প্রতিবাদ। সমাবর্তনে গীতশ্রী সরকার ও আচার্য কেশরনাথ ত্রিপাঠী।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উত্সবে মাননীয় রাজ্যপাল মহাশয়ের কাছ থেকে প্রশংসাপত্র নিতে প্রত্যাখ্যান করায় জনৈকা ছাত্রীর স্বপক্ষে অনেকেই বক্তব্য রেখেছেন। যে ছাত্রীটি শংসাপত্র নিতে অস্বীকার করেছেন, তাঁর গণতান্ত্রিক এবং অহিংসা প্রতিবাদের রূপটিকে অশ্রদ্ধা জানানোর কোনও কারণ নেই। নীতিগত ভাবে প্রতিবাদ জানানোর সম্পূর্ণ অধিকার তাঁর আছে, এ নিয়ে বিতর্ক ওঠা উচিত নয়। কিন্তু সেই ছাত্রীটির যখন আমাদের মতো বয়স হবে, তখন তিনি আরও অনেক কথা ভেবে এ ধরনের কাজটি করবেন, এটাও স্বাভাবিক। মাননীয় রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং আমাদের রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকর্তা। আশা করব, তাঁর যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে। যদি তাঁর মতো এক জন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং সাংবিধানিক আধিকারিক অপমানিত বোধ করে থাকেন, তা হলে রাজ্যবাসী তাকে অপমান বলেই মেনে নেবেন। এটা কোনও ব্যক্তির ব্যাপার নয়, এক জন সাংবিধানিক সর্বোচ্চ অধিকর্তার সম্মানের ব্যাপার। প্রতিবাদী ছাত্রীটি মঞ্চে না যেতেই পারতেন, সমাবর্তন উত্সবের প্রতীকী উত্তরীয় না-ই পরতে পারতেন। মঞ্চে উঠে শংসাপত্র নিতে প্রত্যাখ্যান করলে তিনি কালকের কাগজে খবর হবেন, এমন মানসিকতা আশা করি তাঁর ছিল না। শয়তানের উকিলের মতো আমি না-বলা কিছু অপ্রিয় প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি, শুধু ব্যাপারটিকে একটু অন্য ভাবে দেখার জন্য।
এই ঘটনার সূত্রেই আর এক বার মাননীয় উপাচার্য মহাশয়ের পদত্যাগের দাবিতে এবং আচার্যের তথাকথিত কঠোর ব্যবহারের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন কেউ কেউ। রাজ্য সরকারের অন্দরমহলেও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে, আর তাই নিয়ে রাজনীতিমহলেও বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। যেহেতু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কর্মকর্তার পদত্যাগ দাবি করা এবং আচার্য মহাশয়ের সেই দাবিকে সরকারি ভাবে অগ্রাহ্য করার ঘটনাটি আসলে ‘জনতার আদালত’-এর উপেক্ষা বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা অব্যাহত, তাই স্রোতের ধারার বিপক্ষের যুক্তিগুলো উত্থাপন করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যেমন আন্দোলনের ব্যাপারে কিছু অপ্রিয় সত্য আগের একটি লেখায় বলার চেষ্টা করেছিলাম। (‘ছাত্র আন্দোলন বিষয়ে কিছু অপ্রিয় সত্য’, ৪-১১) এ লেখাটিতেও সংক্ষিপ্ত ভাবে কতগুলো প্রাসঙ্গিক, কিন্তু না-বলা কথার ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
প্রথমেই বলে রাখি, উপাচার্যের পদে বর্তমানে যিনি আসীন, তাঁর এই পদে বসার যোগ্যতা, তাঁকে সেই পদে বসানোর প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে মাননীয় হাইকোর্টে মামলা রুজু করা হয়েছে বলে শুনেছি। যদি সেই মামলা চালু থাকে, তা হলে কারও, কোনও ভাবে, কোনও প্রসঙ্গে তাঁর পদত্যাগ নিয়ে কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়। এ তো গেল নিয়মের কথা। অন্য দিকে, যুক্তিবোধ বলে, অতীতে যাঁরা শুধু একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকার সুবাদে বিভিন্ন কর্মকর্তার আসন অলংকৃত করেছিলেন, যাঁদের নিজেদের ছাত্রজীবনে, শিক্ষাজীবনে ‘কালো ঘটনা’র শেষ নেই, কিংবা যাঁরা এটুকুও বোঝেন না, যে প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে কত হাত উঠল, সেই তোলা হাতের সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচন হতে পারে না, তাঁদের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে মন্তব্য থেকে বিরত থাকা উচিত বলেই মনে হয়।
আমরা অনেকেই জানি, স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের আগে অনেক বার অনেকে মাননীয় রাজ্যপালের কাছে তাঁদের উষ্মা প্রকাশ করতে গিয়েছিলেন, যাতে কিছুতেই বর্তমান উপাচার্য সেই পদে আসীন হতে না পারেন, তার জন্য বিভিন্ন ভাবে যুক্তির অবতারণা করেছিলেন। মাননীয় আচার্যের মতই শেষ কথা, এ কথা মনে করেই নিশ্চয়ই তাঁরা এমনটা করেছিলেন। মাননীয় আচার্য তথা রাজ্যপাল মহাশয় সব পক্ষের সব কথা শুনে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে নথিবদ্ধ প্রক্রিয়া বিচার-বিবেচনা করে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন। এই পদ্ধতিটিকে মানুষ কি অবিশ্বাস করবে? না শুধুই ভাববে, নবান্ন থেকে আসা ফোনের জন্যই উপাচার্য বহাল হয়েছেন? বিক্ষুব্ধ মানুষজন (যাঁদের মধ্যে পুরনো জমানায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি নিয়োগকে কার্যত একটি দলের অঙ্গুলিহেলনে নির্ধারিত করার ধারক-বাহকরাও বিরাজমান) উপাচার্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বলে শুনেছি। তার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উত্সবে মাননীয় আচার্য মহাশয়কে রাস্তা থেকে মঞ্চ পর্যন্ত অশ্রাব্য অপমানকর কথা শুনতে হয়েছে। কেউ তো বলতেই পারেন যে, লক্ষ্মণরেখা সত্যিই লঙ্ঘিত হচ্ছে।
সম্মাননীয় সজ্জন শিক্ষকরা কেউ কেউ বলছেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় রসাতলে গেল বলে। সত্যিই কি তাই? অতীতেও মেধাবী এবং সম্মানিত অধ্যাপকদের বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তখন কোনও প্রতিবাদ হয়েছিল কি? বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টির ‘ডিন’দের ভূমিকা অপরিসীম। তাঁরাই কার্যত পড়াশোনা সম্পর্কিত সব রকম কর্মকাণ্ডের মাথায় থাকেন। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে অপেক্ষাকৃত নবীন অধ্যাপকরা ডিন হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁদের কাউকে ‘ভোট’ জোগাড় করে আসতে হয়নি। এবং যেহেতু কেউ এক বারের বেশি ডিন হতে পারবেন না, তাই মৌরসি পাট্টা হারিয়ে অতীতের সাহেব-সাহেবাদের ক্ষোভের শেষ নেই। তারও প্রতিফলন ‘কালো ব্যাজ’-এ পড়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ডিন সাহেবরা কেমন কাজ করছেন, অধ্যাপক নিয়োগ প্রক্রিয়া কেমন চলছে, আদৌ ডিন সাহেবরা ঠিক কাজ করছেন কি না, যদি করে থাকেন, তা হলে বিশ্ববিদ্যালয় আদৌ রসাতলে যাচ্ছে কি না, সেটাও নিশ্চয়ই ভাবতে হবে। যেহেতু আমি সেখানে কাজ করি না, ভেতরের ব্যাপার আমি জানি না। তবে আশা করব, যেমন অনেকেই করবেন যে, উপাচার্য মশাই সেখানে শান্তিপূর্ণ ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে উদ্যোগী হবেন।
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতিবিদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy