ছবি: সংগৃহীত
একথা সবার জানা, শান্তিনিকেতনে দোলের দিন যে ঋতু-উৎসবটি উদ্যাপিত হয়, তার সঙ্গে দোল বা হোলির ধর্মীয় অনুষঙ্গের কোনও যোগ নেই। এ হল নিতান্তই ঋতু-উৎসব। সবার রঙে রং মিশাবার এক পরম নন্দন-প্রবর্তনাময় উপলক্ষ। দখিনা বাতাসে শান্তিনিকেতনের তরুশাখার ডালপালা সহসা উতলা হলেই সে কালে আশ্রমিকদের মনে গুনগুনিয়ে উঠত ‘বসন্ত’। তার জন্য ফাল্গুনী পূর্ণিমা পর্যন্ত অপেক্ষাও বাহুল্য মনে হত সে কালে। কবির বালকপুত্র শমীন্দ্রনাথ ১৯০৭ সালে খেলাচ্ছলে যে ঋতু-উৎসবের সূচনা করেছিলেন, পাঁজি-পুঁথির হিসেব কষলে দেখা যায়, তা অন্তত দোলের দিন অনুষ্ঠিত হয়নি। তার পর কত বার ভিন্ন ভিন্ন তিথিতে বসন্ত-উদ্যাপন হয়েছে আশ্রমে! বছরের বাঁধা একটা দিনে উৎসবেই তৃপ্ত হত না সে সময়ের আশ্রম। এই যেমন, ১৯২৩ সাল। সে বার মাঘী পূর্ণিমায় শান্তিনিকেতনে বসন্তের গানের আসর বসেছিল; আর ফাল্গুনী পূর্ণিমায় আশ্রম-সম্মিলনীর অধিবেশনে আবারও আয়োজন করা হয়েছিল বসন্ত-বন্দনার। সূত্রান্তরে জানা যাচ্ছে, সে বার শ্রীপঞ্চমীর দিনও আম্রকুঞ্জের সভায় বসেছিল ‘ফাল্গুনী’র গানের আসর।
এই ১৯২৩ সালের আগে রীতিমতো আসরবাঁধা বসন্ত-উদ্যাপনের খবর তেমন পাওয়া যায় না। আজকের ‘বসন্তোৎসব’ সে হিসেবে বিশ্বভারতী পর্বেরই পার্বণ। নন্দিনী-বিনা আনন্দ-উৎসব অসম্পূর্ণ বলেই কি রীতিমতো উৎসব হয়ে উঠতে বিশ্বভারতী পর্বের নারীভবন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত অপেক্ষা ছিল বসন্তোৎসবের? তার আগে অবশ্য আশ্রমে পরিক্রমণশীল এক রকম বসন্ত-উদ্যাপন ছিল। প্রাক্তনী প্রমথনাথ বিশীর ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ স্মৃতি-আলেখ্যে, উৎসবরাজ দিনু ঠাকুরের নেতৃত্বে খোল-করতাল সহযোগে বসন্তের গান গাইতে গাইতে আশ্রম-পরিক্রমার উল্লেখ পাওয়া যায়। আশ্রমিকদের বাড়িতে বাড়িতে তখন আম্রপল্লবের পত্রলেখায় পৌঁছে যেত বসন্তের আমন্ত্রণলিপি। এই আমন্ত্রণ-প্রকরণের মধ্যেও ছিল একটা স্নিগ্ধ আন্তরিকতার স্পর্শ।
সে কালে এই উৎসব রচিত হত আশ্রমিকদেরই রুচিসামর্থ্যে। আশ্রমগুরু স্বয়ং সব সময় উৎসব রচনা করে দিতেন, তা নয়। বসন্ত-উৎসব ঠিক রবীন্দ্রনাথের একক ‘রচনা’ নয়। বলা যায়, তাঁর রুচিনির্মাণ-প্রকল্পের সারাৎসার আত্মস্থ করে আশ্রমিকেরাই রচনা করতেন উৎসবের। আসর শেষে আশ্রমিকেরাই যেতেন তাঁদের গুরুদেবের পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করতে। শান্তিদেব ঘোষ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ১৯৩১ সালের এমনই এক আসরে বসন্তের গানের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত নেচে ওঠেন তিনি; এবং কলাভবনের ছাত্র বনবিহারী ঘোষ। তাঁদের সেই নাচের সুখ্যাতি গিয়ে পৌঁছয় রবীন্দ্রনাথের কানে। এর কয়েক বছর পর থেকেই আম্রকুঞ্জের সকালের অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ শুরু হয় আশ্রমগুরুর। আর সেই সময় থেকেই, শান্তিদেব ঘোষের বয়ান অনুযায়ী; শান্তিনিকেতনের ‘দোলের উৎসব’ মাত্রান্তরিত হয়ে ফুটে ওঠে নন্দিত ‘বসন্তোৎসব’ হিসেবে! দোলের উৎসবকে নান্দনিক করে গড়ে তোলার প্রয়োজন উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ওই সাক্ষাৎকারেই শান্তিদেব বলেছিলেন, “আগের দোল-উৎসব যেটা হত, সেটাকে গুরুদেব আর বেশি উৎসাহ দিলেন না কারণ ওই সময় নানা রকম নোংরামি হত। নোংরামি মানে কী— কাদা দিয়ে দিল, ছেলেরা দুষ্টুমি করে কালি দিয়ে দিল— এ রকম এলোমেলো ভাব। উনি (রবীন্দ্রনাথ) ভাবলেন, এটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে বেঁধে দিতে হবে। উনি সকালে ‘বসন্তোৎসব’ বলে একটা বিধিবদ্ধ উৎসব করা ঠিক করলেন। তখন থেকেই আরম্ভ হল সকালবেলার অনুষ্ঠান— তাতে গান হবে, কিছু নাচ হবে— ছেলেমেয়েরা নাচবে, গুরুদেব আবৃত্তি করবেন। তখন থেকেই ‘ওরে গৃহবাসী’ গানটার সঙ্গে নানা রকম অর্ঘ্য নিয়ে মেয়েরা আসত।”
১৯৩৪ সাল থেকে ‘নবীন’ নাটকের জন্য লেখা ওই গানের সঙ্গে শোভাযাত্রায় জুড়ে গেল নাচ। সেই নাচের সংযুক্তি ছিল শান্তিদেবেরই পরিকল্পিত। ‘বেশি কমপ্লিকেটেড নয়, মণিপুরী একটা সিম্পল স্টেপ— ব্যস, এই শুরু হয়ে গেল নতুন একটা দিক।’ শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুও হাত লাগালেন সেই নন্দন-আয়োজনে। তালপাতা দিয়ে তিনি বানিয়ে দিতে থাকলেন শোভাযাত্রিকদের হাতের ডালি। তার কোনওটিতে থাকত ফুল, কোনওটিতে আবির। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যত বাড়তে থাকল, নাচের দলেও এল নানা বৈচিত্র। যুক্ত হল কাঠির নাচ, মন্দিরার নাচ, হাতের তালির নাচ। যে উৎস থেকেই বেয়ে আসুক সে-সব নাচের ধারা; শেষ বিচারে তার উপর চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে রইল শান্তিনিকেতনের নান্দনিক রুচির নিজস্ব স্বাক্ষর।
সে একটা সময় ছিল, যখন উৎসবের নামে রুচির সামান্য স্খলনেও পীড়িত বোধ করত আশ্রম। তরুণ পঞ্চানন মণ্ডল তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ১৯৩৮ সালের উৎসবের দিন বৈতালিকের সময় ছাত্রাবাসের ছাদের উপর কিছু ছাত্র ‘অসংযত আমোদে হৈ হৈ’ করতে থাকে। এই সামান্য ‘হৈ হৈ’ গভীর মনঃপীড়ার কারণ হয় ওই তরুণ আশ্রম-শিক্ষার্থীর। কারণ আশ্রমের এক রকম উপলব্ধি ছিল, তাঁদের গুরুদেবের অভিধানে ‘উন্মাদনা’ শব্দটির কোনও স্থান নেই। রবীন্দ্রনাথের বসন্ত-ভাবনায় উল্লাস-উন্মাদনা নেই, আছে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সংযম-সুন্দর আকুলতা। জগতের দিকে ব্যাকুল ভাবে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গির সঙ্গে, জগতকে সবটুকু আপন করে না পাওয়ার সূক্ষ্ম একটা বেদনাবোধও জড়িয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের বসন্ত-ভাবনায়! ‘নিবিড় অন্তরতর বসন্ত এল প্রাণে’-র মতো গানের চাবি দিয়ে খুলতে হয় রবীন্দ্রনাথের বসন্তের ওই আর এক অনুভববেদ্য অন্তর্প্রদেশ। এ জন্যই কবির প্রয়াণোত্তরপর্বে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন এক বার বলেছিলেন, কবি নিতান্ত আমোদ-প্রমোদের জন্য এই উৎসবের সূচনা করেননি। ‘‘এই উৎসব যা মিথ্যা ও কুৎসিত তার উপরে সত্য ও সুন্দরের জয়ের প্রতীক।’’
রবীন্দ্রনাথ বা ক্ষিতিমোহনের কথা স্মরণে রাখেনি বাঙালি অত্যুৎসাহী জনতার গরিষ্ঠ ভাগ! সেই জনপিণ্ডের অশোভন সংক্রাম থেকে রক্ষা করতে ১৯৮২ সালে ‘বসন্তোৎসব’ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তৎকালীন উপাচার্য অম্লান দত্ত। ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’ এবং ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র প্রতিবেদনসূত্রে অবশ্য জানা যাচ্ছে, সে বছরও নিয়মরক্ষার বসন্তোৎসব পালিত হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। তার পর বছরের পর বছরের উন্মত্ত ব্যাধের তাড়া খাওয়া ত্রস্ত হরিণীর মতো এক মাঠ থেকে আর এক মাঠে ছুটে চলেছে শান্তিনিকেতনের ‘বসন্তোৎসব’!
কিন্তু আমরা ভুলি কী করে, এই উৎসবের মধ্যে রয়ে গেছে বিভেদ-ক্ষতর অনুপম এক বিশল্যকরণী। বহিরঙ্গে নয়, মর্মকে অনুরঞ্জিত করা এই বসন্তোৎসবে ‘ভুলিয়ো আপন পর ভুলিয়ো’ উচ্চারণের এমন শিল্পিত উত্তরাধিকার ক’টা জাতির ভাগ্যে জোটে; মানবতার দারুণতর দুঃসময়ে?
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী। মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy