ছবি: সংগৃহীত
ব্রেক্সিট-ব্যস্ত ব্রিটেন চলেছে ভোটে। ভোটে যা-ই হোক, ব্রিটিশ জনজীবনে আসছে কিছু আমূল পরিবর্তন— যা হয়তো আগামী দিনের ব্রিটিশ রাজনীতি, ভাবনা ও জীবনকে রীতিমতো পাল্টে দেবে। যখন ব্রেক্সিট বাসি স্মৃতি হয়ে যাবে, আজকের বিতর্ক পুরনো পাব-রসিকতায় পরিণত হবে, তখন এই পরিবর্তনটাই হয়তো হবে নতুন ইতিহাস, নতুন তাত্ত্বিকের তত্ত্ব ও গবেষণার কাঁচামাল।
এমনই এক পরিবর্তন হল মহিলা সাংসদদের ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর হিড়িক। আঠারো জন মহিলা সাংসদ ঘোষণা করেছেন যে তাঁরা এই বার ভোটে দাঁড়াবেন না। বলেছেন, তাঁদের অনীহার মূল কারণ অনলাইন হুমকি আর হয়রানি। যে মহিলারা তবুও ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ভীত, সন্ধ্যাবেলা বাড়ি-বাড়ি ভোট-প্রচারে যেতে দ্বিধান্বিত। সাংসদ জো কক্সের হত্যাকাণ্ড আজও তাজা স্মৃতি।
ভোটের উত্তেজনায় এমন একটা হাওয়া অনেক সময় নজর এড়িয়ে যেতে পারে। বিশেষত যখন এ বারের ভোটে বহু সাংসদ, পুরুষ ও মহিলাই নানা কারণে সরে দাঁড়াচ্ছেন। আসলে ব্রিটিশ রাজনীতির মানচিত্র বদলে দিয়েছে ব্রেক্সিট। পুরনো দলীয় আনুগত্য এখন নড়বড়ে। যে মহিলা সাংসদরা সরে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই এখন দলহীন। তাই, ব্রেক্সিট-ঝড়ের মাঝে এই সব নেহাত ছোট মাপের বিষয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু মহিলা সাংসদদের নির্বিচারে আক্রমণ করা, যৌন হয়রানির হুমকি দেওয়া এবং দলীয় নেতাদের এ সব সহ্য/উপেক্ষা করে নেওয়াটা আসলে ইঙ্গিত করছে ব্রিটিশ সমাজের একটা মূলগত পরিবর্তনের দিকে। হয়তো মেয়েদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে আসছে ভাটার টান— কে জানে, সদ্য-বিগত টেরেসা মে’র প্রধানমন্ত্রিত্ব হয়তো ছিল ও-দেশের নারী-রাজনীতির শেষ তুঙ্গ-মুহূর্ত।
অবশ্যই কিছু পুরুষ সাংসদ এই সব দেখে বলছেন, ‘বাড়াবাড়ি’। বরিস জনসন বলেছেন, এঁরা ‘হামবাগ’! বহু অনুযোগেও জেরেমি করবিন এই ব্যাপারে মুখ খোলেননি। অনেকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে পুরুষ সাংসদদেরও হয়রানির শিকার হতে হয়, এটা রাজনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আসল কথা, সব ধরনের হয়রানিকে সমান করে দেখার প্রবণতাই কিন্তু মহিলা-হয়রানির ইন্ধন জোগায়। লিঙ্গবিদ্বেষ না দেখতে পাওয়াটাই এই সব লিঙ্গভিত্তিক অসভ্যতার শক্তি। অথচ যখন মহিলা সাংসদদের আক্রমণ করা হয়, তা কিন্তু লিঙ্গ-নির্ধারিত— তার একটা বিশেষ চরিত্র অনস্বীকার্য।
আজকের রাজনীতিতে এই ধরনের হয়রানি একটা যুদ্ধকৌশল। এক সময়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ভাবা হত সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা প্রকাশ। অধিকাংশ লোককে সঙ্গে নিয়ে চলাটাই ছিল দস্তুর। তখন কয়েকটি সংবাদপত্র, কয়েকটি টিভি চ্যানেল সবাইয়ের কাছে পৌঁছত, মতামতের লড়াইটা সবার সামনে খোলাখুলি করতে হত। কিন্তু আজ স্যাটেলাইট টেলিভিশনের হাজার চ্যানেল, কোটি কোটি ওয়েবসাইটের প্রতিযোগিতায় মতামতের বাজার ভেঙে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গিয়েছে। জনসত্তা ভেঙে গিয়েছে নানা ‘সেগমেন্ট’-এ। সব রাজনীতিই এখন ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি। এই বাজারে সবাইকে নিয়ে চলার রাজনীতি আর গণতান্ত্রিক কৌশল বলে গণ্য হয় না। তা দিয়ে ভোটে জেতাও যায় না।
আর এর ফলেই এখন মহিলাদের প্রতি হুমকি-হয়রানির রাজনীতি অনেক আলাদা ভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। এই গোত্রের অসভ্যতাকে এখন শহরে প্রগতিবাদের বিরুদ্ধে রাগ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়, তা দিয়ে রাজনৈতিক জনভিত্তি (base)-কে উত্তেজিত করা যায়। একসঙ্গে সুশীল সমাজে, আন্তর্জাতিক স্তরে আর মহিলা ভোটারের সামনে এগুলো ব্যাখ্যা করা যায় ‘অভদ্রলোক’-এর অসহিষ্ণুতা বলে। এর বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁদের বিভাজনের রাজনীতি করতে বারণ করা যায়। বলা যায়, সংখ্যাগুরু কখনও ভোটব্যাঙ্ক হয় না, পুরুষতন্ত্র কোনও বিভাজক পরিচয় নয়।
তাই এই আক্রমণের রাজনীতি আসলে কেবলমাত্র অভদ্রোচিত অসহিষ্ণুতার প্রকাশ নয়, বরং এক অত্যন্ত সুচিন্তিত বার্তা প্রেরণ। হাজার হাজার টুইটার-ব্যক্তিত্ব চালিত, তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত একটা অন্য রাজনীতি আছে এর পিছনে, যা সাধারণ ভোটারের বোধগম্য নয়। বিভাজনের কুকুরবাঁশি বাজিয়ে এই রাজনীতি পরিচালনা করা হয়, প্রতিটি পুরুষের মধ্যে পিতৃতন্ত্রকে রোপণ এর প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি হয়ে দাঁড়ায়। কোনও নারী এর বিরুদ্ধে কথা বললে, তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় শহুরেপনার দায়, এমনকি বিভেদপন্থার অভিযোগ।
ব্রিটেন এক বিচিত্র দেশ। এর সাধারণ সৈনিক আর সাধারণ শ্রমিককে দিয়ে বিশ্বজয় করানো হয়েছে, কিন্তু এর খানদানের শক্তি এখনও অটুট রয়ে গিয়েছে। কোনও বিশ্বযুদ্ধ, কোনও বিপ্লব এর পিতৃতন্ত্রকে ছুঁতে পারেনি। আজও রাজকুমার তাই অপলকে বলতে পারেন যৌনশিকারি এপস্টাইনের সঙ্গে তাঁর দ্বিধাহীন বন্ধুত্বের কথা। অথচ এরই মধ্যে গত একশো বছরে সাফ্রাজেট থেকে মি-টু পর্যন্ত শক্তিশালী নারীবাদী আন্দোলনের ধারা পুরুষের সমর্থন জয় করে পিতৃতন্ত্রের কাছ থেকে জিতে নিয়েছে সমান অধিকার। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক-তৃতীয়াংশ সাংসদ আজ মহিলা— এটা ছিল এই জয়েরই নিশানা। সেই জায়গায় আজ ব্রেক্সিট মেঘের আড়ালে, বিভেদপন্থার সুকৌশলে, নিয়ে
এসেছে পিতৃতন্ত্রের প্রতি-বিদ্রোহ। নারী এবং নারীবাদের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ কিন্তু শুধু নারীবাদীদের সঙ্কট নয়। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে, এটা গণতন্ত্রেরও নির্ণয়কাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy