ছবিগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে। যেমন ভাসছে কলেজ স্ট্রিটের জলে রঙিন প্রচ্ছদের স্কুলপাঠ্য অঙ্কবই, চাকরির পরীক্ষার বই, অদূরে হয়তো ভাসছেন শরৎচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ! প্রকৃতির ফেরে যে প্রণম্য কথাশিল্পীরাও অ-পাঠ্য হবেন, কেউ ভেবেছিল!
স্কুলের এক মাস্টারমশাই বলতেন, ‘জলকষ্ট’ শব্দটা দুমুখো। জল না থাকাটাও জলকষ্ট, অতিরিক্ত থাকলেও জলকষ্ট। আমপান দুটোই এনেছে। কলকাতায় মানুষের হাহাকার, জল নেই বলে। দুই চব্বিশ পরগনায় বিলাপ, নোনা জলে ভরে গেছে চাষজমি, মাছের ভেড়ি। দু’পশলা ঢাললেই কলেজ স্ট্রিটে জল হাঁটু ছাড়িয়ে উঠতে চায়, ২৮৩ বছরের মধ্যে কুখ্যাততম ঘূর্ণিঝড় সেখানে কী ছিনিমিনি খেলবে, ঠিক অনুমান করলেও কোনও পুরস্কার নেই। প্রাইজ়ের বইগুলোও যে নষ্ট হয়ে গেছে!
এশিয়ার সবচেয়ে বড় বইবাজারের সমূহ সর্বনাশ সংবাদ শিরোনামে। জলে ভাসছে রাশি রাশি বই, দোকানের সামনে হতবুদ্ধি বই-বিক্রেতা বা প্রকাশক— ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস আর কান্না চাপছেন বইপ্রেমীরা। ঘরহারা মানুষ উড়ে যাওয়া টিন ফের কুড়িয়ে আনেন, তক্তা কাঠ আর খড় রোদে শুকিয়ে নেন যদি ব্যবহার করা যায়। কিছু কাজে আসে, কিছু ফেলে দিতে হয়। জলে ভিজে লেপ্টে যাওয়া অক্ষর কি ব্যবহারযোগ্য? কেউ কিনবেন? টিভির পর্দায় এক বইবিক্রেতার মুখ, বলছিলেন, কাঁড়ি কাঁড়ি বই ভিজে ফুলে গিয়ে লেপ্টে এমন অবস্থা, শাটার তোলা যাচ্ছে না। এক বিক্রেতা আধভেজা বই রাস্তায় শুকোতে দিয়েছেন রোদে, আর একশো-দেড়শো কিলো বই স্রেফ ফেলে দিয়েছেন। একশো-দেড়শো কিলো! মানুষ মারা গেলে ‘বডি’ হয়ে যায়, বই মরে গেলে ‘কিলো’ হয়ে যায় বুঝি!
বইপাড়া শুধু বড় প্রকাশনা সংস্থারই নয়, বহু ছোট প্রকাশকেরও ঠিকানা। অধিকাংশ বইপ্রেমীই মূলত সাহিত্যবইয়ের ক্ষতিতে উদ্বিগ্ন, কিন্তু তারও বাইরে আছে সেই প্রকাশনাগুলো, যারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই বা চাকরির পরীক্ষার বই ছাপে, বিক্রি করে। কলেজ স্ট্রিটের দু’পাশে, কলকাতা বা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া গলিগুলোয়, সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’পাশের রাস্তায় ছোট ছোট বই-দোকানগুলোর কথা ভাববেন না? কয়েক বর্গফুটে অধিষ্ঠান লক্ষ লক্ষ টাকার বইয়ের, ঢাকা থাকে স্রেফ কাঠের পাটাতন বা ত্রিপলে। আর পুরনো বইয়ের সেই আশ্চর্য দোকানেরা— ‘লেডি চ্যাটার্লিজ় লাভার’ থেকে জেমস হেডলি চেজ়, ‘লোলিটা’ থেকে ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ ছুঁয়ে আমাদের বড় হয়ে ওঠার ইতিহাসটাকে আদরে রূপকথার মতো সাজিয়ে দিয়েছিল যারা— তারা? কোচবিহার থেকে এক বন্ধু খোঁজ নিচ্ছিল কলেজ স্ট্রিটের নিতান্ত সাদামাটা এক দোকানের, যে জাতে উঠতে পারেনি কোনও কালে। তবু সেই দোকানের সঙ্গেই তার চিরন্তন সখ্য, ওখান থেকে চাকরির পরীক্ষার বই কিনে পড়েই তার জীবনের প্রথম চাকরি! বই তো ছাপার কালি মুদ্রিত অক্ষর আর বাঁধাই নয় শুধু, বইয়ের দোকান একটা মানসিক ‘স্পেস’, বইপাড়া স্মৃতি-সত্তার একটা অংশ। বইপাড়ার ফুটপাত বা পুরনো বইয়ের গুমটি দোকানে আচম্বিতে প্রিয় লেখকের স্বাক্ষরিত একটা বই, কোনও বইয়ের অমূল্য প্রথম সংস্করণ বা লিটল ম্যাগাজ়িনের একটা বহু-আকাঙ্ক্ষিত বিশেষ সংখ্যা ‘আবিষ্কার’ করার সর্বাঙ্গে মিশে থাকে যে শিহরন, তা আর কে-ই বা দিতে পারে? ছোটবেলায় ব্যাকরণ বইয়ে পড়তে হত প্রায় সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ, ‘আপণ’ আর ‘আপন’। বইকে ভালবেসে কষ্ট পান যাঁরা, তাঁদের কাছে দুটোই সমার্থক।
করোনার কারণে লকডাউনের জেরে এমনিতেই দু’মাস ঝাঁপ বন্ধ। বইয়ের পাশে ‘ব্যবসা’ শব্দটা যতই অনান্দনিক শোনাক, বইপাড়া ও বইকে ঘিরেই যে লক্ষ মানুষের জীবিকা, রোজগার আর ঘর-সংসার আবর্তিত হয়, তা নিয্যস সত্য। সেই আয় বন্ধ অনেক দিনই। ছাপাখানার কর্মী, প্রুফরিডার, বাঁধাইকর্মী, বই-বাহক থেকে শুরু করে এই ব্যবসাক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অগণিত মানুষ কর্মহীন। ঘোষিত লকডাউনের অন্তিম পর্বে ডাক-কুরিয়ার যোগে বা বিকল্প ব্যবস্থায় টুকটাক বই বিক্রি সবে শুরু হয়েছিল। পাঠক ও প্রকাশকেরা সমাজমাধ্যমে ভাবনার বিনিময় করছিলেন, কী করে আবার সব শুরু করা যায়। একটা ঝড় এসে শুধু বইপাড়াই নয়, সে-সব ভাবনাও তছনছ করে দিল। নষ্ট হয়েছে প্রেস বা গুদামে থাকা ছাপা কাগজ, ছাপার কাগজ, বাঁধাই সামগ্রী, আনুষঙ্গিক কাঁচামাল। পেনসিল-কলম-ফাইল-ফোল্ডার সহ লেখালিখির সরঞ্জামের দোকানও কম নয়, তাদেরও ক্ষয়ক্ষতি বিরাট। স্কুলপড়ুয়াদের নতুন পাঠ্যবই সব ছাপা হয়ে পড়ে ছিল দোকানে, করোনা-উত্তর কালে ছাত্রছাত্রীদের সেই বই জুটবে তো?
ফের শূন্য থেকে শুরু। গতকাল থেকে বইপাড়া খুলেছে। কিন্তু লকডাউন এখনও বহাল, গণপরিবহণ এখনও বন্ধ। দূরদূরান্ত থেকে কলেজ স্ট্রিটে আসেন যে বই ব্যবসায়ী, দোকানদার ও কর্মীরা, তাঁরা কী করে আসবেন, গোছাবেন সব, আবারও শুরু করবেন কাজ? বই কিনবেন যাঁরা, তাঁরাই বা পৌঁছবেন কী করে? বইপাড়া খোলার খবর খুবই আনন্দের, তবু তার গায়ে এখনও অনেকগুলো প্রশ্নচিহ্ন লেগে।
আমপানে ধ্বস্ত দুই চব্বিশ পরগনার শিক্ষার্থীদের বইখাতার প্যাকেজের কথা উঠেছে প্রশাসনিক বৈঠকে। সেই বইখাতার জোগান দেবেন যাঁরা, সেই মুদ্রক-প্রকাশক-ব্যবসায়ীদের কথা ভাবা দরকার এই মুহূর্তে। ভাবা দরকার— যেমন জরুরি বিদ্যুৎ জল ফসলের রক্ষা, তেমনই বইয়েরও। বুকসেলার্স ও পাবলিশার্স গিল্ড মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীকে, বিদেশের দূতাবাসগুলোর কাছে চিঠি দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বই-বিক্রেতা ও প্রকাশকদের পাশে দাঁড়াতে আলাদা ত্রাণ তহবিল গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বইপাড়ার ব্যবসায়িক সুরক্ষায় কোনও কোনও প্রকাশনা নিজস্ব উদ্যোগ করছে। বইপ্রেমীরা ফেসবুকে বলছেন, আমরা বই কিনব, বিনা ছাড়েই কিনব, অল্প ক্ষতি হওয়া বইও। এ যেন আর্নস্ট হেমিংওয়ের উপন্যাসে বুড়ো জেলে সান্টিয়াগোর জীবনবেদ: মানুষকে ধ্বংস করা যেতে পারে, তবু সে পরাজিত হবে না।
বইও তো তাই, না কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy