Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Dwijendralal Ray

বাঙালির প্রাণের জিনিসের প্রতি আমাদের উদাসীনতা কাটবে?

তিনি জীবনে ও সাহিত্যে ছিলেন স্পষ্টবাদী খোলামেলা। যা অল্প দিনে দ্বিজেন্দ্রলালের বিপুল জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। আবার, এই স্পষ্টবাদী ভাবনার জন্যেই এক সময়ের পরম বন্ধু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিরোধের সূচনা। ১৭ মে তাঁর মৃত্যুদিন পেরিয়ে লিখলেন সুব্রত পাল ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে কার্তিকেয়চন্দ্র বারুইহুদা থেকে পাকাপাকি এখানে বসবাস করতে আসেন।

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২০ ০২:২৬
Share: Save:

দেশ জুড়ে করোনা মহামারির বিপুল তোলপাড় শুরু হওয়ার মাসখানেক আগে গত ফেব্রুয়ারির এক শেষ বিকেলে ফিরছিলাম কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগর স্টেশন হয়ে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে অটোয় রেললাইনের সমান্তরাল জ্যাম-জটিল রাস্তা ধরে চলতে চলতে চোখে পড়ছিল দু’পাশের চাপ-বাঁধা অজস্র দোকান, বাড়িঘর। দ্বিজেন্দ্র পাঠাগার পেরিয়ে মনে পড়ল বাঁ দিকের দ্বিজেন্দ্র-ভিটের তোরণ-দ্বারের স্তম্ভদু’টির কথা। এখনকার কৃষ্ণনগরে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শেষতম স্মারক। ভিড় রাস্তা, দোকানপত্তরের ফাঁকে সামান্যই দৃষ্টিগোচর হল। এই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আগেও অনেক বার ভাবার চেষ্টা করেছি আমি ওই তোরণের ভিতরে আজকের এই অতি ব্যস্ত রেল রোড, সারি সারি দোকান-পসরা, তার পিছনের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে দ্বিজেন্দ্রলালের বাবা দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্রের নিশ্চিহ্ন হওয়া বিশাল বাগানঘেরা বাড়িটিকে।

আমার দুর্বল কল্পনাশক্তি বরাবর ব্যর্থই হয়েছে।

১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে কার্তিকেয়চন্দ্র বারুইহুদা থেকে পাকাপাকি এখানে বসবাস করতে আসেন। যেখানে একদা কার্তিকেয়র গানের টানে বিদ্যাসাগর, মাইকেল, দীনবন্ধু মিত্র, রামতনু লাহিড়ীর মতো বিশ্রুত জনেরা এসে আসর জমিয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রলালের শিশু বয়সের স্মৃতিচারণায় তাঁর সেজদা জ্ঞানেন্দ্রলাল লিখেছিলেন— ‘‘আমাদের সেই নগর প্রান্তস্থিত উদ্যান— অস্তগামী সূর্য্যের রাঙ্গা আভায় গাছের পাতা রাঙ্গা হইয়াছে।... একটী ক্ষুদ্র বালক কখন বা ফল তুলিতে দুলিয়া দুলিয়া দৌড়িতেছে, কখন বা পাখীর পিছনে ছুটিতেছে। বাগানী কাজ করিতেছে। সম্মুখে গৃহস্বামী দণ্ডায়মান, সেই দেবমূর্ত্তির কনককান্তিতে উদ্যানের শোভা যেন আরও ফুটিয়াছে। এই ক্ষুদ্র বালক দ্বিজেন্দ্র। গৃহস্বামী তাঁহার পিতা।’’ ‘নবদ্বীপাধিপতি’ রাজাদের দেওয়ান বংশের উত্তরপুরুষ, বহুভাষী, সুলেখক, সর্বোপরি সে কালের হিন্দুস্থানী গানের নামজাদা ওস্তাদ কার্তিকেয় চন্দ্রের ছিল সাত ছেলে ও এক মেয়ে। এই সাত ভাই চম্পার সর্বকনিষ্ঠ ভাইটি দ্বিজেন্দ্রলাল। জন্ম ১৮৬৩ ক্রিস্টাব্দের ১৯ জুলাই, কৃষ্ণনগরে। বাড়িতে সকলেই বিদ্বান ও গুণিজন। সংগীতজ্ঞ বাবার গান শুনতে শুনতেই শিশু দ্বিজেন্দ্র সেগুলি হারমোনিয়ামে তুলে ফেলতেন। বড়দের ভাবভঙ্গি নকল করার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে এক বার বিদ্যাসাগর নাকি বলেছিলেন— ‘‘আমি নিশ্চিত বলছি— এ বালক একদিন বড়োলোক হবে।’’ ‘বড়লোক’ যে হয়েছিলেন তিনি, তা আমরা জানি। বিদ্যায়, গুণে, তেজস্বিতায়।

প্রেসিডেন্সি কলেজের অত্যুজ্জ্বল ছাত্র, কৃষিবিদ্যা শিখতে বিলেত গিয়ে চুটিয়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেক্সপিয়ার পড়তে পড়তে ইংরেজিতে কবিতা লিখে বিখ্যাত হওয়ার শখ জেগেছিল। ‘লিরিকস অফ ইন্ড’ নামে কবিতার বই প্রকাশ করে প্রশংসিতও হয়েছিলেন। কিন্তু সাহেবি কেতাদুরস্ত ডি. এল. রায় সাহেবভক্ত যে হতে পারেননি, তা বোঝা যায় তাঁর সে সময়কার লেখায়— ‘‘‘ইংরাজদিগের এই অর্দ্ধসিদ্ধ মাংস ভক্ষণ আমি তাহাদের ভূতপূর্ব বর্বরতার পরিশিষ্ট বলিয়া মনে করি। বাঙ্গালীর এই প্রকার সুপক্ব ব্যঞ্জনাদি আহার তাহাদিগের ভূতপূর্ব সভ্যতার অকাট্য প্রমাণ।’’

কিন্তু দেশে ফেরার পর এই বাঙালি সমাজেই বিলেতফেরত দ্বিজেন্দ্রলালকে একঘরে করা হলে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে হিন্দুসমাজকে তুলোধোনা করে ‘একঘরে’ নামে বই লেখেন। যার ভাষা তাঁর নিজের কথায়— ‘‘অন্যায়ক্ষুদ্ধ তরবারির বিদ্রোহী ঝনৎকার... পদদলিত ভুজঙ্গমের ক্রুদ্ধ দংশন।’’ অন্য দিকে, ব্রিটিশ সাহেবদের সঙ্গে আচরণে তাঁর নেটিভসুলভ বিনয়ের অভাব থাকায় যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাননি শুধু নয়, ছাব্বিশ বছরের চাকরি জীবনে কিছু দিন পরে পরেই ভারতের নানা জায়গায় ক্রমাগত বদলি হয়ে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে।

উনিশ বছর বয়সে তাঁর গানের বই ‘আর্য্যগাথা’র প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল। এক দশকেরও বেশি ব্যবধানে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে ‘আর্য্যগাথা’ দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। বলা যায়, এই বই থেকেই পরিণত দ্বিজেন্দ্রলালের প্রকৃত সঙ্গীত ও সাহিত্যজীবনের শুরু। স্ত্রী সুরবালা দেবীর সঙ্গে সুখী দাম্পত্য জীবনের প্রেমপূর্ণ ছায়াপাত ঘটেছে এই সব গানে। কিন্তু সমাজের ভন্ডামি, কুসংস্কার, হীনতা-শঠতার প্রতি তাঁর ক্ষোভ সূক্ষ্ম ভাবে গভীরে বাসা বেঁধেছিল। তাঁর হাসির গান এবং প্রহসনগুলো তারই ফলশ্রুতি। হিন্দু, ব্রাহ্ম, বিলেত-ফেরত সকলেই তাঁর ব্যঙ্গের কশাঘাতে বিদ্ধ হয়েছে।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে সুরবালা দেবীর আকস্মিক মৃত্যুর অভিঘাত এবং দুটি ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে মন্টু (দিলীপকুমার) ও মায়াকে নিয়ে নাজেহাল অবস্থার মধ্যেই শুরু করেছিলেন গদ্য-সংলাপে ঐতিহাসিক নাটক রচনা। প্রথমে ‘প্রতাপসিংহ’। অতঃপর ‘দুর্গাদাস’, ‘নূরজাহান’, ‘মেবার পতন’, ‘সাজাহান’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’ প্রভৃতি প্রবাদপ্রতিম নাটকগুলো বাংলা নাট্য-সাহিত্যে ও মঞ্চে নতুন ভাব, নতুন ভঙ্গি, নতুন প্রেরণা সঞ্চারিত করেছিল। খুব সচেতন ভাবেই এগুলোতে ক্রিয়াশীল থেকেছে তাঁর স্বদেশবোধ। ‘মেবার পতন’ নাটকে জাতীয়তার আদর্শ আন্তর্জাতিকতা বোধে উত্তীর্ণ হয়েছিল। এ সম্পর্কে নিজেই লিখেছিলেন— ‘‘এই নাটকে ইহাই কীর্ত্তিত হইয়াছে যে বিশ্বপ্রীতিই সর্ব্বাপেক্ষা গরীয়সী।’’ অনেকেরই মনে পড়বে সেই গান— ‘ভুলিয়া যা রে আত্ম-পর,-- পরকে নিয়ে আপন কর,/বিশ্ব তোর নিজের ঘর,--আবার তোরা মানুষ হ’।

তবে দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকৃত অর্থে ছিলেন গানের মানুষ। উনিশটি প্রহসন ও নাটকে প্রায় আড়াইশো গান ব্যবহৃত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও হয়তো বিশ্বাস করতেন তাঁর সমস্ত রচনাকালের গভীরে হারিয়ে গেলেও গানগুলো থেকে যাবে। সংগীতজ্ঞ পুত্র দিলীপকুমারকে বলেছিলেন—‘‘আমাকে কি রবিবাবুকে (বাঙালি) ভুলে যাবে না।... আমরা রেখে যাচ্ছি যা বাঙালির প্রাণের জিনিস— সুরে বাঁধা গান। আমি যে কী সব গান বেঁধে গেলাম সেদিন তুইও বুঝবিই বুঝবি।’’

তিনি জীবনে ও সাহিত্যে ছিলেন স্পষ্টবাদী খোলামেলা। যা অল্প দিনে দ্বিজেন্দ্রলালের বিপুল জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। আবার, এই স্পষ্টবাদী ভাবনার জন্যেই এক সময়ের পরম বন্ধু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিরোধের সূচনা। যার পরিণামে এক সময় বাংলা সাহিত্য দ্বিজু রায় ও রবি ঠাকুরের নামে দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ সাত বছর পর এই বিরোধমূলক চাপান-উতোরের সমাপ্তি হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আনন্দ বিদায়’ নামে প্যারোডি নাটক রচনা এবং তার ফলে রবীন্দ্রপ্রেমী দর্শক-পাঠকদের কাছ থেকে প্রচুর নিন্দামন্দ কুড়িয়ে।

অবশ্য এই ঘটনার মাত্র মাস ছয়েকের মধ্যেই তাঁর জীবনাবসান হয়। তাঁকে মুঙ্গেরে বদলি করা হয়েছিল। প্রবল অসুস্থতার জন্য স্বেচ্ছাবসর নিলেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে বিকেলে হঠাৎ ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে দুই দিকপাল বন্ধুর পুনর্মিলনের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। বিদেশ থেকে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতি আস্থা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দ্বিজেন্দ্রলালও তার উত্তর লিখেছিলেন। কিন্তু সে চিঠি রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছোয়নি। তাঁর আকস্মিক অসুস্থতায় দিশেহারা বন্ধু-স্বজন তাঁর মাথায় এত জল ঢেলেছিলেন যে, তাতে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে সেই চিঠিটি ভিজে সব লেখা ধুয়ে যায়, কেবল ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামটি কোনও ক্রমে রক্ষা পেয়েছিল।

সব সত্ত্বেও দুই বন্ধু যে পরস্পরের প্রতি আজীবন শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তার সাক্ষ্য আছে বাংলা সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য জীবন দীর্ঘ, ব্যাপ্তি বিরাট। সে তুলনায়, ঠিক ভাবে দেখলে, দ্বিজেন্দ্রলালের সাহিত্যজীবন মাত্র দুই দশকের। সেই স্বল্পকালেই, রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি থেকেও প্রতিভার স্বতন্ত্র বিচ্ছুরণে, ব্যাপক জনপ্রিয়তায় নিজেকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর অব্যবহিত পর থেকেই সেই প্রবল ব্যক্তিত্বের সামগ্রিক বিস্মরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার পর আজ, অনেকের কাছে দ্বিজেন্দ্রলাল কেবল নদিয়া জেলার কবি।

তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বাংলা মঞ্চে তাঁর দু’একটি নাটকের দীর্ঘকালীন অভিনয়ের নব্য-ইতিহাস রচিত হতে দেখা যাচ্ছে। নিজের যে গানকে ‘বাঙালির প্রাণের জিনিস’ বলে ভেবেছিলেন কবি, তার প্রতি উদাসীনতা কবে কাটবে আমাদের?

অন্য বিষয়গুলি:

Dwijendralal Ray Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy