Advertisement
E-Paper

র‌্যাঙ্কিং নামে নতুন সাপ-লুডো

এক একটি সংস্থা কিন্তু তাদের নিজেদের মতো করে বিষয়বস্তু ঠিক করে নেয় এই র‌্যাঙ্কিংয়ের জন্য। তাতে ‘ওয়েটেজ’ বা গুরুত্বও দেওয়া হয় ইচ্ছেমতো।

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৩৮
Share
Save

এক মালয়েশীয় বন্ধুর ইমেল পেলাম। বিশ্ব-র‌্যাঙ্কিংয়ের এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁরা আমার নাম দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রম বানাবার সংস্থাটির কাছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণমান সম্পর্কে মতামত দিতে। তাই অনুরোধ, যাতে ভাল মতামত দিই তাঁদের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে। এমনই অনুরোধ এসেছে এক স্পেনীয় গবেষকের কাছ থেকেও। স্পষ্টতই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‍র‌্যাঙ্কিংয়ের খেলায় সংখ্যাতত্ত্ববিদের মতামতের জন্যও নম্বর ধরা আছে। সেই নম্বর প্রভাবিত করা যায়, করা হয়ও। ইঁদুর-দৌড়ের ফিনিশিং লাইনে পৌঁছে অনুদান ইত্যাদির সঙ্গে আত্মশ্লাঘাও লাভ করে দেশবিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। সর্বত্র এই ছবি।

এক একটি সংস্থা কিন্তু তাদের নিজেদের মতো করে বিষয়বস্তু ঠিক করে নেয় এই র‌্যাঙ্কিংয়ের জন্য। তাতে ‘ওয়েটেজ’ বা গুরুত্বও দেওয়া হয় ইচ্ছেমতো। বিষয়ের বদল ঘটলে, বা ওয়েটেজ পরিবর্তিত হলে, র‌্যাঙ্কিংও বদলায়। সম্প্রতি প্রকাশিত তালিকায় দেশের মধ্যে প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান যথাক্রমে কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পেলেও আন্তর্জাতিক তালিকায় তাদের স্থান যথাক্রমে আটশো ও সাড়ে ছ’শোর নীচে।

আজকের পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ের বিশ্ব-সামাজিক প্রভাব বেশ চড়া। এই খবর কাগজে ছাপা হলে, তা নিয়ে বিস্তর তরজা হয়। বিশ্বের প্রথম দু’শো বা পাঁচশোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দেশের ক’টা এল বা বেরিয়ে গেল, তা নিয়ে এমনকি চায়ের দোকানেও আড্ডা জমে। টিভির চ্যানেলে গম্ভীর বিতর্কে যোগ দেন বিশেষজ্ঞরা। র‌্যাঙ্কিং একটু ভাল হলে যেন দেশের ‘শিক্ষার একেবারে হদ্দমুদ্দ’। আর খারাপ হলে যেন শিক্ষাব্যবস্থাটাই রসাতলে, ‘গেল গেল’ রব ওঠে চার ধার থেকে। এমনকি স্থির হয়েছে যে, দেশের আইআইটিগুলির প্রতিনিধিরা নাকি একটি র‌্যাঙ্কিংকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সঙ্গে তাদের র‌্যাঙ্কিংয়ের ‘স্বচ্ছতা’ নিয়ে আলোচনায় বসবেন। এতটাই গুরুত্বপূর্ণ এই ক্রম-তালিকা?

এ সব নিয়ে আলোচনার আগে এক বার ভাবা যাক, বিশ্ববিদ্যালয়টা ঠিক কী বস্তু। ১৮৫২ সালে ব্রিটিশ পাদ্রি জন হেনরি নিউম্যান বিশদে লিখেছিলেন তাঁর বই ‘দি আইডিয়া অব আ ইউনিভার্সিটি’। সেই চিন্তাধারার আবর্ত থেকে আজকের বিশ্ববিদ্যালয় সরে এসেছে অনেকটাই। নালন্দা, বিক্রমশীলার সঙ্গে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তর পার্থক্য। আজকের দুনিয়া অনেকটা ছকে বাঁধা, ফলাফল-নির্ভর। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনও অনেকটাই চাকরি-কেন্দ্রিক। তবু, এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা— এ এমন এক শিক্ষাক্ষেত্র যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয় জ্ঞানার্জনে। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথও বলছেন, “সমস্ত সভ্যদেশ আপন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে জ্ঞানের অবারিত আতিথ্য করে থাকে।” আসলে কেবলমাত্র জীবিকার হদিস দেওয়াটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য নয়, এক সংস্কারহীন জ্ঞানচর্চার যত্ন, বিকাশ, প্রকাশ ঘটানোর সঙ্গে শিক্ষার্থীর সুপ্তজ্ঞান এবং জ্ঞানার্জনের অভীপ্সা জাগিয়ে তোলা, বিবেচনাবোধের উন্মেষ ঘটানোই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব। এ দিকে এরই মধ্যে এসে গেল র‌্যাঙ্কিং করার সংস্থাগুলি। ভাল ক্রমসংখ্যা পাওয়ার তীব্র প্রতিযোগিতা বিশ্বজুড়ে। কী দেখা হয় এই সব বিচার-পদ্ধতিতে? শিল্প-ক্ষেত্র থেকে কতটা আয় করতে পারল বিশ্ববিদ্যালয়, অধ্যাপকদের গড় আয় কত, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কত, কত অনুপাতে বিদেশি ছাত্র বা অধ্যাপক রয়েছে ইত্যাদি অনেক কিছুই রয়েছে তালিকায়, যার অনেকটাই আবার নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন-কানুন এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক বিন্যাসের উপরে। এমনকি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কিংবা প্রাক্তনী নোবেল অথবা ফিল্ডস মেডেল পেলে, ‘নেচার’ কিংবা ‘সায়েন্স’-এর মতো জার্নালে গবেষণাপত্র ছাপালেও ক্রম-তালিকায় তরতর করে উঠবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি। কত জন ছাত্র ডিগ্রি পাচ্ছে বা কত জন পিএইচ ডি করছে, তারও গুরুত্ব রয়েছে র‌্যাঙ্কিংয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর যত বড় হবে, ততই সুবিধে। ছোট কিন্তু কার্যকর প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়বে এই ঘোড়দৌড়ে।

র‌্যাঙ্কিংয়ে দেখা হয় গবেষণাপত্রের ‘সাইটেশন’ বা অন্য গবেষকদের দ্বারা উল্লেখের সংখ্যাও। কিন্তু, মজার কথা, এই ‘সাইটেশন’-কে অনেকেই গবেষণাপত্রের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে একটি ভ্রান্ত সূচক বলে মনে করেন। আবার গবেষক-পিছু গবেষণাপত্রের সংখ্যাও র‌্যাঙ্কিংয়ে গুরুত্ব পায়। আপাতদৃষ্টিতে এটা হয়তো যুক্তিযুক্তই। আজকের পৃথিবীতে গবেষণার পরিমাপের সূচকই দাঁড়িয়ে গিয়েছে গবেষণাপত্রের সংখ্যা। সে ক্ষেত্রেও আবার গুরুত্ব পেয়ে চলেছে বিভিন্ন সংস্থার করা জার্নালের ক্রম-তালিকা। ‘সাইটেশন ইন্ডেক্স’-এর ভিত্তিতে করা সেই সব তালিকায় উপরের দিকে থাকা জার্নালে গবেষণাপত্র ছাপালে তার গুরুত্ব বাড়ে। তাই গবেষণাপত্র ছাপানোটাও যেন কাক্কেশ্বর কুচ্কুচের এক হিসেব-নিকেশের কাটাকুটি খেলা।

পিটার হিগ্‌সের নামটা আমাদের দেশে বেশ পরিচিত। ২০১৩-তে নোবেল পেয়েছেন পদার্থবিদ্যায়। বিশ্ববিখ্যাত তাঁর ‘হিগ্‌স বোসন’-এর জন্য। সত্যেন বোসের সঙ্গে নাম জড়িয়ে রয়েছে তাঁর। হিগ্‌স বিশ্বাস করেন যে, আজকের মানদণ্ডে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি দেবে না তাঁকে। কারণ তিনি যথেষ্ট কর্মক্ষম বা উৎপাদনশীল হিসেবেই বিবেচিত হবেন না। আজকের দিনে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই বছরে এক-দু’বার সমস্ত অধ্যাপকের কাছে তাঁদের সাম্প্রতিক ছাপানো গবেষণাপত্রের তালিকা চায়, পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়নের জন্য। অতীতে যখনই এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় তালিকা চেয়েছে হিগ্‌সের কাছে, প্রতি বারই তিনি লিখে পাঠিয়েছেন, ‘নেই’। আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো কিন্তু এক জন ভবিষ্যৎ নোবেল-বিজেতাকেও নিয়ম করে প্রায়-অর্থহীন গবেষণাপত্র না ছাপিয়ে নিশ্চিন্তে তাঁর পড়াশোনা এবং গবেষণাটুকু করতে দেবে না। আজকের অ্যাকাডেমিক দুনিয়াতে এসে গিয়েছে এক নতুন মন্ত্র: “পাবলিশ অর পেরিশ”, হয় ছাপিয়ে চলো, নইলে ধ্বংস হয়ে যাও। গবেষণাপত্র ছাপানোর এই ভয়ঙ্কর এবং অবাস্তব চাপের অনিবার্য ফল হল আরও বেশি সংখ্যক আগাছার মতো জার্নাল গজিয়ে ওঠা, এবং অসংখ্য মূল্যহীন গবেষণাপত্রের প্রতিনিয়ত ছাপা হয়ে চলা। গোটা বিশ্বই এই আবশ্যিক, কিন্তু অর্থহীন, গবেষণার ভারে হাঁসফাঁস করছে। এতে গবেষণার মান বাড়েনি এতটুকু। বরং ক্ষতি হয়েছে অনেকটাই। তাৎক্ষণিক ভাবে নিম্ন-মধ্যমানের চর্বিতচর্বণ গবেষণাপত্র লেখার ঝোঁক বেড়েছে। অপচয় হচ্ছে সময়ের।

‘বিশ্ববিদ্যালয়’ কথাটা কিন্তু একই চেতনার প্রকাশ ঘটায় না পৃথিবীর সব জায়গায়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় তার অধ্যাপক আর প্রাক্তনীদের মধ্যে নোবেল বিজেতার সংখ্যা গুণে শ্লাঘা বোধ করতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর বহু জায়গায়, প্রত্যন্ত কোনায়, একটা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষার কিংবা সার্বিক অর্থে বিশ্বরূপ-দর্শনের একমাত্র উপায়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করতে হবে তার সামাজিক, ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটেই। নিজস্ব পটভূমিতে তার গুরুত্ব বা প্রভাব স্ট্যানফোর্ড কিংবা কেমব্রিজের চাইতে কম কিসে? সে কাজে সাফল্যকে ‘উৎকর্ষ’ই বলা চাই। অক্সফোর্ড আর শিকাগোর সঙ্গে তাই কুমায়ুন কিংবা বিশ্বভারতীকে এক তুলাদণ্ডে বিচার করতে বসলে মুশকিল।

অর্থাৎ এই র‌্যাঙ্কিং কুনাট্য অগ্রাহ্য করাই ভাল। এর জালে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তাদের চিরায়ত ধারণা থেকে সরে আসছে আরও বেশি করে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সুযোগ নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার কথা ভাবা যেতেই পারে। কিন্তু সেটার জন্য বৃহত্তর আলোচনা ও নীতি চাই।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট।

মতামত ব্যক্তিগত

Education Ranking Institutes

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}