে বলছেন, ‘‘এ-সব দেশের ছবি কোনও দিনই আমাদের দেখানো হত না-ই বলা চলে।... প্রথম দেখার সুযোগ পেলাম, বুঝলাম— কত বড় মিথ্যের ধোঁকা দিয়ে আমাদের রাখা হয়েছিল।’’ মনটা শান্ত হতেই আত্মপ্রত্যয়, ‘‘আঙ্গিকের উপর পরিপূর্ণ দখল নিতেই হবে। তার জন্যে সমস্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্যকে অনুসরণ করতে হবে।’’

আন্তর্জাতিকতার অভিঘাত বাংলা ফিল্মের শিল্পভাষায় যেমন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন মূল্যবোধ নিয়ে এল, তেমনই এক ভারতীয়তার জন্ম দিল বাঙালি পরিচালকদের ভিতরে। এ সব কথা প্রায় গানের ধুয়োর মতো বলেছেন, লিখে গিয়েছেন ঋত্বিক। তাঁর অকালমৃত্যুর (১৯৭৬) পরে স্মরণসভায় সত্যজিৎ বলেন, ‘‘ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল।’’ অথচ ঋত্বিক বা সত্যজিতের চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠার পিছনে প্রেরণা যে মানুষগুলি, তাঁরা যে কেউই বাঙালি নন, এক জন রুশ, অন্য জন ফরাসি, তা স্বীকার করতে এতটুকু দ্বিধা করেননি ঋত্বিক। বলেছেন, ‘‘রেনোয়াই তাঁর (সত্যজিতের) গুরু। তিনি নিজেও এটা স্বীকার করেন।... আমি সম্পূর্ণরূপে আইজ়েনস্টাইনের বই পড়ে influenced হয়ে ছবিতে আসি।’’

সম্প্রতি প্রয়াত মৃণাল সেনের আজ জন্মদিন। জাতীয় হয়েও ছবিকে যাবতীয় সীমা পেরিয়ে হয়ে উঠতে হবে আন্তর্জাতিক, বলতেন তিনি। ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ (ছবিতে একটি দৃশ্য) নিয়ে দেশ জুড়ে হইচই। হিন্দি ছবি, কিন্তু বাঙালি দর্শকের মনে হয়েছিল ছবিটির সর্বাঙ্গে বাঙালিয়ানা। লেখক বনফুল থেকে মূল অভিনেতা উৎপল দত্ত হয়ে পরিচালক পর্যন্ত বাঙালি। অনেকেই মৃণাল সেনকে বলেছিলেন, ভুবন সোম হিন্দি ছবি হয়েও মেজাজে বাঙালি। মৃণালবাবু বলেছিলেন, ‘‘আমার চিন্তায় ভাবনায়, আমার সমস্ত মানসিকতায় বাংলার জলহাওয়ার ঝাপট লাগছে সর্বক্ষণ। আমি বলব, ঠিকই। কিন্তু তার সঙ্গে এও বলব... কোনও আঞ্চলিক জলহাওয়া আজ আর ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আটকে থাকতে পারছে না, তা ছড়িয়ে পড়ছে সীমার বাইরে, সমস্ত দেশে, দেশের বাইরেও। এবং বাইরের জলহাওয়াও এসে পড়েছে এখানে সেখানে, বাংলাতেও।... অর্থাৎ বাঙালি থেকেও আমি ভারতীয় এবং ব্যাপকতর অর্থে আন্তর্জাতিক। আমি, আপনি, সবাই। বিশেষ করে শিল্পের ক্ষেত্রে।’’

শতবর্ষে বাংলা চলচ্চিত্রের আলোচনায় আন্তর্জাতিকতার চর্চা যেন বাদ না পড়ে যায়, তা একটু বিশেষ করেই নজর করা চাই।

অন্য বিষয়গুলি:

Cinema Satyajit Ray Mrinal Sen Bengali Cinema
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy