লম্বা। ছিপছিপে। ঋজু কাঠামো। ভাঙা মুখ, শক্ত চোয়াল। চওড়া কপাল, তীক্ষ্ণ নাসা। আর গভীর, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যা ছিল অপ্রতিরোধ্য। সেই সঙ্গে এক আশ্চর্য দুর্লভ কণ্ঠস্বরের জাদুময়তা। ম্যাটিনি আইডল ছিলেন না মোটেই, বরং তাঁর মতো চরিত্রাভিনেতার পাশে বহু ম্যাটিনি আইডল ম্লান হয়ে গিয়েছেন।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পটভূমিকায় হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘ভুলি নাই’ (১৯৪৮) ছিল বিকাশের দ্বিতীয় ছবি। এই ছবিতে বিশ্বাসঘাতক মহানন্দের চরিত্রে বিকাশ দাপিয়ে অভিনয় করলেন।' মনে পড়ে আত্মজীবনীতে বিকাশ লিখেছেন, ‘‘... সত্যি কথা বলতে কী, ‘ভুলি নাই’-এর পর আমাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’’
ওই অপ্রতিদ্বন্দ্বী কণ্ঠস্বরে পুষ্ট মার্জিত উচ্চারণ, বিশেষ করে ইংরেজি উচ্চারণের কারণে বিকাশ রায়কে শিক্ষিত মানুষের ভূমিকাতেই মানাত বেশি। '৪২' একটি মাইলফলক। কিন্তু কে ভুলতে পারে 'আরোগ্যনিকেতন' ছবির জীবনমশাইকে? কিংবা 'উত্তরফাল্গুনী'র স্বার্থহীন প্রেমিক মনীশকে? পরে 'ছদ্মবেশী' ছবিতে খামখেয়ালি কিন্তু আদরণীয় ব্যারিস্টার প্রশান্ত ঘোষের ভূমিকায় অন্য রকম বিকাশ রায়ের অসামান্য অভিনয় প্রতিভার চিরন্তন সাক্ষর। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিকাশ রায়ের ২৪৮ টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। চার দশক ধরে তিনি দিয়ে যান অসামান্য কিছু ছবি ও কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। তিনি ছিলেন জাতশিল্পী। দাপুটে শরীরী ভাষা ছিল তাঁর অভিনয়ের অনুষঙ্গ।
উত্তম কুমারের মতো তাঁরও শেষ ছবি ‘ওগো বধূ সুন্দরী’। অভিনয় করেছিলেন স্নেহময়ী দাদুর ভূমিকায়। নায়ক-কমেডিয়ান-খলনায়ক-চরিত্রাভিনেতা কোনটা নন বিকাশ রায়! বহুমাত্রিক বিকাশ রায় অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছবির প্রযোজনা, পরিচালনা, কাহিনি-রচনা ও চিত্রনাট্য রচনাও করেছেন। বড় পর্দার টানে প্রযোজনা-পরিচালনা করেছিলেন 'মরুতীর্থে হিংলাজ', 'রাজা সাজা', 'কেরী সাহেবের মুন্সি' এবং 'দেবতার গ্রাস'-এর মতো ছবিতে।
সহপাঠী অশোক মিত্র’র কথায়, "সব মিলিয়ে হি ওয়াজ জেম”। আর সেই রত্নকে যেমন চিনতে ভুল করেননি শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, তেমনই ভুল করেননি চিত্রনাট্যকার জ্যোতির্ময় রায়, পরিচালক হেমেন গুপ্ত, অভিনেতা–পরিচালক প্রমথেশ চন্দ্র বড়ুয়া, দেবকীকুমার বসু প্রমুখ।
সিনেমার পাশাপাশি দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন মঞ্চে। ১২০০ রাত্রির বেশি সময় ধরে চলেছিল নাটক 'নহবত'। উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন শ্রুতিনাটকেও। আকাশবাণীতে তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন 'শুকসারী' নাটকে।
গ্রামের বাড়িতে খুবই জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো হত। আত্মজীবনী 'আমি' বইয়ে বিকাশ লিখেছেন, "আমাদের গ্রামে আমাদের বাড়ির দুর্গাপূজার সময়, বাবা থিয়েটার দল গড়লেন।..... বাড়িতে ছেলেদের সঙ্গে গ্রামের শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত ছেলেদের নিয়ে জোরদার দল হল।" স্বভাবতই অভিনয়ের স্পৃহা বাবার কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন। বাবা ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড় বন্ধু, সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের দিন হার্ট আ্যটাকে বাবা মারা যান। তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন, "বাবার মৃত্যু আমাকে দিশাহারা করেছিল।"
একবার 'রাজা সাজা' ছবির শুটিং-এর জন্য গ্রাম্য পরিবেশ প্রয়োজন। গ্রাম্যজীবনে সমৃদ্ধ গঙ্গার সন্নিকটে নিজের গ্রাম প্রিয়নগরকেই বেছে নিলেন শুটিং স্পট হিসাবে। উত্তমকুমারকে নিয়ে আউটডোর শুটিং। খবর চারদিকে চাউর হয়ে গিয়েছে। মহানায়ক উত্তমকুমার এলেন প্রিয়নগরে। গুরুকে দেখার জন্য আশেপাশের গ্রাম, কাঁচরাপাড়া, নৈহাটি, চাকদা থেকে শ'য়ে শ'য়ে হাজারে হাজারে ভক্তের স্রোত, আবার তাদের মধ্যে পাল পাল মেয়ে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।
দূর থেকে উত্তমকুমার বার দুয়েক ভক্তদের দেখা দিলেন। কিন্তু অতি উৎসাহী পাবলিক খুব কাছ থেকে উত্তমকুমারকে দেখতে চায়। একটু স্পর্শ করতে চায়। শেষমেষ উত্তমকুমারের নিরাপত্তার খাতিরে একপ্রকার বাধ্য হয়ে পুরো প্রোডাকশন টিম টাকিতে পরবর্তী শ্যুটিং করে। এই ঘটনায় বিকাশ খুব মর্মাহত হন। বিকাশের খুব ইচ্ছে ছিল, পৈতৃক বাড়িটিকে এক স্টুডিয়ো বানানোর। কিন্তু সে দিনের ঘটনায় তাঁর সমস্ত সাধ ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
অতি ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝেমধ্যেই বিকাশ গ্রামের বাড়িতে আসতেন। কিন্তু এই ঘটনার পর রাগে, দুঃখে, অভিমানে তার পর তিনি মাত্র এক বার তাঁর প্রিয় গ্রামে আসেন, ভাইপো সুদিনের বিয়ে উপলক্ষে। তাঁর উপস্থিতিতে বিয়ের অনুষ্ঠানে বিঘ্ন না ঘটে সে জন্য বিয়ের কিছু দিন আগে দেশের বাড়িতে ঘুরে যান। এটাই তাঁর শেষ আসা।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিকাশ রায় ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে দেন। দুই দুইবার তিনি নিজের বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হন। প্রথম বার বাড়ির ভিত পুজোর দিন ছেলে সুমিতের অতি প্রিয় পোষা কুকুর মারা যায়। বাড়ি তৈরি স্থগিত হয়ে যায়। কয়েক বছর পর দ্বিতীয় বার বাড়ির ভিত্তিস্থাপনের দিনে শাশুড়ির হঠাৎ মৃত্যু তাঁকে বাড়ি তৈরি থেকে বিরত করে। পরবর্তীতে আর তাঁর নিজের বাড়ি করা হয়ে ওঠেনি। ভাড়া বাড়িতেই বাকী জীবন কাটিয়ে দেন। মেধাবী ছেলে সুমিত রায় বর্তমানে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত ।
বিকাশ ছিলেন পরিবারঅন্ত প্রাণ। দায়িত্ববান বাবা। সহজ অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছেন। আহ্নিক দিয়ে তাঁর সকাল শুরু হত। অতি স্বল্পাহারী ছিলেন। অবসর সময় তাঁর বিভিন্ন বই পড়ে কাটত। ঘরে ছিল বই-এর আলমারি, তাতে পুরাণ, উপনিষদ, মহাভারত, রামায়ণ ও আরও নানা রকম বই। তিনি লিখতে ভালবাসতেন।
তাঁর আত্মজীবনী 'মনে পড়ে', 'আমি' ও 'কিছু ছবি কিছু গল্প'। শেষজীবনে প্রিয়তমা কন্যা নন্দিনীকে মারণরোগ ক্যানসার ছিনিয়ে নেয়। মেয়ের অকাললবিয়োগে তিনি খুবই ভেঙে পড়েন এবং মেয়ের মৃত্যুর এক বছর পর ১৬ এপ্রিল, ১৯৮৭ সালে ৭১ বছর বয়সে এই প্রতিভাশালী অভিনেতার জীবনাবসান হয়। বাংলা অভিনয় জগতে এক মহীরুহের পতন হয়।
বড় আক্ষেপের কথা, জীবিত অবস্থায় এই প্রতিভাবান শিল্পী উপযুক্ত কোনও সরকারি স্বীকৃতি বা পুরস্কার পাননি। এক বার উল্টোরথ নামে এক সিনেমার পত্রিকা বিকাশ রায়কে বিশেষ সম্মানে সম্মানিত করেছিল। এ প্রজন্মের কাছে বিস্মৃতপ্রায় অভিনেতা বিকাশ রায়ের প্রতি আমরা সত্যিই উদাসীন, নিস্পৃহ। সময়ের অন্তরালে অতি অবহেলা ও উদাসীনতায় বিকাশের স্মৃতিবিজড়িত পৈতৃক বাড়িটির সলিলসমাধি ঘটেছে। পারিবারিক, সরকারি, বেসরকারি কোনও স্তরে এই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। রায় পরিবারের কেয়ারটেকার সুজিত হালদার ও তাঁর স্ত্রী ছায়া সাপখোপ, ঝোপঝাড়ে ভর্তি জায়গায় একটা চালা ঘর করে বিকাশের পৈতৃক ভিটামাটি বুক দিয়ে আগলে পড়ে আছেন।
(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)
তথ্যঋণ:
১। কিছু স্মৃতি কিছু কথা: বিকাশ রায়
২। সুদিন রায়
ইংরেজি শিক্ষক, শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy