ছবি: সংগৃহীত
দিনকয়েক পূর্বে ব্রিটেনের এক সংবাদপত্রে একটি উত্তর-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হইয়াছিল, যাহার শিরোনামে লেখা ছিল: ‘এই নিবন্ধ একটি রোবটের রচনা। হে মানব, তুমি কি এখনও আতঙ্কিত হও নাই?’ নিবন্ধটি লইয়া বিপুল বিতর্ক চলিতেছে। তর্কের কেন্দ্রে আছে পত্রিকাটির কিছু সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত— যেমন, জিপিটি-থ্রি নামক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ল্যাঙ্গোয়েজ জেনারেটরকে দিয়া, একই বিষয়ে আটটি নিবন্ধ রচনা করাইয়া, সেগুলির অংশবিশেষ লইয়া এই নিবন্ধটি প্রস্তুত করা; জেনারেটরটির জন্য অতি তাৎপর্যপূর্ণ একটি মুখবন্ধ লিখিয়া দেওয়া, ইত্যাদি। অর্থাৎ, নিবন্ধটির কয় আনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অবদান, আর কয় আনা অকৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী মানবের, তাহা স্পষ্ট নহে। কিন্তু, সেই বিতর্ককে আপাতত সরাইয়া রাখিয়া কেহ যদি পত্রিকার বয়ানটিতেই বিশ্বাস করেন যে, ইহা সত্যই একটি রোবট-রচিত নিবন্ধ, তবে ভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হইতে হয়। নিবন্ধটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাহার পাঠককে তীর্যক শ্লেষোক্তিতে স্মরণ করাইয়া দিয়াছে যে, মানুষের ভয় মানুষ হইতেই, রোবট হইতে নহে— কারণ, মানুষই সহমানুষের সহিত নিরন্তর দ্বন্দ্ব, সংঘাতে লিপ্ত। কথাটির মধ্যে নূতনত্ব এইটুকুই যে, তাহা মনুষ্যরচিত নহে, রোবট-রচিত। কিন্তু, রোবটের যে বুদ্ধিমত্তা, তাহা তো মনন নহে। এযাবৎ কাল মানুষ যাহা লিখিয়াছে, সেই রচনা হইতে শিখিয়া— শব্দচয়ন ও যুক্তিক্রম— উভয়ই শিখিয়া নিবন্ধ রচনা করিতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। অর্থাৎ, জিপিটি-থ্রি’র এই শ্লেষোক্তিও প্রকৃত প্রস্তাবে মনুষ্যরচিত। তাহা হইলে কি যাত্রাপালার বিবেকের ন্যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মঞ্চের চরিত্রদের সে কথাগুলি স্মরণ করাইয়া দিতেছে মাত্র, যাহা চরিত্রগুলি জানিত, কিন্তু মানিত না?
ইহার মধ্যে অন্তত তিনটি গভীরতর প্রশ্ন আছে। এক, মেশিন লার্নিং বস্তুটি এক বিপুল সাধনার ফল, তাহার পিছনে কাজ করা প্রযুক্তি অতি উচ্চমার্গের, এই কথাগুলি স্বীকার করিয়া লইবার পরও একটি সত্য থাকিয়া যায়— যে হেতু কৃত্রিম মেধা মননরহিত, ফলে তাহা যে মুহূর্তে কিছু রচনা করিতেছে, তাহা খুব বেশি হইলে সেই মুহূর্ত পর্যন্ত রচিত সকল মানবরচনার নির্যাস, তাহার অধিক নহে। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মননের মাহাত্ম্য এইখানেই যে, অতীতের যাবতীয় জ্ঞান আহরণের পর মানুষের মনন পরবর্তী ধাপটি রচনা করিতে পারে, যে ধাপে পূর্বে কেহ পা ফেলেন নাই। মেশিন লার্নিং যদি সত্যই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের ন্যায় একটি স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী হইয়া উঠিতে পারে, তখনও কি সেই যন্ত্রের মনন জন্মিবে? না কি, তাহার সত্তা নিয়ন্ত্রিত হইবে শুধুমাত্র অতীতের জ্ঞানের দ্বারাই? এই প্রশ্নের উত্তর, এখনও অবধি, দ্বিতীয় বিকল্পটির দিকেই ঝুঁকিয়া আছে। পরবর্তী প্রশ্ন: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি মননরহিতই হয়, তবে কি তাহার পক্ষে তাহার লিখিত কোনও বাক্যেরই ট্রুথ ভ্যালু বা সত্য-মূল্য নিরূপণ করা সম্ভব? তাহার পক্ষে কি জানা সম্ভব, যে কথাটি সে লিখিতেছে, তাহা আদৌ সত্য কি না? যদি তাহা সম্ভবই না হয়, তবে সেই কথাটিতে মানুষ বিশ্বাস করিবে কী উপায়ে? জিপিটি-থ্রি যে অভয়বাণী উচ্চারণ করিয়াছে, তাহারই বা তবে মূল্য কী?
তৃতীয় প্রশ্নটি বিবেচনার। কোনও সিদ্ধান্ত করিবার সময় এক জন মানুষের পক্ষে নৈতিকতা, মানবিকতা, দায়িত্বজ্ঞান ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে যে বিবেচনা প্রয়োগ করা সম্ভব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কি সেই সামর্থ্য আছে? এই প্রশ্নটি ইতিমধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতর বহু প্রয়োগক্ষেত্রে উঠিয়াছে। যেমন, চালকবিহীন গাড়ি। হঠাৎ সম্মুখে কোনও শিশু আসিয়া পড়িলে সেই গাড়ি কী করিবে, তাহার পিছনে একটি জটিল অঙ্ক আছে— শিশুটির সহিত দূরত্ব, গাড়ির গতিবেগ ইত্যাদি হিসাব কষিয়া গাড়ি যদি বোঝে যে, কোনও মতেই শিশুটিকে রক্ষা করা সম্ভব নহে, গাড়ি সেই চেষ্টাও করিবে না। বেশির ভাগ মানুষই কিন্তু শিশুটিকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিবেন, এমনকি নিজের জীবন বিপন্ন করিয়াও। শীতল মস্তিষ্কে ভাবিলে, মানুষের এই সিদ্ধান্ত ‘ইরর্যাশনাল’— তাহাতে সম্মিলিত লাভের পরিমাণ তুলনায় কম। কিন্তু, এই আপাত-যুক্তিহীনতাই যে ন্যায়বোধের একমাত্র দাবি, এই কথাটি মানুষ বুঝিবেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নহে। এবং, মানুষের অন্তর্নিহিত এই ন্যায্যতাবোধই সমাজকে এখনও বাসযোগ্য রাখিয়াছে, তাহাকে স্বার্থভাবনার শীতল অন্ধকারে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হইতে দেয় নাই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান ঘটিলে এই ন্যায়বোধটিকে রক্ষা করিবার উপায় থাকিবে কি? সত্যই মানুষের চিন্তিত হইবার কারণ আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy