Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শাঁখের করাত

মুশকিল এই যে, কূটনীতির সহিত রাজনীতি অনেক সময়ে খাপ খায় না। সংশোধিত ইউএপিএ সেই ভাবেই ভারতীয় রাজনীতিতে একটি তীব্র অন্যায্যতার পরিসর তৈরি করিল।

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৯ ০০:০৭
Share: Save:

গত সপ্তাহে সংসদে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ (সংশোধনী) আইনে বড় রকমের পরিবর্তন আনিয়া যে নূতন আইন পাশ হইল, তাহাতে ভারতের সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম ঠেকাইবার নূতন একটি ধারা তৈরি হইল, বলা চলিতে পারে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাস-অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করিবার পথ এত দিন ভারতের কাছে অধরা ছিল। তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা এখন সহজ হইবে। লোকসভায় বিল পাশের পরই তাই শোনা গেল দাউদ ইব্রাহিম, হাফিজ় সইদ এবং মাসুদ আজ়হারের নাম। আশা করা যাইতেছে, রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং পাকিস্তানের দিকে বহু দিন তাকাইয়া থাকিয়াও সুবিধা না হইবার পর লস্কর-এ-তইবার হাফিজ় সইদ এবং জইশ-এ-মহম্মদের মাসুদ আজ়হারকে এখন জাতীয় নিরাপত্তা আইনের সাহায্যেই বাগে আনা যাইতে পারে। প্রায় এক দশক ধরিয়া জাতীয় সংসদে ইউএপিএ-র এই পরিবর্তনের প্রস্তাব আলোচিত হইতেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় সরকার যে হঠাৎ করিয়া বিষয়টিকে দ্বিগুণ চাপে সংঘটিত করিতে পারিল, তাহার কারণ আন্তর্জাতিক পরিবেশও ইতিমধ্যে কিছু বদলাইয়াছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে মাসুদ আজ়হারের নামটি ‘ব্ল্যাক লিস্ট’-এ তুলিবার প্রয়াস হইয়াছে। আমেরিকার নেতৃত্বে তাঁহাকে ধরিবার জন্য পাকিস্তানের উপর চাপ বাড়িয়াছে। সুতরাং কূটনৈতিক দিক দিয়া এই নূতন আইনের উপযোগিতা স্পষ্ট— আন্তর্জাতিক নীতি-মতে কোনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সহিত সংযোগ প্রমাণ করা সম্ভব না হইলেও অতঃপর জাতীয় আইন অনুযায়ী ইঁহাদের সন্ত্রাসবাদী বলিতে পারা নিশ্চয়ই একটি বড় পদক্ষেপ।

মুশকিল এই যে, কূটনীতির সহিত রাজনীতি অনেক সময়ে খাপ খায় না। সংশোধিত ইউএপিএ সেই ভাবেই ভারতীয় রাজনীতিতে একটি তীব্র অন্যায্যতার পরিসর তৈরি করিল। সন্ত্রাসবাদীদের ক্ষেত্রে এই আইনের যে সুবিধা, তাহা দিয়াই আবার দেশের নানা বিরোধী স্বরকে শায়েস্তা করিবার চেষ্টা চলিতে পারে। আশঙ্কাটি উঠিতেছে, আইনটির অভিমুখ পাল্টাইবার ফলে। এত দিন সন্ত্রাসী কিংবা দেশদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত গোষ্ঠীর সূত্রেই এই আইন মোতাবেক অপরাধীর অপরাধ নিশ্চিতকরণ হইত। নূতন আইনে এই বার অভিমুখটি ঘুরিয়া গেল ব্যক্তির দিকে। অর্থাৎ আইনরক্ষক রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে যদি কাহারও কোনও কাজ বা চিন্তা রাষ্ট্রবিরোধী বলিয়া বিবেচিত হয়, তবে তাঁহার ব্যক্তিগত ভূমিকাটির জন্যই এই অতি কঠোর আইনটি প্রয়োগ করা সম্ভব। কোনও রাষ্ট্রদ্রোহের সম্মেলক কাজের সহিত যুক্ত না হইয়াও যদি কাহারও মত বা পথ যদি সেই দ্রোহের প্রতি সহানুভূতি-পরায়ণ বা সমর্থনপ্রবণ বলিয়া বিবেচিত হয়, তাঁহাকে আটক করা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, কঠিন শাস্তি দেওয়া সম্ভব।

প্রসঙ্গত ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের কথা স্মরণ করা যাইতে পারে। ‘আর্বান নকশাল’ বলিয়া তাঁহাদের আটক করিবার পর এখনও পর্যন্ত প্রয়াস চলিতেছিল, তাঁহাদের সহিত মাওবাদীদের সংযোগ প্রমাণ করিবার। নূতন আইনে প্রয়াসটিই অবান্তর হইতে পারে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার স্পষ্ট প্রমাণ ব্যতিরেকেই ব্যক্তির স্বাধীন মতামতের উপর রাষ্ট্রের ভয়ানক খাঁড়া নামিয়া আসিতে পারে। বুঝিতে অসুবিধা নাই, অভ্যন্তরীণ ব্যঞ্জনায় এই আইন কতখানি অগণতান্ত্রিক, ব্যক্তিস্বাধীনতার কতটা পরিপন্থী। বাস্তবিক, এমন সন্দেহও হইতে পারে যে, ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে বর্তমান রাষ্ট্রীয় কর্তাদের রাজনীতি-বিরোধিতা দমন করাই সরকারের লক্ষ্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদের বক্তব্যে যেন সেই ইঙ্গিতই স্পষ্ট হইতেছে। তাঁহার একার কথাই হয়তো প্রমাণ— বর্তমান সরকারের চোখে সরকারবিরোধিতার অর্থ রাষ্ট্রদ্রোহিতা বই কিছু নহে। ইহাকেই ফ্যাসিবাদ বলে। অভ্যন্তরীণ প্রয়োগে এই নূতন আইন তাই গণতন্ত্রের পক্ষে অভূতপূর্ব রকমের বিপজ্জনক।

অন্য বিষয়গুলি:

UAPA Amendment Terrorism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy