উল্লাস: উপনির্বাচনে দলের প্রার্থী জয়ী হওয়ার পর নদিয়ার করিমপুরে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকদের জমায়েত। পিটিআই
পুজোর পরে এক দিন দিল্লির বিমানে মুকুল রায়ের সঙ্গে দেখা। পাশাপাশি আসন। গল্পে গল্পে খানিক সময় কাটল। প্রসঙ্গ নানা রকম। ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সব বলা শিষ্টাচার নয়। তবে রাজনীতি বিষয়ক কিছু কথাবার্তা জানানো যেতে পারে। বিশেষত এখন, বিধানসভার তিন কেন্দ্রে উপনির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের পরে তা হয়তো প্রাসঙ্গিক।
তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে মুকুল সেখানে কত দূর গুরুত্ব পাচ্ছেন, দলের উপরতলায় তাঁর কতটা নির্ভরযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, নিচুতলাতেই বা তিনি কতটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পেরেছেন— এ নিয়ে বিজেপি-মহলে মতভেদ আছে। কিছু লোক যেমন দাবি করেন, রাজ্য রাজনীতির নিরিখে তিনি দিল্লিতে বিজেপি শীর্ষনেতাদের কাছে অপরিহার্য। তাঁকে বাদ দিয়ে এই রাজ্যে নির্বাচনী কৌশল তৈরি করা কঠিন। অনেকের ধারণা আবার ঠিক বিপরীত। তাঁদের বক্তব্য, মুকুল সম্পর্কে যতটা বেলুন ফোলানো হয়েছিল, বিজেপিতে এসে তা বেশ চুপসে গিয়েছে। রাজ্যস্তরে তাঁর তেমন ভূমিকাও নেই।
এই ভেদবিচার স্বাভাবিক। তবে সে দিন মুকুল বলছিলেন, সকালে দিল্লি থেকে ফিরেই আবার বিকেলে তাঁকে যেতে হচ্ছে। জরুরি তলব এসেছে দলের শীর্ষস্তর থেকে। বিমানবন্দর থেকেই সোজা বৈঠকে যেতে হবে তাঁকে। সর্বভারতীয় দলের নেতা হিসেবে এমন ডেলি-প্যাসেঞ্জারি গুরুত্বের বইকি!
জানতে চেয়েছিলাম, তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কী হবে? মুকুল রায় অর্থবহ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, “নির্বাচন কমিশনের কড়া নজর থাকবে। কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে। ওরা (তৃণমূল) যা খুশি করতে পারবে না।” ফলে খড়্গপুর, কালিয়াগঞ্জ তো বটেই, করিমপুরেও বিজেপির ‘চমক’ দেখা যেতে পারে বলে দাবি ছিল আজকের রাজ্য রাজনীতিতে অন্যতম ভোট-পারদর্শী বলে ‘খ্যাত’ মুকুলের।
কথা প্রসঙ্গে সে দিন তিনি আরও জানিয়েছিলেন, তৃণমূলে বড় ভাঙন আসন্ন। সেটা কেমন? তাঁর জবাব ছিল, “এমন এমন নেতা বেরিয়ে আসবেন, ভাবা যাবে না! শুধু সময়ের অপেক্ষা।” অনিবার্য ভাবেই উঠেছিল ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের বিষয়। সে সম্পর্কে কী বক্তব্য ছিল মুকুলের, তা পরে বলব।
আগে তিন উপনির্বাচনের দিকে তাকানো যাক। এটা স্বীকৃত যে, এই ফল তৃণমূল এবং বিজেপি উভয়ের কাছেই অপ্রত্যাশিত। লোকসভা ভোটে বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে থাকা দু’টি বিধানসভা আসনে ছ’মাসের মধ্যে পর্যুদস্ত হওয়ার কথা বিজেপি ভাবতেও পারেনি। তৃণমূলও ভাবেনি, তাদের হাতে থাকা একমাত্র করিমপুর ছাড়া বাকি দু’টিও তারা জিতে নেবে। তারা ভেবেছিল, খড়্গপুরে লড়াই যদিও বা কিছুটা হাড্ডাহাড্ডি হয়, কালিয়াগঞ্জে বড় জোর ব্যবধান কমবে। করিমপুরের ব্যবধান গত লোকসভা ও ২০১৬-র বিধানসভাকে ছাড়াল। খড়্গপুরেও বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের লোকসভায় এগিয়ে থাকার ব্যবধান পেরিয়ে জয় পেল তৃণমূল। আর কালিয়াগঞ্জে লোকসভার ভোটে ৫৭ হাজার পিছিয়ে থাকা তৃণমূল সেই ফাঁক ভরিয়ে জিতল প্রায় আড়াই হাজারে। অর্থাৎ প্রায় ৬০ হাজার ভোট বাড়াল তারা।
বলতেই হবে, পরিস্থিতি এতটা ‘গম্ভীর’, সেই আঁচ বিজেপির ভোটে দক্ষ তাবড় নেতারা বুঝতেই পারেননি। ঠিক যেমন, লোকসভায় ১৮টি আসন হারানোর আগাম হিসেব কষতে ব্যর্থ হয়েছিল তৃণমূল। বিজেপি কিছু বেশি আসন পেতে পারে ধরে নিলেও অত বড় ধাক্কা আসতে চলেছে বলে তারা টের পায়নি। কিন্তু এ সব তো মামুলি। ঝুলির আসল বিড়াল বেরোচ্ছে এই বার!
লোকসভার পরে পর্যালোচনায় বসে তৃণমূল নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছিলেন, শিকড়ে পোকা ধরছে। নিচুতলায় ক্ষয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। নেতা-কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ঔদ্ধত্য, অসততা, দলের অন্দরে ও বাইরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মতো জনবিরোধী ব্যাধিতে আক্রান্ত। একই কথা শোনা গিয়েছিল সাধারণ মানুষের মুখেও।
ক্ষমতায় কিছু দিন থাকার পরে এ সব লক্ষণ দেখা যায়। সিপিএম আমলেও হয়েছিল। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি ব্যতিক্রম নয়। উদ্ধত অসৌজন্য থেকে শুরু করে আর্থিক ও নৈতিক অপরাধ সংক্রান্ত বিবিধ অভিযোগের তির তাদের দিকেও।
কিন্তু এখানকার বিজেপি দেখা যাচ্ছে, সবাইকে টেক্কা দিল! ক্ষমতায় বসা দূরস্থান, মাত্র ছ’মাস আগে রাজ্যে লোকসভার ১৮টি আসন জিতেছে তারা। আর তার পরেই এই উপনির্বাচনে হার নিয়ে চর্চায় দলের অন্দরেই শোনা যাচ্ছে ঔদ্ধত্য, আত্মম্ভরিতা, যোগ্যদের দূরে সরিয়ে দেওয়া, গোষ্ঠীবাজির মতো নানা সমালোচনা। পরিচিত নেতারাই বলছেন এ সব। তাঁদের বিভিন্ন মন্তব্যে ভরে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। এর কিয়দংশ সত্যি হলেও তা গুরুতর।
উপনির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের পিছনে সবচেয়ে আগে যে কারণটি ধরে নেওয়া হচ্ছে, তা হল এনআরসি চালু করে যে কাউকে অ-ভারতীয় বলে দাগিয়ে দেওয়ার ভয়। অসমে ১২ লক্ষ হিন্দু-সহ ১৯ লক্ষের নাম বাদ পড়ায় ভয় আরও বেড়েছে। এর একটা ‘সুফল’ তৃণমূল অবশ্যই পেয়েছে। তবে এটাকেই মূল কারণ বলে মানলে লোকসভায় তৃণমূলের ধাক্কার পিছনে শুধুই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভোট ছিল বলে স্বীকার করে নিতে হয়।
কিন্তু বাস্তব তা বলে না। কারণ ওই ভোটের পরে বিভিন্ন অনুসন্ধান থেকে এটা পরিষ্কার, তৃণমূলের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লোকসভার রায়কে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। মানুষ নানা স্তরে তৃণমূলের বিভিন্ন অপকর্ম মেনে নেননি। যদিও দ্রুত ফাটল মেরামতিতে নেমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই অবস্থা ইতিমধ্যে বেশ খানিকটা সামলেছেন। ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোরকে ডেকে আনা যদি সেই প্রক্রিয়ার একটি অঙ্গ হয়, তা হলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল কৃতিত্ব মমতার উপরেই বর্তায়।
এখন তিন উপনির্বাচনে হারের পরে বিজেপির অন্দরমহলে যে কথা উঠছে, তা থেকে তাদের বিরুদ্ধেও সাধারণ মানুষের বিরূপতার ছবিই ফুটে ওঠে। ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় দৌড় শুরু করা এই দলের ঔদ্ধত্য, অহং, আত্মসন্তুষ্টির মনোভাব মানুষের নজর এড়াচ্ছে না। তার মাসুল যে ভাবে দিতে হয়, তিন কেন্দ্রের রায়ে তার কিছুটা প্রতিফলন ঘটেছে। ক্ষমতায় আসার আগেই কোনও দল সম্পর্কে জনমনে এমন নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি হলে তার পরিণাম দীর্ঘমেয়াদি হওয়া অসম্ভব নয়। শুধু দলে দলে কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে, আর পুলিশ-প্রশাসনের অফিসারদের সরিয়ে দিয়ে এটা আটকানো যায় না। কোনও ভারী তত্ত্বের মোড়কেও লোকের ধারণা বদলে দেওয়া শক্ত।
সে দিন বিমানে ২০২১-এর ভোট প্রসঙ্গে মুকুল রায় অবশ্য বলেছিলেন, বিধানসভা নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে থেকে তাঁদের ‘আসল দৌড়’ শুরু হবে। নির্বাচন কমিশনকেও তখন ‘সক্রিয়’ ভূমিকায় দেখা যাবে। জয়ের সম্ভাবনা? মুকুলের উত্তর, “একশো ভাগ। আমি রাজ্যটাকে হাতের তালুর মতো চিনি। তৃণমূলকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।”
তখনও উপনির্বাচনের ভবিতব্য জানা ছিল না। ফল বেরোনোর পর মুকুল বলেছেন, “ভোটের আগে সবাই বলে সব আসনে জিতব। ওটা কথার কথা। না মিলতেই পারে!” আর তৃণমূল ভাঙিয়ে ‘চমক’ দেখানো? এই বাজারে তা-ও কি খুব সোজা খেলা!
পুনশ্চ: বেচারা দিলীপ ঘোষ! মুকুল রায়ের মতো ‘ভোট-অভিজ্ঞ’ নন। হয়তো তাই বলে ফেলেছেন, “অভিজ্ঞতা কম বলে জয় ধরে রাখতে পারি না!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy