অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল ছবি
একটি সাদা পাঞ্জাবী, নৌকার মতো একটি চটি পরে দিল্লিতে অ্যাকাডেমি পুরস্কার নিতে উঠছেন এক জন ছিপছিপে রোগাটে সাড়ে ছ’ফুট লম্বা মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুলের মানুষ। তাঁকে পুরস্কার নিতে উঠতে দেখে অনেকেই ভ্রূ কুঁচকেছিলেন। অনেকেরই মনে হয়েছিল চলতি হাওয়ার কাছে তিনি একেবারেই বেমানান। তবু তিনি সব ধরনের আড়ম্বর থেকে বহুদূরবাসী, নিজের সৃষ্টির মধ্যে ডুবে থাকা একজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব। তিনি কর্মে নিষ্ঠাবান, ভিতরে ভিতরে প্রবল ভাবপ্রবণ এবং শিশুর মতোই আবেগ সর্বস্ব। তবে তাঁর জেদ এবং নিয়ামানুবর্তিতার কথা লোকের মুখে মুখে ফেরে। জীবনে সিগারেট ছিল এই ব্যক্তিটির সব সময়ের সঙ্গী আর চেতনা ছিল মার্কসীয় তত্ত্বে জারিত। এই মানুষটিই অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে বাংলা নাট্যজগতে পরিচিত হলেও তাঁর প্রকৃত নাম অজিত। ১৯৩৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন মানভূম, বর্তমান পুরুলিয়া জেলার জয়পুর ব্লকের রোপো গ্রামের মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবার বাড়ি ছিল অধুনা পশ্চিম বর্ধমান জেলার রানিগঞ্জ অঞ্চলের অন্তর্গত কেন্দা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ভুবনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম লক্ষ্মীরানি। পাঁচ বছর বয়সে পুরুলিয়ার মধুবন স্কুলে ভর্তি হলেও পরে ঝালদার সত্যভামা হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনা করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন ‘কুলটি উচ্চ বিদ্যালয়ে’। এর পরে আসানসোল কলেজে (বর্তমানের বিবি কলেজ) ভর্তি হলেও পরে সুযোগ পেয়ে চলে যান কলকাতার মণীন্দ্র কলেজে। সেখান থেকে ইংরেজিতে স্নাতক।
ছোটবেলা থেকেই থিয়েটারের সঙ্গে যেন একটা অদ্ভুত আত্মীয়তা ছিল অজিতেশের। তাই আসানসোলের ছোটঘরের চৌকিকে মঞ্চ বানিয়ে বন্ধু, ভাই-বোনেদের সঙ্গে নাটকের মহড়া দিতেন। ১৯৪৭ সালে মে মাসে শিক্ষক ধীরেন ঘটক অজিতেশকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’-য় ন’কড়ি চরিত্রে অভিনয় করান। এ ছাড়া শিক্ষক আদিত্য মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘রামের সুমতি’ নাটকে অভিনয় করেন। আসানসোল কলেজে পড়ার সময়ে তিনি কলেজের সংস্কৃতি বিভাগের সম্পাদক হন। এখানেই তাঁর সংস্কৃতি চেতনা ও অভিনয় ক্ষমতার প্রথম প্রকাশ ঘটে।
কলকাতার কলেজে পড়ার সময় থেকে অজিতেশ জড়িয়ে পড়েন পাতিপুকুর শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে। মূলত কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন পরিবারের সদস্য হয়েও তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। এখান থেকেই তাঁর নাটকের সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার সম্মিলন ঘটে। যদিও তিনি কোনও দিনই সে ভাবে মিটিং, মিছিলে অংশ নিয়ে পার্টির আদর্শ প্রচার করেননি তবে মনে প্রাণে তিনি ছিলেন আদ্যন্ত এক ‘কমিউনিস্ট’।
এই নাটকের মধ্যে ডুবে থাকা অনেকের মতে তাঁর নিবিষ্ট সাংস্কৃতি চেতনারই প্রতিফলন। তবে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, অজিতেশ রাজনীতি আর সংস্কৃতিকে কোনও দিনই একাসনে বসাতে পারেননি। বা ইচ্ছা করেই এ দুয়ের মধ্যে সচেতন একটি দূরত্ব রেখে চলতে চেয়েছিলেন। তিনি থিয়েটারে রাজনৈতিক উপাদান প্রয়োগ করেছেন খুবই সচেতন ভাবে। উচ্চকিত রাজনৈতিক শ্লোগানে দিয়ে তাই অজিতেশের নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে না। বরং তাঁর নাটক এক স্থিরতর রাজনৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধের সামনে দর্শককে দাঁড় করায়। এই কারণেই গণনাট্য সম্পর্কে অজিতেশে অনুৎসাহিত হয়েছিলেন। গণনাট্যের প্রতিটি ধ্যান ধারণাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা তাঁর মতো সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও সব বিষয়ে সহমত হতে না পারার জেরে অনেকে তাঁকে ‘দক্ষিণপন্থী’ ধ্যান ধারণার মানুষ বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন।
এর জেরে এমন এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয় যে অজিতেশকে বাধ্য হয়ে চলে যেতে হয়। ‘বহুরূপী’ পত্রিকায় ‘ব্রেখটের সঙ্গে পরিচয়ের আদিপর্ব’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘আমি লক্ষ করেছি যাঁরা পার্টির সদস্যপদ নেন তাঁরা পার্টির সুবিধাগুলো ভোগ করেন, কষ্টগুলো নয়’। এর থেকে বোঝা যায় কিছুটা আক্ষেপ তার মধ্যে কাজ করছিল। অজিতেশ মনে করতেন পার্টিকে ভালবাসলে তার সমালোচনা করতে হবে। প্রয়োজনে নির্ভীক হয়ে সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু সমালোচনা করলেই একাংশের কাছে সুবিধাবাদী, বুর্জোয়া ইত্যাদি অভিধা পেতে হয়। পার্টির শৃঙ্খল ছেড়ে অজিতেশ স্বতন্ত্র ভাবে নাট্যচর্চা করলেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পার্টিকে অন্তর থেকে ভালবেসেছিলেন।
শম্ভু মিত্রের মতোই অজিতেশেরও বিশ্বাস ছিল বিশ্বের সব জ্ঞান ও শিক্ষণীয় বিষয়ের মেলবন্ধনেই সৃষ্টি হয় থিয়েটার নামক মহৎ শিল্প। তাই তিনি এক দিকে, যেমন বিভিন্ন বিদেশি নাটকের অনুবাদ করেছেন অন্য দিকে, ঠিক তেমনই সেই অনুবাদের মধ্যে নিয়ে এসেছেন বাংলার মাটির গন্ধ। তাই চেকভের ‘দ্য সওয়ান সং’ অবলম্বনে ‘নানা রঙের দিন’ নাটককে তিনি উপস্থাপিত করেন ভারতীয় প্রেক্ষিতে। চেকভের তৈরি ‘চেরি অর্চার্ড’ অবলম্বনে অজিতেশ যখন লিখলেন ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ তখন সেখানে যে মধ্যবিত্ত সমাজের কথা শোনা যায়, তাঁরা কেউই রাশিয়ান নন, বরং ভারতীয় জীবন থেকে তুলে আনা জীবন্ত চরিত্র। এই নাটকে ঝাড়খণ্ডী উপভাষাকে ব্যবহার করে বাঙালি সামন্ততান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাকে তুলে ধরতে চাওয়া হয়েছে। ১৯৭০-এ ব্রেখট-এর ‘থ্রি পেনি অপেরা’ অবলম্বনে তিনি যখন ‘তিন পয়সার পালা’ রচনা করলেন তখন বিদেশি কাহিনিতে উঠে এল আমাদের সমাজের অতীতের বাবু কালচার। ‘সওদাগরের নৌকা’-তে প্রসন্নরূপী অজিতেশ তিন দেওয়ালের একটা ঘর তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
এ ভাবেই কাজ এগিয়ে চলছিল। কিন্তু অনেক কাজ বাকি থাকা সত্ত্বেও মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তাঁকে চলে যেতে হয়। বাংলা নাটক, যাত্রা ও সিনেমায় তিনি যে অবদান রেখে গিয়েছেন তার সম্পূর্ণ মূল্যায়ন করতে এখনও বহু দূর যেতে হবে আমাদের।
তথ্যসূত্র: ‘অজিতেশ আমার অজিত’: লক্ষ্মীরানি বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর থিয়েটার’, নাট্য অ্যাকাডেমি, পবিত্র সরকার, ‘মঞ্চ থেকে মাটিতে’: অনীত রায়
লেখক দুর্গাপুরের গৃহশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy