Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ১

ভারতীয় রাজনীতি আর জন্মদিনের কেক

নব্বই দশকের আগে কিন্তু এই ভাবে জন্মদিন পালনের চলটা নেতাদের মধ্যে দেখা যেত না। অভিজাত ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা? কিন্তু ভারতীয় অভিজাতদের মধ্যেও তো জন্মদিনের উত্‌সব বহুলপ্রচলিত নয়! আসল গল্পটা আর একটু জটিল।রাজনৈতিক নেতাদের জন্মদিন এখন ভারতের নতুন ফ্যাশন। দেখা যাচ্ছে, পরিবারের সদস্য, দলীয় সমর্থক সকলে মিলে নেতা বা নেত্রীর জন্মদিনের হুজুগ তুলে বেশ একটা কাণ্ড বাধিয়ে তুলছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনেও বিরাট ঘনঘটা দেখা গেল, আমদাবাদে সবরমতীর তীর ধরে কয়েক দিন মহা আড়ম্বর চলল।

জন্মদিনের মহিমা। নরেন্দ্র মোদী (বাঁ দিকে) ও মুলায়ম সিংহ যাদব।

জন্মদিনের মহিমা। নরেন্দ্র মোদী (বাঁ দিকে) ও মুলায়ম সিংহ যাদব।

বদ্রী নারায়ণ
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

রাজনৈতিক নেতাদের জন্মদিন এখন ভারতের নতুন ফ্যাশন। দেখা যাচ্ছে, পরিবারের সদস্য, দলীয় সমর্থক সকলে মিলে নেতা বা নেত্রীর জন্মদিনের হুজুগ তুলে বেশ একটা কাণ্ড বাধিয়ে তুলছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনেও বিরাট ঘনঘটা দেখা গেল, আমদাবাদে সবরমতীর তীর ধরে কয়েক দিন মহা আড়ম্বর চলল। গুজরাত সরকার অবশ্য অন্য কথা বলল। তাদের বক্তব্য, চিনা প্রধানমন্ত্রী সে রাজ্যে আসছেন বলেই না কি এত ঘটার আয়োজন। তবে কি না, এ যে নেহাতই কথার কথা, আসল কথাটা যে অন্য, দেখেশুনে যে কেউ সেটা বুঝবে।

নরেন্দ্র মোদী নিজে আশৈশব পালিত হয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আদর্শে। সেই আদর্শে কিন্তু জন্মদিন পালনের চর্চা ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষমতায় আরোহণই তাঁকে রাজনীতির এই পার্শ্ব-সংস্কৃতির মধ্যে নিয়ে এসেছে। রাজনীতির কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত এলে জন্মদিনের অর্থ এবং চিত্র দুটোই যে পাল্টে যায়, তিনি বুঝেছেন।

সম্প্রতি বহুজন সমাজ পার্টির তরফে ঘোষণা শোনা গেল, পার্টির সর্বময় নেত্রী মায়াবতীর ঊনষাটতম জন্মদিন পালন করা হবে ১৫ জানুয়ারি। প্রতিটি ব্লকে, প্রতিটি রাস্তায় বিএসপি কর্মীরা এই দিনটি ধূমধামের সঙ্গে পালন করবে। নিহিতার্থটি স্পষ্ট। সামনে নির্বাচন। দলকে চাঙ্গা করা, কর্মীদের মনে উত্‌সাহ জাগানো জরুরি। সুতরাং নেত্রীর জন্মদিনটা কাজে লাগানো উচিত। আগে অনেক বারই মায়াবতীর জন্মদিনে এমন ধনাঢ্য বর্ণাঢ্য ধূম দেখা গিয়েছে, দলের সমর্থকদের কাছ থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ হয়েছে যে দলের ভেতরে বাইরে সর্বত্রই প্রবল সমালোচনার তরঙ্গ উঠেছে। প্রচারমাধ্যমও ছেড়ে কথা কয়নি। তার পর থেকেই মায়াবতী সামলে নিয়েছেন, ঐশ্বর্যের দেখানেপনা ছেড়ে নিজের জন্মদিনের সঙ্গে দলীয় সংগঠনের কাজটাকে যুক্ত করে দিয়েছেন তিনি। কর্মীদের বলেছেন, ওই দিনটিতে গরিব গৃহহীন অসহায় মানুষদের সাহায্যের হাত এগিয়ে দেওয়ার কাজটায় মন দিতে।

এই বছর মুলায়ম সিংহ যাদবের বর্ণময় জন্মদিন উত্‌সবেও এল মায়াবতীর অকুণ্ঠ উত্‌সাহ। ‘মাটির পুত্র’ মুলায়ম, গরিব পশ্চাদ্‌পর মানুষের নেতা মুলায়মের জন্মদিন পালনের যে ‘তরিকা’ দেখা গেল উত্তরপ্রদেশের রামপুরে, এক কথায় তা অসামান্য, অভূতপূর্ব! ঠিক রাজা-মহারাজাদের ছবির মতো রৌপ্যনির্মিত রথে চড়িয়ে তাঁকে উত্‌সব প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে এক দিকে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে রাজকীয় উত্‌সবের আড়ম্বর, অন্য দিকে দিনব্যাপী ভজন-পূজনগীত। বিরাট কাট-আউটে চতুর্দিক ছয়লাপ, বিশাল কেক, মোটা মোটা মালা...!

প্রশ্ন হল, ঠিক কবে থেকে এই ‘ঐতিহ্য’ শুরু হল? এবং, এই ঐতিহ্যের রাজনীতির অর্থটাই বা ঠিক কী?

ভারতীয় সংস্কৃতিতে, বড়লোক হয়ে ওঠা মানে ধনসম্পদের আড়ম্বর প্রদর্শন। অভিজাত সম্প্রদায়ের সেই আড়ম্বরের মধ্যে ‘রাজপুত্র’দের জন্মের দিনটি ঘটা করে পালিত হত ঠিকই, কিন্তু পরবর্তী জীবনে ‘জন্মদিন’ পালনের ঐতিহ্য কিন্তু সাধারণত দেখা যেত না। তবে কি না, সামন্ত প্রভু ও জমিদারদের ক্ষেত্রে ‘সোলা সংস্কার’ অর্থাত্‌ পূজা ও প্রার্থনার মাধ্যমে এক রকম জন্মদিন উদ্‌যাপন হয়ে থাকে। অনেক আবার খাবার, জামাকাপড় বিতরণ করেন। রাজা হর্ষবর্ধন না কি ইলাহাবাদের প্রয়াগে গিয়ে বসতেন, আর গরিবদুঃখীকে সাধ্যমতো দানধ্যান করতেন। তবে তিনি যা-ই করুন, সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, ভারতীয় অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে কিংবা সামন্ত শ্রেণির মধ্যে কিন্তু এই জন্মদিন পালনের সংস্কার কোনও কালেই ছিল না।

লক্ষণীয়, আধুনিক ভারতেও কিন্তু নব্বই-এর দশকের আগে এ হেন জন্মদিন সংস্কৃতিটা ছিল না। হয়তো, নব্বই দশকের বাজারমুক্তি ও পশ্চিমি সংস্কৃতির বিস্তারের সঙ্গে এর একটা যোগ থাকতে পারে। দক্ষিণ ভারতের নেতাদের যে ভাবে ‘পুজো’ করা হয়, তার সঙ্গেও একটা যোগ থাকা সম্ভব। নব্বই-এর দশকে চন্দ্রশেখর, বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ এঁদের জন্মদিন এ ভাবে পালন করা হত বলে মোটেই মনে পড়ে না। মুলায়ম সিংহ যাদবকে সত্তর-আশির দশকের রাজনীতির উত্তরাধিকার বলে বর্ণনা করা হয়, কিন্তু লক্ষ করতে হবে যে, এ দিক দিয়ে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার।

একটা কথা বোঝা জরুরি। ভারতীয় রাজনীতির অন্তহীন দুর্নীতি আর ক্রমবর্ধমান অন্যায়প্রবণতার সঙ্গে এই নতুন প্রথার সম্পর্ক কিন্তু বেশ ঘনিষ্ঠ। ক্ষমতা ও পেশিশক্তির উপর রাজনীতি যখন এতটা নির্ভরশীল হয়, তার একটা নিজস্ব স্ট্র্যাটেজি বা পদ্ধতিও তৈরি হতে থাকে। উত্তর ভারতে জন্মদিন সংস্কৃতির সাম্প্রতিক বাড়াবাড়ি সেই স্ট্র্যাটেজিরই একটা অংশ। আড়ম্বর, লোকদেখানো ধূমধাম, সামন্ত-সংস্কৃতির বিভিন্ন চিহ্নকের সঙ্গে জুড়ে এই উত্‌সবের নতুন চেহারা, এ সবই আসলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে লুকোনো গভীর দ্বন্দ্ব। এই দানবিতরণের মাধ্যমে আসলে মানুষকে পুরনো বড়লোকদের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাত্‌ এর মধ্যে একটা প্রতীক-কেন্দ্রিক রাজনীতি নির্মাণের চেষ্টা আছে। ভারতীয় গণতন্ত্র যেমন এক দিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা, পারিবারিক শাসন ও সামন্ত সংস্কৃতি, আর অন্য দিকে আধুনিকতার স্বপ্ন, আধুনিক জীবনযাপনের ইচ্ছা, প্রযুক্তি ইত্যাদির মধ্যে দ্বন্দ্বের মঞ্চ, ঠিক তেমনই, নেতাদের এই জন্মদিন সংস্কৃতিও ক্রমশ এক দিকে ঐতিহ্যময় অভিজাতদের চিহ্নক, অন্য দিকে নিবার্চনী রাজনীতির সোপান হয়ে উঠছে। তাই জন্য জন্মদিনে নেতার জন্য এত বড় কেক বানাতে হয়, তাঁকে রুপোর রথে চড়িয়ে ঘোরাতে হয়, আবার পাশাপাশি নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে সমর্থকদের কাছ থেকে অর্থসংগ্রহের কাজটাও না করলে চলে না!

যে গতিতে এ দেশের রাজনীতিতে এই ‘আওয়ারা ফান্ড’ বা অজ্ঞাত অর্থ ঢুকছে, তাতে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কাঠামোটির বড় রকমের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, সন্দেহ নেই। এই টাকার বেশির ভাগটাই দুর্নীতি-প্রসূত অর্থ। নেতাদের ফান্ড-এ এই টাকা ঢুকছে মানে রাজনীতির মধ্যে একটা মেকি ফাঁপানো সাচ্ছল্য তৈরি করা হচ্ছে, বাস্তবের থেকে অনেক গুণ ফাঁপানো! রাজনৈতিক নেতারা এবং তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গ, সকলে মিলে এই অজ্ঞাতকুলশীল অর্থভাণ্ডারে পুষ্ট হচ্ছে, এবং এই ভাণ্ডারের জোরেই নেতাদের জন্মদিনে এই অদৃষ্টপূর্ব মহোত্‌সবের প্রথা নির্মিত হচ্ছে। দলের সমর্থন-ভিত্তির মধ্যে যে বিশালাকার মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ক্ষমতালোভী কর্মী-সমর্থকের দল, সকলের জন্যই এই স্ট্র্যাটেজি শেষ পর্যন্ত বেশ ফলপ্রসূ।

একই সঙ্গে, জন্মদিন সংস্কৃতির এই নব্য ধারা আরও একটা কথা বলে দেয়। বলে দেয় যে, ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজে একটা বিরাট অংশ কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রগতিশীল কিংবা লিবারাল ভাবধারার বাহক নয়। বরং ভারতীয় গণতন্ত্রের মধ্যে যে গভীরচারী দ্বন্দ্ব, যেখানে সামন্ত সংস্কৃতির অপার মোহ ও আধুনিক জীবনযাপনের অদম্য আকর্ষণ, এই দুই-এর দ্বন্দ্বের উত্‌স কিন্তু এই শ্রেণির মধ্যেই। এঁদের দিকে তাকিয়েই এই নতুন রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির সৃষ্টি ও নির্মাণ। এঁদেরই হাতে সেই নব্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভরণপোষণের সমস্ত ভার, যেখানে নেতাদের জন্মদিন মানেই রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্‌সবের ঢল! এর মধ্যে দুর্ভাগ্যের কথা একটাই। রাজনীতি এক দিন গরিব মানুষকে উত্তরণের পথে নিয়ে যাবে, তাদের জীবনে কিছু পরিবর্তন আনবে, এমনই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু এই নতুন ধারা স্পষ্ট দেখিয়ে দিচ্ছে, ভারতের রাজনীতিতে আসলে ঘটছে উল্টোটাই। রাজনীতি কথাটির ‘র্যাডিকাল’ অর্থটিই আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে বসেছে।

জি বি পন্থ সোশ্যাল সায়েন্স ইনস্টিটিউটে ইতিহাসের অধ্যাপক

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial badri narayan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy