প্রথমে তিনি ‘তকরার’ নামে একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখেন পরিচালকের কথায়। সেটি মুক্তি পাওয়ার পরে দেখা গেল সেই চলচিত্রের কাহিনি বা চিত্রনাট্যকার হিসেবে তাঁর নাম নেই। এতে তিনি বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এর পরে তিনি ‘সীমন্তিনী’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখেন। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন তিনি যৌথ ভাবে। পরবর্তী জীবনে তাঁর ‘শেষ নাগ’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত নাটক ‘শেষাগ্নি’ অত্যন্ত সফল ভাবে মঞ্চস্থ হয় স্টার থিয়েটারে। ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে পরিচিতি ও ঘনিষ্টতা হওয়ার পরে তিনি বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দিকপালের সঙ্গে পরিচিত হন।
তিনি ছিলেন কথাসাহিত্যকার। মনেপ্রাণে তিনি বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্করের অনুরাগী। তারাশঙ্করের প্রতি অনুরাগ গড়ে ওঠে পাঁচথুপিতে থাকার সময়েই। সেই সময়ে তিনি অনেক বার লাভপুরে গিয়েছিলেন। লেখক জীবনে অত্যন্ত ঘনিষ্টতা হয় বিভূতিভূষণের সঙ্গে। তাঁর কলকাতার মেসে একাধিকবার বিভূতিভূষণ এসেছেন এবং রাত্রিবাস করেছেন। এই দু’জন বিখ্যাত লেখকের মতোই তিনি অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। তিনি সরকারি চাকরি করতেন ও অবসরে সাহিত্য রচনা করতেন। সন্ধ্যায় কলেজে স্ট্রিটে ঘুরে বেড়াতেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন সে সময়ের বিখ্যাত লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের। তিনি দেখেছেন প্রশান্ত মহলানবীশ, সুনীতিকুমারকে।
পাঁচথুপিতে বাস করার সময়ে কখনও কান্দি থেকে পায়ে হেঁটে, কখনও সাঁইথিয়া থেকে গরু গাড়িতে যাতায়াত করেছেন। পাঁচথুপির চারপাশের গ্রাম, বারকোণা দেউল যেমন তাঁর অন্তরে গভীর রেখাপাত করেছিল, তেমনই এই এলাকার মাঠঘাটকে তিনি আপন বলে মনে করেছিলেন। শেষ জীবনে তিনি প্রায়শই বলতেন ‘আমি বাঁকড়ো’ অর্থাৎ তিনি বাঁকুড়ার লোক। পরেই বলতেন ‘মুর্শিদাবাদের গ্রাম আমার সমস্ত বাল্যকাল জুড়ে আছে’। গত শতকের প্রথম দিকে কান্দিতে ধীরে ধীরে জনবসতি বাড়ছে। এখানে তখন মিউনিসিপ্যালিটি আছে, আদালত আছে, হাসপাতাল আছে, স্কুল আছে। মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছে সদ্য। একজন সুক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন লেখক হিসেবে এই জনপদকে তিনি দেখতে চেয়েছেন। কান্দিকে নিয়ে লিখলেন ‘কাজল গাঁয়ের কাহিনি’ উপন্যাস। তিনি বলেছেন, ‘‘এখানে যেমন দু’দিকে রয়েছে পরম স্নেহময়ী ময়ূরী নদী, তেমনই ক্ষয়িষ্ণু জমিদারদেরর কীর্তিকথা। তাদের কীর্তির আড়ালে আছে অহমিকা আর ভ্রষ্টাচার।’’ এই কাহিনীতে উঠে এসেছে সেই সময়ের বিখ্যাত কবিরাজ কানাই সেনগুপ্তের নাম। তাঁর হাতযশ ও খ্যাতি এই এলাকায় সর্বজনবিদিত। অন্য দিকে সামন্ততন্ত্রের ছত্রচ্ছায়ায় বাস করে জগবন্ধু। এক দিন বেদেরা এসেছিল সাপ খেলাতে। তাদের যুবতী বধূর প্রতি সে আকৃষ্ট হয়। গভীর রাতে ময়ূরী নদীর ওপরে ভাসমান নৌকায় সে চলে যায় বেদের বধূ সরবতিয়ার কাছে। শক্তিপদ সেই রাত্রির রূপের বর্ণনা করেন—‘নদীতীরের শ্যামল বনচ্ছায়া রহস্যময়ী রাত্রির বুকে এলোমেলো দাগ টেনে কী এক মায়াবী রূপের ইসারা গড়েছে—জমাট অন্ধকারের বুকে জ্বলছে জোনাকির টিপ—ঝিঁ ঝিঁর সুর ভেসে ওঠে, মাঝে মাঝে আসে দমকা বাতাস। সমাধীমগ্ন আকাশ বনানীর ঝুঁটি ধরে যেন এক দৈত্য মরণ-ঝাঁকুনি দিচ্ছে’। সেই সময়ে আক্রান্ত হয় সরবতিয়া। কান্দিকে নিয়ে শক্তিপদই প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস রচনা করেছেন। তার আগে তারাশঙ্কর তাঁর ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’তে কান্দি সংলগ্ন হিজল বিলকে প্রেক্ষাপট হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কান্দির কথা সেখানে এসেছে আংশিকভাবে।
শক্তিপদ ভালবাসতেন গভীর অরণ্য। তাই চাকরিসূত্রে কলকাতার মেসে থাকাকালীন তিনি কখনও যেতেন সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রান্তে। যদিও এই এলাকা তাঁর চেনা ছিল। এই সুন্দরবন তাঁর খুব প্রিয় জায়গা ছিল। প্রাণিকুল, গাছগাছালি যেন কোনও এক স্বর্গীয় আভা রচনা করেছে বলে তিনি মনে করতেন। অন্য দিকে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা, যারা যেমন মৎসজীবী, যারা বন থেকে কাঠ কেটে জীবিকা অর্জন করত, যারা বনের মধু সংগ্রহ করত, প্রত্যেকের প্রতি তাঁর ছিল নিবিড় ভালবাসা। এদের জীবনকাহিনী নিয়ে লিখেছিলেন ‘নয়া বসত’, ‘নোনা গাং’, ‘কুমারী মন’, ‘মুক্তিস্নান’ উপন্যাস। নিবিড় অরণ্য ভালবেসে তিনি অবকাশ পেলে যেতেন বিহারের (এখন ঝাড়খণ্ড) জঙ্গলে। সেখানকার বনবাসী মানুষ আর গাছপালা তাকে যেন আত্মীয় ভাবত। ‘শাল পিয়ালের বন’, ‘মায়াদিগন্ত’, ‘বনমাধবী’ প্রভৃতি উপন্যাস এই পরিপ্রেক্ষিতে লেখা। তিনি মাঝে মাঝেই বলতেন— ‘আমি কলকাতায় থাকি, কিন্তু আমি আসলে গাঁইয়া মানুষ’। গাঁয়ের সরল অনাড়ম্বর জীবন, নিবিড় শ্যামলিমাকে তিনি আপন মনে করতেন। তাই বলতেন ‘গ্রামেই তাঁর শিকড় আছে। শহরে আছে শুধু আমার শাখাপ্রশাখা’। শালপিয়ালের জঙ্গলে যখন ঘুরতেন’ তখন তিনি বুঝতেন যে, সেখানে বাস্তুতন্ত্রের প্রতিটি উদ্ভিদ এবং প্রাণী আপন ছন্দে লালিত-পালিত। কিন্তু আধুনিকতার নাম করে, সভ্যতার নানা ছলায় যখনই নগর গড়ে উঠেছে, তখনও সেখানে প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দ সাংঘাতিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। দুর্গাপুরে যখন বন কেটে নগরী প্রতিষ্ঠিত হল; গড়ে উঠলো আধুনিক ইস্পাত কারখানা ; তখন সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে রচনা করলেন ‘শেষনাগ’। সেখানেও তিনি দেখালেন যে কী ভাবে ধ্বংস হয়ে যায় সমস্ত প্রাণীকুল। কী ভাবে সেখানে বিধ্বস্ত হয় স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র। আধুনিক মানুষ, সভ্যতার মানদণ্ডে নিজস্ব অস্মিতায় বুঝতেই চায় না যে, এই বিশ্বপ্রকৃতি শুধুমাত্র মানুষের জন্যে নয়। এই প্রকৃতি, এর জল-বাতাস, সবেতেই সকল উদ্ভিদ ও প্রাণীর অধিকার আছে। মনুষ্যেতর প্রাণীর বাস গড়বার, সেখানে বাস করবার, বংশ বিস্তার করবার অধিকার আছে। আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা তাদের সেই অধিকারকে চূড়ান্ত খর্ব করে নিজের অহমিকাকে প্রতিষ্ঠা করছে। তাঁর অরণ্য-সংশ্লিষ্ট সকল কাহিনীতে এই আর্তিই যেন বিভিন্ন ভাবে ফুটে উঠেছে। ঐতিহাসিক উপন্যাস বেশি রচনা করেননি তিনি। এর মধ্যে বিখ্যাত দুটি উপন্যাস হল —‘মণিবেগম’ এবং ‘সোমনাথ’। পলাশির যুদ্ধের প্রেক্ষিতে মীরজাফর আলি খাঁয়ের কূটনীতিকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু মানুষ মীর জাফরের সন্ধান করেছেন শক্তিপদ এই উপন্যাসে। তার শেষ বয়েসে সঙ্গী ছিল তারই এক বাঁদি মণি। একসময়ে সে বাইজি হিসেবে নাচগান করত। আগত অতিথিদের মনোরঞ্জন করত। কিন্তু মীরজাফরের শেষ বয়েসে এই মণিই সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়। এক দিকে বৃদ্ধ নবাবের তরুণী মণির প্রতি আবেগ, ভালবাসা, নির্ভরতা যেমন প্রকাশিত হয়েছে; তেমনই মণির অন্তরের চিরকালীন সেবাপরায়ণ নারীত্ব ও প্রেম অম্লান ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ‘সোমনাথ’ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হলো সুলতান মামুদের আক্রমণ। কিন্তু এই কাহিনি আসলে মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত পণ্ডিত ও সে সময়ের ভারত-বিশেষজ্ঞ আল বিরুনির জীবনালেখ্য। তিনি মুলতান থেকে এসে প্রথম দেখেছিলেন এক সুগভীর বহুত্ববাদী ভারতবর্ষের স্বরূপ। তিনি দেখেছিলেন হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি ধর্মমতের সহাবস্থান; আবার দেখেছিলেন হিন্দু ধর্মের মধ্যেই শৈব, বৈষ্ণব, তন্ত্রের অপূর্ব মিলন। শুভা নামক নটীর স্নেহ লাভ করে কৃতার্থ হয়েছে। সেই সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তিনি লিখেছেন- ‘তরিকা আল হিন্দ’, ‘কিতাবুত তাহ্ফিম’ প্রভৃতি।
শিক্ষক, কান্দি রাজ কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy