Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

সিম্বা আর বশ্যতার রূপকথা

এখানেই ভারতীয় সংস্কৃতি। গ্রিক উপকথায় হারকিউলিস, বাইবেলে স্যামসন সকলেই খালি হাতে সিংহশিকার করেছেন। গ্রিকরা অবশ্য সিংহ-টিংহ ভাল চিনত না।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

সর্বদমন সিম্বার সঙ্গে খেলা করছিল। আফ্রিকার জঙ্গলে নয়, হিমালয়ে মারীচ ঋষির তপোবনে। সিম্বা কে, এই ‘লায়ন কিং’-এর যুগে সবাই জানেন। সিংহশিশু। আর, সর্বদমন নিতান্ত দো-পেয়ে মানবশিশু। ভয়ডর নেই, শিশুসিংহের কেশর ধরে টানতে টানতে বলছিল, ‘জিম্ম সিংহ, দন্তাইং দে গণইম্মং।’ মানে, ‘সিংহ, হাই তোল তো, তোর দাঁতগুলি গুনে দেখি।’ কিছু ক্ষণ বাদে, এই আশ্রমেই রাজা দুষ্মন্ত আসবেন। বোঝা যাবে, তাপসী শকুন্তলা তাঁরই স্ত্রী। সর্বদমন এই রাজদম্পতির পুত্র। ভবিষ্যতে তার নাম হবে ভরত। সেই ভরত থেকেই তো আমাদের দেশের নাম! হলিউড যতই আফ্রিকার গুণগান করুক না কেন, সিম্বাদের মতো সিংহশিশুরা আসলে আমাদের, ভরতবংশীয়দের খেলার সাথি।

রাজকীয়ত্বের বৈভব পশুরাজের কেশরে। শকুন্তলা-দুষ্মন্ত-ভরতকে নিয়ে ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটকটি যিনি লিখেছিলেন, সেই কালিদাস গুপ্তযুগের মানুষ। সে যুগে সমুদ্রগুপ্ত, কুমারগুপ্তের নামাঙ্কিত অনেক মুদ্রাতেই আছে তাঁদের সিংহশিকারের ছবি। সাহিত্য বা সিনেমা কিছুই আকাশ থেকে পড়ে না, তা একটি বিশেষ সময়ের সাংস্কৃতিক উৎপাদনমাত্র। শিশু ভরত কেন শান্ত, নিরুদ্বিগ্ন তপোবনে অন্য আশ্রমচারীদের মতো নয়, উল্টে সিংহশিশুর সঙ্গে খেলে, তারও উত্তর ওই সাংস্কৃতিক পুঁজিতে। রাজা সকলের উপরে, দেবতার প্রতিভূ। সে তিনি মানুষের রাজা বা পশুর রাজা যা-ই হন না কেন! হিন্দু সভ্যতা সব সময় থাকবন্দি সমাজে বিশ্বাস করে। সবার উপরে রাজা, নীচে বাকিরা। এই থাকবন্দি সমাজে মানুষ রাজপুত্র পশুরাজের সঙ্গে খেলবে না তো কি হায়না, শেয়াল, কুকুরের সঙ্গে খেলবে?

এখানেই ভারতীয় সংস্কৃতি। গ্রিক উপকথায় হারকিউলিস, বাইবেলে স্যামসন সকলেই খালি হাতে সিংহশিকার করেছেন। গ্রিকরা অবশ্য সিংহ-টিংহ ভাল চিনত না। হারকিউলিস যে সিংহটিকে বধ করেন, তার সারা গায়ে সোনালি লোম। সে আসলে টাইফন নামে এক দানবের পুত্র, গায়ে তির লাগলে ছিটকে বেরিয়ে আসে। আমাদের সিংহ অবশ্য দানবপুত্র নয়, স্বয়ং ঈশ্বর। হিরণ্যকশিপুকে বধ করতেই থামের ভিতর থেকে আবির্ভূত হন আধা সিংহ-আধা মানুষরূপী নৃসিংহ অবতার। আমাদের অশোকস্তম্ভে পিঠোপিঠি দাঁড়ানো চারটি সিংহ সাহস ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। শাক্যসিংহ হিংসাকে বিসর্জন দিয়েই মানব-হৃদয়ের অধীশ্বর হয়েছিলেন। সব মিলিয়েই সিম্বাকে সিনেমার পর্দায় আর এক বার দেখার জন্য ছটফট করছিলাম।

কিন্তু নারীবাদী ও দলিতবাদীদের ‘পলিটিকালি কারেক্টনেস’-এর দৌলতে সেই চনমনে ভাল লাগা চটকে গেল। সমালোচনা শুনলাম, সিংহ পরিবারে সিংহীরাই আসল, তারা শিকার করে, সিংহ সেই শিকারের বড়সড় একটা অংশ পায়। সেখান থেকেই ‘সিংহভাগ’ (লায়ন্স শেয়ার) শব্দের উৎপত্তি। অথচ এই ছবিতে সিম্বার মা সারাবি, প্রেমিকা নালা কেউ গুরুত্ব পায়নি। পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা যেমন আর কী!

সমালোচকরা বুঝলেন না, পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবী কোনও দিনই সিংহীদের সম্মান দেখাতে কসুর করেনি। কয়েক দশক আগে ‘বর্ন ফ্রি’ তৈরি হয়েছিল সিংহী এলসাকে নিয়ে। প্রাচীন গ্রিস, রোমে মন্দিরের সিংহদ্বারগুলিতে কেশরহীন সিংহীই খোদাই করা থাকত। প্রাচীন মিশরে শেখমেত নামে এক দেবী ছিলেন। সিংহের মতো মুখ, মাথায় সূর্য। তাঁর নিঃশ্বাসেই মিশরীয় মরুভূমির উৎপত্তি। সিংহীদের পারস্পরিক সহযোগিতা, ক্ষিপ্রতা ও শিকার-কৌশলকে মানুষ সম্মান দিয়েছিল বলেই এই গল্পগুলির উৎপত্তি। ব্যাবিলন, মিশর থেকে ‘লায়ন কিং’ অবধি গল্পগুলিকে গল্প ভেবেই দেখতে হবে। পৃথিবীর সভ্যতা শুধু পিরামিড আর তাজমহলে থাকে না। সে রয়ে যায় বিভিন্ন এলাকার, বিভিন্ন সময়ের বহমান গল্পে। সিংহবাহনা দেবী দুর্গা বা জগদ্ধাত্রীকে তাঁদের গল্পে নিহিত শক্তিতেই দেখা বাঞ্ছনীয়। দেবীরা পুরুষসিংহদের পদানত করেছেন ভাবলে গল্পের অন্দরমহলে আমরা পৌঁছতে পারব না। তখন একের পর এক বয়ানের সংঘর্ষ বাধবে, সকলে ‘আমিই ঠিক’ প্রমাণে উঠে পড়ে লাগবে।

দলিতবাদীদের সমালোচনা আরও ভাল। তাঁদের বক্তব্য, ‘লায়ন কিং’ আসলে হলিউডি জাঁকজমকে মোড়া একটি পশ্চাদপর ছবি। হলিউড এখানে বোঝায় সিংহের ছেলেই রাজসিংহ হবে, হাতি ও অন্য পশুরা সেলাম ঠুকবে। তা, রূপকথা কবেই-বা স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত করেছে? রাজার ছেলে রাজপুত্র হয়েছে। রাজপুত্র, মন্ত্রিপুত্র, কোটালপুত্র, সওদাগরপুত্র সবাই নির্বিঘ্নে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে গিয়েছে। আবার স্থিতাবস্থা নিয়েই ফিরে এসেছে। বিদ্রোহ, বিপ্লব নয়, স্থিতাবস্থাতেই আজকের রূপকথা।

এই স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে দরকার শক্তিশালী রাজা। সিম্বার বাবা সিংহপুত্রকে বলে, ‘সীমান্তের ও পারে, হাতিদের গোরস্থানে যেয়ো না। জায়গাটা বিপজ্জনক।’ কিন্তু সূর্য-ডুবুডুবু সময়ে অবাধ্য সিম্বা সেই গোরস্থানে চলে যায়। হায়নাদের হামলায় বিপদে পড়ছিল, তখনই বাবা চলে আসে। অন্তেবাসী, হিংস্র জঙ্গলের রাজার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। সীমান্তের ও পারে যে হিংস্র হায়নারা রয়েছে, তারা আমাদের রাজাকে দেখেই সভয়ে বশ্যতা স্বীকার করবে এটাই তো আজকের বিশ্বজোড়া রূপকথা।

আর আছে চিরাচরিত রূপকথা। নিজের পরিচয় ভুলে যাওয়া সিম্বাকে জলে তার প্রতিবিম্ব দেখিয়ে বলা হয়, ‘তোমার বাবাকে দেখবে? ওই দেখো’! কেশরফোলানো সিংহটিকে দেখে চমকে ওঠে সিম্বা। বহু আঁকাবাঁকা ইগো-সংঘাতের পথ পেরিয়ে পুত্র তো শেষে পিতাই হয়ে উঠতে চায়! ‘পলিটিকাল কারেক্ট’বাদীরা একে পিতৃতন্ত্র বললে রবীন্দ্রনাথকে আগে চেপে ধরতে হবে। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ লিখেছেন কেন তিনি?

তাই সিংহী-সিংহ নয়, সবচেয়ে বড় রূপকথা অন্যত্র। সিম্বার বাবা ছেলেকে নিয়ে জঙ্গলের উঁচু জায়গায় চলে যায়, ‘এই দেখো। আমাদের দেশ। গৌরবভূমি।’ সিংহদের দলকে ইংরেজিতে ‘প্রাইড’ বলে। হিন্দি ভার্শনে সেই ‘প্রাইডল্যান্ড’ হয়েছে গৌরবভূমি। জন্মভূমির সঙ্গে মিল লক্ষণীয়।

সিংহী বনাম সিংহ নয়। ভাষান্তরেই এই দুনিয়ার সচেতন রূপকথা লুকিয়ে থাকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Animal Simba
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy