বাজেটের বড় ছবিটা এখন পরিষ্কার। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি আয়বৃদ্ধি এবং শিল্পবাণিজ্যের অনুকূল একটি নীতিপ্রস্তাব পেশ করেছেন। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এখন আর একটি স্লোগানমাত্র নয়। পরিকাঠামোর জন্য অতিরিক্ত ১১০০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছেন জেটলি। এর ফলে দুনিয়া বদলে যাবে এমন নয়, কিন্তু এটা অবশ্যই ভারতীয় অর্থনীতি সচল হওয়ার প্রস্তুতি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে আপাতত বাজেটের রকমারি অঙ্ক নিয়ে বিস্তর টানাটানি চলছে, চলবে। সেই কোলাহল থেকে অনেক দূরে বরফ-জমা বস্টন শহরে বসে গত কয়েক মাস ধরে গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখে আসছি, ভারতের সম্ভাবনা নিয়ে প্রত্যাশা উত্তরোত্তর বাড়ছে। এই প্রত্যাশার কাহিনিটিকে টানটান ধরে রাখতে পেরেছেন, সে জন্য জেটলি ও তাঁর সহকর্মীরা ভাল নম্বর পেতে পারেন। বলা চলে, প্রায় সকলের জন্যই তাঁর বাজেটে কিছু না কিছু আছে— শুধু দেশের বিভিন্ন বর্গের মানুষ নয়, আমাদের মতো যে প্রবাসীরা ভারতকে এখন বিশ্ব অর্থনীতির ‘গ্রেট ব্রাউন হোপ’ মনে করে আশায় বুক বাঁধতে চাইছি, তাদের জন্যও।
একটা ব্যাপারে আমি নিজে চমত্কৃত। এই সে দিনও ভারতকে দেখা হচ্ছিল ‘ভঙ্গুর পঞ্চক’-এর অন্যতম দেশ হিসেবে, প্রতিদিন এই দেশ শিরোনামে আসছিল ধর্ষণ, দুর্নীতি, গুরুত্বপূর্ণ নানা শিল্পে প্রতিযোগিতার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলা, ইত্যাদি কারণে। দেখতে দেখতে ছবিটা পালটে গিয়েছে। মোদী সরকার প্রথম বছরে সাবধানে পা ফেলছে। এ পর্যন্ত তারা যা করেছে, এই ঘুরে দাঁড়ানোর পিছনে তার বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই। ঘটনা হল, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অবস্থা সুবিধের নয়, বিশেষ করে ‘ইমার্জিং মার্কেটস’ অর্থাত্ অর্থনৈতিক ভাবে উদীয়মান বলে পরিচিত দেশগুলির হাল বেশ খারাপ। বলা চলে, এই অবস্থায় ভারত কিছুটা শূন্যস্থান পূরণ করেছে। আসলে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা টাকা ফেলে রাখতে চান না, তাঁরা এমন একটা বাজার খোঁজেন যেখানে লগ্নি করা যায়। আজকের এই বিবর্ণ বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত তেমন একটা সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে উঠে এসেছে।
কতকগুলো ব্যাপার তাকে সাহায্য করেছে। এক, গত কয়েক মাসে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়ার ফলে ভারতের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি ডলার সাশ্রয় হয়েছে। দুই, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে সাক্ষাত্ ও কথাবার্তার ছবি এবং সংবাদ বড় করে প্রচার করে মোদী একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন। তিন, ঠিক সময় মতো ভারতের জিডিপি’র নতুন হিসেব প্রকাশ করা হয়েছে, যে হিসেবে আয়বৃদ্ধির হার অনেকটা বেশি, তার ফলে গতিভঙ্গের বিষণ্ণতা ঘুচিয়ে হঠাত্ এই দেশটি দুনিয়ার ‘দ্রুততম বৃহত্ অর্থনীতি’ রূপে বন্দিত হচ্ছে। কী করে এটা হল? ভিত্তিবর্ষ হিসেবে ২০০৪-০৫ সালের বদলে নেওয়া হয়েছে ২০১১-১২ সালকে; কর্পোরেট উদ্যোগ, পরিবারের ভোগব্যয় এবং অসংগঠিত ব্যবসার কিছু নতুন পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে; উত্পাদনের উপকরণের দামের ভিত্তিতে জিডিপি’র পরিমাণ না মেপে মাপা হয়েছে বাজারদর অনুসারে— ব্যস, এতেই আয়বৃদ্ধির হারটিকে এমন উচ্চতায় তুলে দেওয়া গেছে, যার ফলে সবাই সহসা প্রশংসায় পঞ্চমুখ: ভারতীয় কুঞ্জর চিনা ড্রাগনের চেয়ে জোরে দৌড়চ্ছে!
এ বার বাজেটের আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমে ভারতের অর্থনীতি নিয়ে তুমুল উত্সাহ ও কৌতূহলের প্রকাশ দেখেশুনে বেশ অবাকই হয়েছি। এমনকী বেশ ভারিক্কি চরিত্রের সংবাদপত্র বলে পরিচিত দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস গত ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম পৃষ্ঠার ডান দিকে সবার উপরে— সবচেয়ে মূল্যবান জায়গাটিতে— ভারতের ‘এগিয়ে চলা’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত রিপোর্ট পরিবেশন করেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে দি ইকনমিস্ট (২১-২৭ ফেব্রুয়ারি) এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটির প্রচ্ছদের গুরুত্ব কতটা, তা পত্রিকার পরিচালকরা বিলক্ষণ জানেন, সম্প্রতি সেই প্রচ্ছদে দেখা গেল একটি ভারতীয় হাতির দেহে জেট এঞ্জিন সংলগ্ন, শিরোনাম: ইন্ডিয়া’স চান্স টু ফ্লাই! বাজেট বক্তৃতায় এই প্রচ্ছদ-শিরোনামটি উল্লেখ করতে অরুণ জেটলি ভুল করেননি।
ছবি হিসেবে জেটবিমানের এঞ্জিন লাগানো হাতির জবাব নেই। কিন্তু অনেকেই হয়তো উচ্ছ্বাসের বশে একটা ছোট্ট জিনিস খেয়াল করেননি। প্রচ্ছদচিত্রে ওই জেট-কুঞ্জর এবং তার পিঠে মাহুত-রূপী মোদী ছাড়া আর একটিই জিনিস দেখা যাচ্ছে, সেটি হল একটি ‘উইন্ডসক’। একটা দু-মুখ-খোলা মোজার মতো দেখতে এই বস্তুটি হাওয়ার গতিবেগ এবং অভিমুখ বোঝার জন্য কাজে লাগে। তো ছবিতে ওই হাওয়া-মোজাটি দেখাচ্ছে যে, হাতি-বিমান যে দিকে যাচ্ছে, তার উল্টো দিকে প্রচণ্ড জোর হাওয়া, অর্থাত্ ‘হেডউইন্ড’ অতি প্রবল।
আমাকে ভুল বুঝবেন না। আকাশে হাতি উড়লে সে দিকে না তাকিয়ে হাওয়া-মোজায় মনোনিবেশ করব, আমি ঠিক সে-রকম ধাতের লোক নই। কিন্তু বাজেটের পরিকল্পনা রূপায়ণের দায়িত্ব যাঁদের উপর, তাঁরা বোধহয় ওই হেডউইন্ড-এর রহস্যটি একটু বোঝার চেষ্টা করলে ভালই করবেন। হাওয়া এমন প্রতিকূল বলে দেখানো হয়েছে কেন? তিনটি কারণের কথা ভাবা যায়।
প্রথমত, আয়বৃদ্ধির সহায়ক নীতি অনুসরণ করা ভাল, পরিকাঠামোয় মূলধনী বিনিয়োগ অনেকটা বাড়ানোর সিদ্ধান্তও অবশ্যই স্বাগত, কিন্তু রাজধানীর নীতিকাররা একটা সত্য অস্বীকার করতে পারবেন না: ভারতে যথেষ্ট কর আদায় করা হয় না। নাগরিকদের মাত্র ৩ শতাংশ আয়কর দেন। রাজকোষ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের কর্মসূচি কিছুটা পিছিয়ে দেওয়া চলে বটে, কিন্তু কোনও এক সময় তার ফল ভুগতে হবে। রাজস্ব কী ভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা চাই, সেই সংস্কারের পথ কুসুমাস্তীর্ণ হবে না। বাজেট এই প্রশ্নটিকে মোটের উপর এড়িয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত, কোম্পানি আয়কর কমানো, ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা বা উত্পাদন-শিল্পকে উত্সাহ দেওয়ার চেষ্টা খুবই ভাল উদ্যোগ, কিন্তু এই আয়োজন সফল হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে কিছু অমীমাংসিত সমস্যা, যেমন, জমি অধিগ্রহণ, শ্রম আইন সংস্কার, ইত্যাদি। তা ছাড়া, ভারতে ব্যবসা করায় নানান ঝামেলা এবং প্রচুর খরচ, এই প্রতিকূলতা দূর করা মোটেই সহজ নয়। কাজটা সময়সাপেক্ষ, এবং হাওয়া যেমন দ্রুত অনুকূল হয়েছে, ততটাই তাড়াতাড়ি উল্টো দিকে ঘুরে যেতে পারে। আরও মুশকিল হল, যে সব কোম্পানি তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চায়, প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মীর অভাব তাদের পক্ষে একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। কঠোর বাস্তব এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের সিকিভাগও কাজ পাওয়ার যোগ্য নয়। আরও বেশি আইআইটি, আইআইএম এবং এইম্স তৈরি করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। অন্য দিকে, এ দেশে অসংগঠিত ব্যবসার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি, ফলে উদ্যোগীদের প্রয়োজনীয় মূলধন সংস্থানের পথ সুগম করা দরকার। লগ্নির বাজার আরও অনেক বেশি মানুষের জন্য খুলে দেওয়ার কাজ এখনও বিশেষ এগোয়নি। ২০১৪ সালে ভারতে ৪৫০০০ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মধ্যে এক সমীক্ষা চালানো হয়। দেখা গিয়েছিল, ‘মোবাইল মানি’ অর্থাত্ মোবাইল ফোন বা অনুরূপ প্রযুক্তির সাহায্যে টাকা লেনদেনের পদ্ধতি ব্যবহার করেন মাত্র ০.৩ শতাংশ। কেনিয়ায় এই অনুপাত ৭৬ শতাংশ, প্রতিবেশী বাংলাদেশেও ২২ শতাংশ। যে দেশে এখনও এক বিরাট অংশের মানুষের ব্যাঙ্ক আমানত নেই, সেখানে মূলধনের জোগান দেওয়ার জন্য অন্য ধরনের উদ্ভাবনী ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি।
আর একটা বিরাট সমস্যা হল সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার ভয়াবহ দুর্দশা। স্বাস্থ্য পরিষেবায় ভারতে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ হল জিডিপি’র ১ শতাংশ, চিনে ৩ শতাংশ। এই বাজেটে স্বাস্থ্য বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ, রাজ্যগুলিকে বাড়তি খরচ করতে বলা হয়েছে। ভারতে ২১ শতাংশ অসুখ হয় জলবাহিত জীবাণুর কারণে, অর্ধেক মানুষ শৌচালয়ের অভাবে খোলা জায়গায় প্রাতঃকৃত্য সারেন, জনসাধারণের এক বিরাট অংশ পরিস্রুত পানীয় জল পান না। বছর কুড়ির মধ্যে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জলস্তর বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যাবে এবং দশ কোটির বেশি মানুষ তীব্র জলসংকটে পড়বেন। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক জল সরবরাহের নিরাপত্তার বিচারে ভারতের পরিস্থিতিকে ‘সংকটময়’ বলে চিহ্নিত করেছে। ব্যাপক অপুষ্টি এবং নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধির জীবাণুর প্রকোপে দেশে অসুখবিসুখের প্রবল দাপট, তার উপরে দৈনন্দিন খাওয়াদাওয়ার মান ক্রমশ খারাপ হচ্ছে, বহু মানুষ অত্যধিক জনবহুল শহরে অভিবাসী হচ্ছেন, পরিবেশের দূষণ ক্রমশই বাড়ছে, ফলে জনস্বাস্থ্যের সমস্যা বেড়েই চলেছে।
সুতরাং উড়ন্ত ঐরাবতের সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া-মোজাটির দিকেও নজর রাখা ভাল। অর্থমন্ত্রীর কন্ট্রোল টাওয়ার তাঁকে উড়ানের অনুমতি দিয়েছে। আমরা সবাই যাত্রী। কিন্তু আশা করব, টাওয়ারে বসে কেউ এক জন হাওয়ার গতির দিকে কড়া নজর রাখছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কোনও মজার ব্যাপার নয়, বিশেষ করে আপনি যদি উড়ন্ত হাতির পিঠে সওয়ার হন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টাফ্ট্স ইউনিভার্সিটিতে ফ্লেচার স্কুল-এ ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যান্ড ফিনান্স-এ অ্যাসোসিয়েট ডিন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy