Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Mahatma Gandhi

ভারতাত্মা

গাঁধীকে লইয়া বিজেপির মহা মুশকিল। ভারতের নিকট গাঁধীর দর্শন যত দিন বৈধ এবং প্রাসঙ্গিক, তত দিন অবধি বিজেপির রাজনীতি সম্পূর্ণ বৈধতা অর্জন করিতে পারে না।

মহাত্মা গাঁধি।

মহাত্মা গাঁধি।

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:৩৮
Share: Save:

নাথুরাম গডসের পিস্তল জানাইয়া গিয়াছে, কোনও অস্ত্র যাঁহাকে ছিন্ন করিতে পারে না, গাঁধী ভারতের সেই আত্মা। ভারতের সামাজিক পরিসরের বুননে গাঁধীর উপস্থিতি অমোঘ, বিশেষত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রশ্নে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা যাহা বলে, তাহা সকল ধর্মকে সমান গুরুত্ব প্রদানের কথা, প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর নিজের ধর্ম মানিয়া চলিবার সম্পূর্ণ অধিকারের কথা। ইহা গাঁধীর দর্শন। তিনি বলিয়াছিলেন, এক জন হিন্দুকে মানিয়া লইতে হইবে যে মুসলমানেরা বলিবেন আল্লা ব্যতীত আর কোনও ঈশ্বর নাই; আবার, সেই মূর্তিপূজাবিরোধী মুসলমানকেও মানিতে হইবে যে হিন্দুরা মন্দিরে মূর্তির উপাসনা করিবেন। সত্য আর অহিংসা, গাঁধীর নিকট এই দুইটি শব্দই ছিল ধর্মের সার, তাঁহার যাবতীয় বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর। সত্য তাঁহার নিকট নৈতিকতার রূপ। হিন্দুধর্মে আমূল বিশ্বাসী গাঁধী বলিয়াছিলেন, ধর্মের যে প্রথা তাঁহার নিকট যুক্তিগ্রাহ্য নহে, তিনি তাহা গ্রহণ করিবেন না। যে রাম এক শূদ্রকে বেদপাঠের অপরাধে শাস্তি দিয়াছিলেন, পরম রামভক্ত গাঁধী সেই রামকে না মানিবার কথা প্রকাশ্যে জানাইয়াছিলেন। এই যুক্তি নৈতিকতার— ধর্ম, বা ধর্মের নামে প্রচলিত আচারের অন্ধ অনুশীলনের নহে। তাঁহার মতে, প্রকৃত ধার্মিক শুধু ভিন্ন ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ সহনশীল নহেন, সেই ধর্মের মধ্যে যাহা উত্তম, তাহা গ্রহণে সদাপ্রস্তুত। অন্য দিকে, সম্পূর্ণ অহিংসার দর্শন তাঁহাকে শিখাইয়াছিল সকল মানুষের প্রতি সমভাবাপন্ন হইতে। তিনি ঘোষণা করিয়াছিলেন, তাঁহার স্বপ্নের ভারতবর্ষে কোনও একটি ধর্মের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হইবে না— সেই ভারতে প্রতিটি ধর্ম সম-অধিকারে একে অপরের সহিত সহাবস্থান করিবে।

গাঁধীকে লইয়া বিজেপির মহা মুশকিল। ভারতের নিকট গাঁধীর দর্শন যত দিন বৈধ এবং প্রাসঙ্গিক, তত দিন অবধি বিজেপির রাজনীতি সম্পূর্ণ বৈধতা অর্জন করিতে পারে না। ভারতীয় রাজনীতি, এবং ভারতীয় মনন হইতে গাঁধীকে মুছিয়া দেওয়ার তিনটি বিকল্প পথ আছে— গাঁধীকে তাঁহার যাবতীয় দর্শন হইতে, বিশ্বাস হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া কিছু প্রতীকে রূপান্তরিত করা; গাঁধীকে সম্মানের অযোগ্য প্রতিপন্ন করা; এবং, গাঁধীর হিন্দুধর্ম আর সঙ্ঘের হিন্দুত্বকে এক ও অভিন্ন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা— অর্থাৎ, গাঁধীকে আত্মসাৎ করিয়া ফেলা। গৈরিকবাহিনী তিনটি পথেই হাঁটিতেছে। স্বচ্ছ ভারত অভিযানে গাঁধীর চশমা বা খাদির ক্যালেন্ডারে চরকাশোভিত নরেন্দ্র মোদীর ছবি প্রকৃত প্রস্তাবে গাঁধীকে কিছু অকিঞ্চিৎকর প্রতীকে আটকাইয়া ফেলিবার চেষ্টা। অন্য দিকে, প্রজ্ঞা ঠাকুর বা অনন্ত হেগড়েরা কখনও গডসের নামে জয়ধ্বনি করিয়া, আবার কখনও সত্যাগ্রহকে ‘নাটক’ বলিয়া দেখিতেছেন, অপমানের অস্ত্রে গাঁধী-বধ সম্ভব হয় কি না।

এই দুইটি পথ অপেক্ষা অনেক বেশি স্পর্ধা প্রয়োজন তৃতীয় পথে হাঁটিতে, অর্থাৎ গাঁধীকে হিন্দুত্ববাদী বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টায়। গাঁধীর সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে মোহন ভাগবত প্রাণপণ বুঝাইয়াছিলেন যে গাঁধী তাঁহাদের সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শের সহিত সহমত ছিলেন। গত ৩০ জানুয়ারি, গাঁধীর মৃত্যুদিনে, রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বলিলেন, সিএএ-র মাধ্যমে এই সরকার গাঁধীর স্বপ্নই পূরণ করিতেছে। হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে গাঁধীকে আত্মসাৎ করিবার কাজটি অসম্ভব কঠিন। মানুষটি ধর্ম বিষয়ে, এবং পরধর্ম বিষয়ে, ভারতের নাগরিকত্বে ধর্মীয় পরিচয়ের গুরুত্ব বিষয়ে এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বিষয়ে যাহা বলিয়াছেন, যাহা লিখিয়াছেন, তাহার প্রতিটি অক্ষর আরএসএস-এর দর্শনের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। মোদীদের আরাধ্য গোলওয়ালকর জাতপাতপ্রথার পক্ষে যুক্তি খাড়া করেন, আর গাঁধী এই প্রথার প্রয়োগভঙ্গি, পদ্ধতি ও পরিণতিকে হিন্দুধর্মের বৃহত্তম বিকৃতি হিসাবে দেখেন। সাভারকর দ্বিজাতি তত্ত্বের অবতারণা করেন, আর গাঁধী নিজের মৃত্যুর পক্ষকাল পূর্বে প্রকাশ্য জনসভায় জানান, ভারত ও পাকিস্তান রাজনৈতিক ভাবে দুইটি পৃথক দেশ হইতে পারে, তাহাদের আত্মা এক। সঙ্ঘ পরিবার তাহাদের স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্রে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করিয়া রাখিবার খোয়াব দেখে, আর গাঁধী বলেন, যত ক্ষণ না ধর্মনির্বিশেষে এই দেশে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা হয়, তত ক্ষণ অবধি স্বরাজ অর্থহীন। এই গাঁধীকে আত্মসাৎ করিবে, হিন্দুত্ববাদের সাধ্য কী? এবং, যে ভারতের হৃদয়ে গাঁধীর অক্ষয় আসন, সেই ভারতের আত্মাকেই বা বিজেপি জিতিতে পারিবে কেন?

যৎকিঞ্চিত

এ বার বইমেলা বাঙালিয়ানায় পেল্লায় থিতু। লিটল ম্যাগাজিন অঞ্চলে প্রকাণ্ড ভিড়, মূল স্রোতকে স্বল্প উপেক্ষা ও ‘সমান্তরাল স্রোতে আছি’ ঘোষণা বাঙালির অভিজ্ঞান। তার পর আবার মিছিলও বেরলো, অচিরে হাতাহাতিও লেগে গেল গৈরিকদের সঙ্গে সেই মিছিলের। বইয়ের উৎসব কোঁদলের বাইরে থাকলে, সাম্প্রতিক হয়ে উঠবে কী করে? আর অবশ্যই ছিল, যাঁরা প্রাণপণ খাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি ব্যঙ্গ। ব্যঙ্গকারীরা পরে খেতে খেতে বললেন, খালি পেটে ধর্মই হয় না, তায় শিল্প!

অন্য বিষয়গুলি:

Mahatma Gandhi Hindu Muslim
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy